ধর্ম ডেস্ক
৩১ মে ২০২৩, ০১:৫১ পিএম
নামাজের জন্য অজু করা শর্ত। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! যখন তোমরা নামাজে দাঁড়াতে চাও; তখন তোমাদের মুখমণ্ডল ধোও, আর উভয়হাত কনুই পর্যন্ত ধোও, মাথা মাসেহ কর এবং উভয় পা টাখনু পর্যন্ত ধোও।’ (সুরা মায়েদা: ৬)
আল্লাহর রাসুল (স.) বলেন, ‘তোমাদের কারো যদি অজু ভেঙে যায়, তাহলে পুনরায় অজু করার আগ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা তার নামাজ কবুল করেন না।’ (বুখারি: ৬৯৫৪; মুসলিম: ২২৫)
হাদিসে আরও বর্ণিত হয়েছে, ‘জান্নাতের চাবি হচ্ছে নামাজ, আর নামাজের চাবি হচ্ছে অজু।’ (তিরমিজি: ৪)
উল্লেখিত হাদিস ও কোরআনের আয়াতের মাধ্যমে প্রমাণিত হচ্ছে পবিত্রতা অর্জনের জন্য অজুর গুরুত্ব অপরিসীম।
আমরা জানি যে বিভিন্ন কারণে অজু ভেঙে যায়। এর মধ্যে চিত বা কাত হয়ে ঘুমিয়ে যাওয়াও একটি কারণ। (মুসনাদে আহমদ: ২৩১৫; সুনানে আবু দাউদ: ২০২)
পায়খানা ও পেশাবের রাস্তা দিয়ে বায়ু, পেশাব-পায়খানা, পোকা ইত্যাদি বের হলেও অজু ভেঙে যায়। (হেদায়া: ১/৭)
অর্থাৎ চিত বা কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লে নিশ্চিতভাবেই অজু ভেঙে যায় এবং নামাজের জন্য পুনরায় অজু করতে হয়।
কিন্তু কেউ যদি চিত বা কাত হয়ে না ঘুমায়, বরং হেলান দিয়ে ঘুমায় এবং এ সময় যদি নিতম্ব মাটি থেকে পৃথক না হয় তাহলে কি অজু ভাঙবে? এর উত্তরে অনেক ফতোয়ার কিতাবে উল্লেখ রয়েছে— ‘হেলান দিয়ে ঘুমানোর সময় যদি নিতম্ব মাটি থেকে পৃথক না হয় তাহলে অজু ভঙ্গ হবে না। (হিন্দিয়া: ১/১২, আল মুহিতুল বুরহানি: ১/৬৮, রদ্দুল মুহতার: ১/১৪৩, আহসানুল ফতোয়া: ২/২২-২৩, ফতোয়ায়ে ফকিহুল মিল্লাত: ৩/৫৬)
আরও পড়ুন
অজু করে ঘুমানোর বিস্ময়কর ফজিলত
অজু দাঁড়িয়ে করা যাবে কি?
এখানে অজু না ভাঙার মূল যে কারণটি দেখা যাচ্ছে, সেটি হলো—নিতম্ব মাটি থেকে পৃথক না হওয়ার কারণে কোমরের নিচের অংশ মাটি, ফ্লোর, চেয়ার ইত্যাদির সাথে ভালোভাবে এঁটে লেগে থাকা।
যদি ঘুমন্ত অবস্থায় কোমরের নীচের অংশ মাটি, ফ্লোর, চেয়ার ইত্যাদি থেকে পৃথক হয়, তাহলে অজু নষ্ট হয়ে গেছে বলে ধরা হবে। এক্ষেত্রে নামাজের জন্য পুনরায় অজু করতে হবে। (বাদায়েউস সানায়ে: ১/১৩৫; ফতোয়া খানিয়া: ১/৪১; খুলাসাতুল ফতোয়া: ১/১৯)
নামাজের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লে অজু ভঙ্গ হবে কি হবে না—এ ব্যাপারে ফুকাহায়ে কেরামদের মধ্যে মতভেদ দেখা যায়। কেউ বলেছেন, সুন্নত নিয়মে নামাজ পড়া অবস্থায় ঘুমালে অজু ভঙ্গ হয় না। যেমন আল্লামা ইবনে হুমাম (রহ.) বলেন- ‘দাঁড়ানো অবস্থায়, বসে, রুকু-সেজদা অবস্থায়— চাই তা নামাজের ভেতরে হোক বা বাইরে হোক– ঘুমালে অজু ভঙ্গ হয় না, কারণ তখনও অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ধারণ ক্ষমতা কিছুটা হলেও অবশিষ্ট থাকে। কিছুই না থাকলে তো পড়ে যেত। (ফাতহুল কাদির: ১/৩৮)
হানাফি মাজহাবের ইমামদের মতে, নারীরা তাদের জন্য নির্ধারিত নিয়মে নামাজ পড়া অবস্থায় সেজদায় ঘুমিয়ে পড়লে অজু ভঙ্গ হবে। কারণ তারা যে তরিকায় সেজদা করে তাতে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জোড়াগুলো ঢিলে থাকে। তবে কিছুসংখ্যক ফকিহ নামাজের ভেতর সেজদারত অবস্থায় ঘুমালে অজু ভঙ্গ না হওয়ার কথা বলেন। চাই সেজদা সুন্নত তরিকায় করুক বা না করুক। এর কারণ হিসেবে তারা ওই হাদিসকে পেশ করেন যাতে সেজদা অবস্থায় ঘুমালে অজু ভঙ্গ না হওয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। আর সে হাদিসে সুন্নত তরিকায় সেজদা করতে হবে— এমন কোনো কথা উল্লেখ নেই।
আরও পড়ুন
তাহিয়্যাতুল অজুর বিনিময় যেভাবে সরাসরি জান্নাত!
নবজাতকের মতো নিষ্পাপ হতে যেভাবে অজু করবেন
ফকিহগণের মতভেদের ব্যাপারে আল্লামা শামী (রহ.) বলেন, সেজদা অবস্থায় ঘুমালে অজু ভঙ্গ হবে কি না—এ ব্যাপারে ফকিহগণের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে। কেউ বলেন, নামাজের ভেতরে হোক বা বাহিরে হোক সেজদা অবস্থায় ঘুমালে অজু ভঙ্গ হবে না। তুহফাতুল ফুকাহা কিতাবে এটিকে সহিহ আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং খুলাসাতুল ফতোয়ায় এটিকে জাহিরুল মাজহাব হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেন, অজু ভঙ্গ হয়ে যাবে। খানিয়া কিতাবে এটিকে জাহিরুর রিওয়ায়াহ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু যাখীরা কিতাবে প্রথম মতটিকেই প্রসিদ্ধ মত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেছেন, সুন্নত তরিকায় ঘুমালে অজু ভঙ্গ হবে না। অন্যথায় ভঙ্গ হয়ে যাবে। বাদায়েউস সানায়ে কিতাবে এটিকে আকরাব ইলাস সওয়াব (সঠিকতার নিকটতম) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে নামাজের ভেতর সুন্নত তরিকায় না ঘুমালেও অজু ভঙ্গ না হওয়ার কথা যে বলেছি তা আমরা হাদিসের কারণে বলেছি। ইমাম যায়লাঈ (রহ.) বাদায়েউস সানায়ের