শুক্রবার, ১১ এপ্রিল, ২০২৫, ঢাকা

বন কার, হাতির না মানুষের!

মো. নাঈম ইসলাম, শেরপুর
প্রকাশিত: ১১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫৬ পিএম

শেয়ার করুন:

loading/img
ছবিগুলো সম্প্রতি শেরপুরের গারো পাহাড় হতে তুলেছেন নাঈম ইসলাম।

শেরপুরের গারো পাহাড়ে দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসছে হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব। দিন দিন বনাঞ্চল দখল হয়ে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে হাতির খাবার ও বাসস্থানের সংকট। এখন স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠেছে বন কার, হাতির না মানুষের।

সম্প্রতি জেনারেটরে জিআই তারে বিদ্যুতের সংযোগ দিয়ে হত্যা করা হয়েছে এক বন্য হাতিকে। পরিবেশবাদীরা বলছেন, আইনের সঠিক প্রয়োগ না করায় চলছে হাতি হত্যা।


বিজ্ঞাপন


স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নালিতাবাড়ীর বাতকুচি টিলাপাড়া গ্রামে সম্প্রতি ধানক্ষেতে কৃষকদের দেওয়া জেনারেটরের তারে জড়িয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে একটি বন্য হাতির মৃত্যু হয়। আর ওই রাতে ২৫ থেকে ৩০টি হাতি ছিল। শুক্রবার থেকে ওই দলে আরও ৩০ থেকে ৩৫টি হাতি যোগ দিয়েছে। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে হাতি মৃত্যুর ঘটনায় গত শুক্রবার রাতে ময়মনসিংহ বন বিভাগের মধুটিলা ইকোপার্কের রেঞ্জ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনে ১১ জনের নামে নালিতাবাড়ী থানায় মামলা করেছেন। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও ১০–১২ জনকে আসামি করা হয়েছে। এই মামলায় জেনারেটর চালক শহিদুল ইসলাম (৪০) নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

বন বিভাগ, পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি রাতকুটি টিলাপাড়া পাহাড়ের ঢালে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় থেকে দুজন ভেটেরিনারি সার্জন গিয়ে ময়নাতদ‌ন্তের আলামত সংগ্রহ ক‌রার পর সেখানেই হাতিটিকে মাটিচাপা দেওয়া হয়। ঘটনার রাত থেকে ওই স্থানের আশপাশে ৫০ থেকে ৬০টি বন‌্য হা‌তি অবস্থান করছে। হাতির পালটি বাতকুচি গ্রামের পাহাড়ের ঢালে কৃষকের আমন খেত নষ্ট করে দিচ্ছে। গত দুই সপ্তাহে বন্য হাতির পাল বাতকুচি, শমশ্চুড়া ও কোচপাড়া গ্রামের জমির ফসল থেকে হাতি তার খাবার সংগ্রহ করেছে। এতে এসব পাহাড়ি জমির  ফসল নষ্ট হচ্ছে, অভিযোগ করেন স্থানীয়ররা।

elephent_-2

ফসল নষ্ট নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত জানিয়েছেন স্থানীয়রাও। কেউ কেউ ফসল হারিয়ে দুষছেন বন্যহাতিকে। তবে অনেক চাষি বলছেন, হাতি ধান খেয়েছে এতে তাদের আপত্তি নেই।


বিজ্ঞাপন


হাতি সম্পর্কে শেরপুর সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সাহানা আক্তার বলেন, একটি মা হাতি প্রায় ২২ মাস গর্ভধারণ করে। প্রায় সাত বছর বয়সে হাতি শারীরিক পূর্ণতা পায় এবং ১৪-১৫ বছর বয়সে যৌন পরিপক্বতা লাভ করে। একটি প্রাপ্তবয়স্ক হাতির উচ্চতা সাধারণত ৭-১০ ফুট পর্যন্ত হতে পারে এবং লেজের আগা থেকে শুঁড়ের মাথা পর্যন্ত দৈর্ঘ্য প্রায় ১৮-২৫ ফুটের মতো হতে পারে। গড়ে প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক হাতির ওজন ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। দিনে প্রায় ১৫০ কেজি খাবার ও ২১০ লিটার পর্যন্ত পানি গ্রহণ করে থাকে একটি প্রাপ্তবয়স্ক হাতি। একটি হাতি সাধারণত ৬০-৭০ বছর পর্যন্ত বাঁচে। আর এ সময়ে তাদের মোট ছয়বার পর্যন্ত দাঁত গজায়।

