images

ইসলাম

নামাজের মধ্যেও মানুষ শিরক করে যেভাবে

মো. মারুফুল আলম

২৮ মে ২০২৩, ০৩:৫৪ পিএম

প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া ফরজ। কিন্তু যথাযথভাবে নামাজ না পড়লে নামাজ কবুল হয় না। আবার আল্লাহর সন্তুষ্টি বাদ দিয়ে মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্য থাকলেও নামাজ কবুল হয় না। যেসব নামাজির অন্তরে মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্য থাকে, পবিত্র কোরআনে তাদেরকে মুনাফিক হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই মুনাফিকরা আল্লাহকে ধোঁকা দেয়, আর তিনিও তাদের ধোঁকায় ফেলেন। ওরা যখন নামাজে দাঁড়ায়, তখন অলসভাবে দাঁড়ায়—লোক দেখানোর উদ্দেশে। আর তারা আল্লাহকে অল্পই স্মরণ করে।’ (সুরা নিসা: ১৪২)

মানুষের প্রশংসা, সামাজিক প্রভাব ও কারো দৃষ্টি আকর্ষণ ইত্যাদির মোহে ইবাদত করাকে ইসলামি পরিভাষায় ‘রিয়া’ বা প্রদর্শনপ্রিয়তা বলা হয়। এই প্রদর্শনপ্রিয়তাকে সামনে রেখে মানুষ যেভাবে নামাজে শরিক হতে পারে, একইভাবে নামাজের মধ্যেও এই প্রদর্শনপ্রিয়তা জেগে ওঠতে পারে। যেমন কাউকে দেখানোর উদ্দেশ্যে হঠাৎ সুন্দরভাবে নামাজ পড়তে শুরু করা, কেরাত সুন্দরভাবে তেলাওয়াত করা বা রুকু সেজদা ধীরেসুস্থে আদায় করা।

এটি শিরক। হাদিসে এ প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘..আমি কি তোমাদেরকে এমন বস্তু সম্পর্কে সংবাদ দেবো, যা তোমাদের জন্য দাজ্জালের চেয়েও অধিক ভয়ঙ্কর। (বর্ণনাকারী বলেন) আমরা বললাম, হ্যাঁ, অবশ্যই। তিনি (স.) বললেন, গোপন শিরক। যেমন, কোনো ব্যক্তি নামাজ পড়ছিলো, অতঃপর কেউ তাকে দেখছে বলে সে নামাজকে খুব সুন্দর করে পড়তে শুরু করল।’ (ইবনু মাজাহ: ৪২৭৯; আহমদ: ৩/৩০; হাকিম: ৪/৩২৯)

আরও পড়ুন: ছোট শিরক সবচেয়ে ভয়ঙ্কর

প্রিয়নবী (স.) উম্মতের এধরণের শিরকের ব্যাপারে ভীত থাকতেন। কারণ মুমিনের ইবাদত ধ্বংস করে তাকে জাহান্নামি বানানোর অন্যতম ফাঁদ এই ‘রিয়া’। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘আমি তোমাদের ব্যাপারে ছোট শিরক নিয়ে যত ভয় পাচ্ছি, অন্য কোনো ব্যাপারে এত ভীত নই।’ সাহাবিরা বলেন, হে আল্লাহর রাসুল, ছোট শিরক কী? তিনি বলেন, রিয়া বা প্রদর্শনপ্রিয়তা। মহান আল্লাহ কেয়ামতের দিন বান্দার আমলের প্রতিদান দেওয়ার সময় বলবেন, ‘তোমরা পৃথিবীতে যাদের দেখানোর জন্য আমল করতে তাদের কাছে যাও। তাদের কাছে দেখো তোমাদের কোনো প্রতিদান আছে কি না?’ (মুসনাদে আহমদ: ২২৫২৮)

আবু উমামা বাহেলী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘এক ব্যক্তি রাসুল (স.)-এর নিকট এসে বললো, হে আল্লাহর রাসুল! অমুক ব্যক্তি যুদ্ধ করছে সওয়াব ও সুনামের জন্য। এমতাবস্থায় সে পুণ্য পাবে কি? রাসূল (স.) বললেন: সে কিছুই পাবে না। লোকটি রাসুল (স.)-কে এ কথাটি তিনবার জিজ্ঞেস করলো। আর রাসুল (স.) প্রতিবারই তাকে বললেন, সে কিছুই পাবে না। অতঃপর রাসুল (স.) বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা এমন আমলই গ্রহণ করে থাকেন, যা হবে একেবারেই নিষ্কলুষ এবং যা শুধু তার জন্য নিবেদিত”। (নাসায়ি: ৩১৪০; বায়হাকি: ৪৩৪৮)

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা লোক দেখানো ইবাদত থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়ে বলেন,‘..যে ব্যক্তি তার রবের সঙ্গে সাক্ষাতের আশা রাখে, সে যেন সৎ কাজ করে এবং তার রবের ইবাদতে কাউকে অংশীদার না করে।’ (সুরা কাহাফ: ১১০)

আরও পড়ুন: মসজিদে যেসব ভুল করা যাবে না

হাদিসে রিয়াকে শিরকে আসগর বা ছোট শিরক এবং শিরকে খাফি বা লুকায়িত শিরক বলা হয়েছে। এমন শিরকে লিপ্ত ব্যক্তি ইসলামের গণ্ডি থেকে সম্পূর্ণরূপে বের হয়ে যায় না বটে, তবে তা কবিরা গুনাহ তথা মহাপাপ অপেক্ষা জঘন্যতম। আল্লাহ তাআলা বলেন—فَلاَ تَجْعَلُوْا لِلهِ أَنْدَادًا وَّأَنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ ‘সুতরাং তোমরা আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কাউকে শরিক করো না। অথচ তোমরা এ সম্পর্কে সম্যক অবগত রয়েছো।’ (সুরা বাকারা: ২২)

উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) বলেন— الْأَنْدَادُ هُوَ الشِّرْكُ أَخْفَى مِنْ دَبِيْبِ النَّمْلِ عَلَى صَفَاةٍ سَوْدَاءَ فِيْ ظُلْمَةِ اللَّيْلِ، وَهُوَ أَنْ تَقُوْلَ: وَاللهِ وَحَيَاتِكَ يَا فُلاَنُ!! وَحَيَاتِيْ، وَتَقُوْلَ: لَـوْلاَ كَلْبَةٌ هَذِهِ لَأَتَانَا اللُّصُوْصُ، وَلَوْلاَ الْبَطُّ فِيْ الدَّارِ لَأَتَى اللُّصُوْصُ، وَقَوْلُ الرَّجُلِ لِصَاحِبِهِ: مَا شَاءَ اللهُ وَشِئْتَ، وَقَوْلُ الرَّجُلِ: لَوْلاَ اللهُ وَفُلاَنٌ، لاَ تَجْعَلْ فِيْهَا فُلاَنًا، هَذَا كُلُّهُ بِهِ شِرْكٌ

“আনদাদ বলতে এখানে শিরককে বোঝানো হচ্ছে, যা অন্ধকার রাতে কালো পাথরে পিঁপড়ার চলার চেয়েও সূক্ষ্ম। যা টের পাওয়া কঠিন। যেমন এ কথা বলা যে—হে অমুক! আল্লাহ তাআলা এবং তোমার-আমার জীবনের কসম! অথবা এ কথা বলা যে, যদি কুকুরটা না হতো, চোর অবশ্যই আসত। যদি ঘরে হাঁসগুলো না থাকতো তাহলে অবশ্যই চোর ঢুকত। অথবা সঙ্গীকে এ কথা বলা যে, আল্লাহ তাআলা এবং তুমি না চাইলে কাজটা হতো না, অথবা আল্লাহ তাআলা এবং অমুক না থাকলে কাজটা হতো না। কারণ, এসব কথা শিরকের অন্তর্ভুক্ত।”

আরও পড়ুন: ‘নামাজ চুরি’ নিয়ে যা বলেছেন মহানবী (স.)

আল্লাহ তাআলা বলেন— قُلْ إِنَّمَآ أَنَا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يُوْحَى إِلَيَّ أَنَّمَآ إِلاَهُكُمْ إِلاَهٌ وَّاحِدٌ، فَمَنْ كَانَ يَرْجُوْ لِقَآءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا، وَلاَ يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا ‘আপনি বলে দিন, নিশ্চয়ই আমি তো তোমাদের মতোই একজন মানুষ। তবে আমার প্রতি এ প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের মাবুদই একমাত্র মাবুদ। সুতরাং যে ব্যক্তি তার প্রভুর সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে শরিক না করে।’ (সুরা কাহফ: ১১০)

উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহ.) বলেন— كَمَا أَنَّ اللهَ وَاحِدٌ، لاَ إِلاَهَ سِوَاهُ، فَكَذَلِكَ يَنْبَغِيْ أَنْ تَكُوْنَ الْعِبَادَةُ لَهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ، فَكَمَا تَفَرَّدَ بِالْإِلاَهِيَّةِ يَجِبُ أَنْ يُفْرَدَ بِالْعُبُوْدِيَّةِ، فَالْعَمَلُ الصَّالِحُ هُوَ الْـخَالِصُ مِنَ الرِّيَاءِ الْـمُقَيَّدُ بِالسُّنَّةِ ‘যখন আল্লাহ তাআলা একক। তিনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই। তখন সকল ইবাদত একমাত্র তাঁরই জন্য হতে হবে। অতএব নেক আমল বলতে রাসুল (স.)-এর আদর্শসম্মত রিয়ামুক্ত ইবাদতকেই বুঝানো হয়। মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্য থাকলে তা নেকআমল বলে গণ্য হবে না।’

প্রিয়নবী (স.) শিরক থেকে আত্মরক্ষার জন্য দোয়া শিখিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘পিপড়ার নিঃশব্দ গতির মতোই শিরক তোমাদের মধ্যে গোপনে অনুপ্রবেশ করে। তিনি আরো বললেন, ‘আমি তোমাদের একটি উপায় বলে দিচ্ছি, যা করলে তোমরা বড় শিরক ও ছোট শিরক থেকে নিরাপদ থাকতে পারবে। তোমরা প্রতিদিন তিনবার পড়বে—اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ أَنْ أُشْرِكَ بِكَ شَيْئًا وَأَنَا أَعْلَمُ وَأَسْتَغْفِرُكَ لِمَا لاَ أَعْلَمُ 

উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা আন উশরিকাবিকা শাইয়ান ওয়া আনা আঅলামু ওয়া আসতাগফিরুকা লিমা লা আঅলামু। অর্থ: হে আল্লাহ! আমি তোমার সঙ্গে কাউকে শরিক করা থেকে আশ্রয় চাই। জানা-অজানা (শিরক-গুনাহ) থেকেও ক্ষমা চাই।’ (আদাবুল মুফরাদ: ৭২১)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে গোপন শিরক বোঝার তাওফিক দান করুন এবং তা থেকে হেফাজত করুন। আমিন।