মতটিকেই প্রাধান্য দিয়ে বলেন- নামাজের ভেতরে হলে অজু ভঙ্গ হবে না কারণ রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন ওই ব্যক্তির উপর অজু ওয়াজিব নয় যে দাঁড়িয়ে বা বসে অথবা সেজদারত অবস্থায় ঘুমিয়েছে। আর নামাজের বাহিরে হলে সুন্নত তরিকায় ঘুমালে হলে অজু ভঙ্গ হবে না। আর সুন্নত তরিকায় না হলে অজু ভঙ্গ হয়ে যাবে। ইবনে নুজাইম আল বাহরুর রায়েকে এবং আল্লামা হালাভী (রহ.) শরহুল মুনয়াতে উক্ত অভিমতকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। (ফতোয়ায়ে শামী: ১/১৪২(সাঈদ), আল বাহরুর রায়েক: ১/৭৩(থানবী)
হেলান দিয়ে ঘুমানোর ক্ষেত্রেও ফুকাহায়ে কেরামদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। আল্লামা হাসকাফি (রহ.) আব্দুররুল মুখতার কিতাবে লেখেন, জমিনে নিতম্ব স্থির রেখে ঘুমালে অজু ভঙ্গ হবে না যদিও ঘুম অনেক লম্বা সময় পর্যন্ত হয়। অন্যত্র তিনি বলেন, যদিও সে কোনো কিছুর সাথে হেলান দিয়ে ঘুমায়।
কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে উল্লেখিত সবগুলো ফতোয়ার ওপর আমল করা উচিত হবে না বলে মনে করেন অনেক ফুকাহায়ে কেরাম। নামাজে বা নামাজের সেজদায় ঘুমালেও সর্বোচ্চ সতর্কতা হিসেবে অজু ভেঙে যাওয়ার কথা বলেছেন তারা।
এ ব্যাপারে গাঙ্গুহী (রহ.) এবং আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহ.) বলেন, বর্তমানে যেহেতু মানুষ শারীরিকভাবে দুর্বল এবং তারা প্রচুর পরিমাণে আহার করে থাকে ফলে পেটের ভেতর গ্যাস ইত্যাদি সৃষ্টি হয় এবং ঘন ঘন বায়ু বের হয় তাই ঘুমিয়ে পড়লে কখন যে তার বায়ু বের হয়ে যায় সে টেরও পায় না। এজন্য ঘুমের সব অবস্থায় অজু ভেঙে যাবে। তাদের মতে, নামাজের বাহিরে ইমাম তাহাবি (রহ.) এবং কুদুরি (রহ.)- এর মতামত অনুযায়ী ফতোয়া দেওয়াই সর্তকতা হিসেবে বিবেচিত হবে অর্থাৎ কেউ যদি জমিন বা যানবাহনের আসনে বসে এমনভাবে হেলান দিয়ে ঘুমায় যে হেলান দেয়া বস্তু সরিয়ে ফেললে সে পড়ে যাবে তাহলে তার অজু ভঙ্গ হয়ে যাবে।
হেলানে অজু ভঙ্গ প্রসঙ্গে কাশ্মীরী (রহ.) বলেন, স্থান-কাল ও পাত্রভেদে এবং মানুষের কল্যাণের প্রতি লক্ষ্য রেখেই ফতোয়া প্রদান করা হয়। তাই বর্তমান যুগে ঘুম অজু ভঙ্গকারী হওয়ার বিষয়ে পূর্ববর্তী ফুকাহায়ে কেরামের মতো বেশি ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ এ যুগের লোকেরা অধিক পরিমাণে আহার করে থাকে (যার দরুন পেটে গ্যাস সৃষ্টি হয় এবং ঘন ঘন বায়ু বের হয়) ফলে নিতম্ব জমিনে স্থির থাকা অবস্থায়ও তাদের ওজু ছুটে যায়। (ফয়জুল বারি: ১/৪০৮, মাকতাবায়ে আশরাফিয়া)
রশিদ আহমদ গাংগুহী রহ.বলেন, আমাদের এই বর্তমান সময়ের হানাফি মাজহাব অনুসারীদের জন্য উচিত হবে, তাদের মাজহাবে গৃহীত পূর্ব সিদ্ধান্ত— নামাজের হালতে ঘুমালে অজু ভঙ্গ হবে না–থেকে সরে আসা। কেননা আমরা অনেক মানুষকে দেখেছি আসন পেতে ঘুমন্ত অবস্থায় তার অজু ছুটে গেছে অথচ সে তা টেরই পায়নি। (আলকাউকাবুদ্দুররী: ১/৫০)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যম অজুর ব্যাপারে সর্বাধিক সতর্কতা অবলম্বনের তাওফিক দান করুন। আমিন।