আরও পড়ুন

নীরবে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম-বাংলার নবান্ন উৎসব

হাতি থাকবে কোথায়, এ প্রশ্নে এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমের ট্রেইনার আদনান আযাদ বলেন, গুগুল ম্যাপ কিংবা ঝিনাইগাতীর বয়স্কদের কাছ থেকে জানতে পারবেন আজ থেকে ২০ বা ৩০ বছর আগে গারো পাহাড় একটি গহীন বন ছিল। এখানে হাতি, বাঘ, বন্য শুকুর, বন্যবিড়াল, বন্য মোড়গের দেখা মিলত হরহামেষেই। মানুষ দিন দিন বন কেটে সরকারি জায়গা দখল করে বাড়িঘর বানাচ্ছে। বন ন্যাড়া করে ফেলেছে। বনে মানুষ অনুপ্রবেশকারী। হাতি বা অন্যসব বন্যপ্রাণীর বাস করার জায়গা মানুষ দখল করেছে তাই প্রাণীরা তাদের জায়গা পাচ্ছে না। আর অনুপ্রবেশকারী মানুষরা এসব বন্যপ্রাণীদের বিশেষ করে হাতিকে বন থেকে তাড়াতে যুদ্ধে নেমেছে। হাতির কান্না দেখার যেন কেউ নেই। হত্যা, হামলা, বাসস্থান উজাড় এসবের জন্য হাতির অস্তিত্ব এখন সংকটের মুখে।

thumbnail_elephent-4

ফিল্ড রিচার্স ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশ ওয়াইল্ড এলিফ্যান্টের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান পৃথিল ঢাকা মেইলকে বলেন, গারো পাহাড়ের প্রায় প্রতিটি হাতিকেই পরিকল্পিতভাবে হত্যা করছে বনখেকোরা। নির্বিচারে বনভূমি দখল করে চাষাবাদ করায় হাতি লোকালয়ে এসে পড়ছে। গারো পাহাড়ে প্রতি বছর শীত মৌসুমে দেখা যায় বন্য হাতি। এ মৌসুমে প্রায় দুই শতাধিক হাতি এখন পাহাড়ে আছে। বন্য প্রাণীর বিচরণের জায়গায় আবাসভূমি গড়ে তোলায়, হাতি- মানুষের দ্বন্দ্ব দীর্ঘ দিনের। শেরপুরের তিনটি উপজেলায় এমনভাবে পাহাড় বেদখল হয়েছে। হাতির চলাচলের পথটুকুও অবশিষ্ট নেই। সবজায়গায় নতুন নতুন বাড়ি উঠছে, বন বিনষ্ট হচ্ছে দিনের পর দিন। এদিকে বনবিভাগ ও প্রশাসন যেন নিরুপায় বনখেকোদের কাছে।

পরিবেশবাদী সংগঠন শাইনের সভাপতি মুগনিউর রহমান মনি বলেন, হাতি হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না নেওয়ায় থামছে না হাতির মৃত্যু। তাই হাতি হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই সঙ্গে বনে হাতির পর্যাপ্ত খাদ্যের ব্যবস্থা ও সীমান্তে অভয়ারণ্য তৈরি করতে হবে। বন হাতির জায়গা, আর বনে মানুষ অনুপ্রবেশ করে দখলে নিয়েছে। হাতির জায়গা দখল করে নিলে, এখন হাতি থাকবে কোথায়। এভাবে চলতে থাকলে, একসময় গারো পাহাড় হতে হাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

thumbnail_elephent_-1

শেরপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) তরফদার মাহমুদুর রহমান বলেন, সীমান্তে সোলার ফেন্সি, বায়ো ফেন্সি করে এবং ইআরটি টিমের সংখ্যা বাড়িয়ে হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। হাতির কারণে যাদের আবাদি ফসল, ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার বিষয়টি কীভাবে দ্রুত নিশ্চিত করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে।

ময়মনসিংহ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আ ন ম আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, শেরপুর সীমান্তের বনাঞ্চলে এখন কমবেশি প্রায় ১২০টির মতো হাতি বিচরণ করছে। এগুলো পরিযায়ী হাতি হলেও এখন প্রায় ৪০-৫০টি বন্য হাতি দীর্ঘদিন ধরে শেরপুর সীমান্তে অবস্থান করছে।

প্রতিনিধি/এসএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর