শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

ছোট শিরক সবচেয়ে ভয়ঙ্কর

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৪:৩৮ পিএম

শেয়ার করুন:

ছোট শিরক সবচেয়ে ভয়ঙ্কর

মহানবী (স.) তাঁর উম্মতের জন্য সবসময় দোয়া করতেন। তিনি উম্মতের এমন কিছু শিরকের আশঙ্কায় ভীত থাকতেন, যা বৈধ ভেবে করা হবে। আর সেই ছোট শিরকগুলো একসময় বড় শিরকে রূপান্তরিত হবে। ছোট শিরকের মধ্যে যে বিষয়টি প্রিয়নবী (স.) গুরুত্বসহকারে উল্লেখ করেছেন, তা হলো ‘রিয়া’ বা লোক দেখানো আমল। মুমিনের ইবাদত ধ্বংস করে তাকে জাহান্নামি বানানোর জন্য শয়তানের অন্যতম ফাঁদ এই ‘রিয়া’।

মাহমুদ ইবনে লাবিদ (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন—


বিজ্ঞাপন


إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ الشِّرْكُ الأَصْغَرُ قَالُوا وَمَا الشِّرْكُ الأَصْغَرُ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ الرِّيَاءُ يَقُولُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِذَا جُزِيَ النَّاسُ بِأَعْمَالِهِمْ اذْهَبُوا إِلَى الَّذِينَ كُنْتُمْ تُرَاءُونَ فِي الدُّنْيَا فَانْظُرُوا هَلْ تَجِدُونَ عِنْدَهُمْ جَزَاءً

“আমি যে বিষয়টি তোমাদের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি ভয় পাই, তা হলো শিরকে আসগর (ছোট শিরক)। সাহাবিরা প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! শিরকে আসগর কী? তিনি বলেন, রিয়া বা লোক দেখানো আমল। কেয়ামতের দিন যখন মানুষকে তাদের কর্মের প্রতিফল দেওয়া হবে, তখন মহান আল্লাহ তাদেরকে বলবেন, তোমরা যাদের দেখাতে তাদের কাছে যাও, দেখো তাদের কাছে তোমাদের পুরস্কার পাও কি না!’’ (আহমদ, আল-মুসনাদ ৫/৪২৮-৪২৯; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/১০২। হাদিসের মান- সহিহ)

আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণনা করেন—

خَرَجَ عَلَيْنَا رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم، وَنَحْنُ نَتَذَاكَرُ الْـمَسِيْحَ الدَّجَّالَ، فَقَالَ: أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِمَا هُوَ أَخْوَفُ عَلَيْكُمْ عِنْدِيْ مِنَ الْـمَسِيْحِ الدَّجَّالِ؟ قُلْنَا: بَلَى، قَالَ: الشِّـرْكُ الْـخَفِيُّ؛ أَنْ يَقُوْمَ الرَّجُلُ يُصَلِّيْ، فَيُزَيِّنُ صَلاَتَهُ لِمَا يَرَى مِنْ نَظَرِ الرَّجُلِ

“রাসুল (স.) আমাদের নিকট আসলেন যখন আমরা দাজ্জাল সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম। তিনি বললেন, আমি কি তোমাদেরকে এমন বস্তু সম্পর্কে সংবাদ দেবো, যা তোমাদের জন্য দাজ্জালের চেয়েও অধিক ভয়ঙ্কর। আমরা বললাম, হ্যাঁ, অবশ্যই। তিনি বললেন, গোপন শিরক। যেমন, কোনো ব্যক্তি নামাজ পড়ছিলো, অতঃপর কেউ তাকে দেখছে বলে সে নামাজকে খুব সুন্দর করে পড়তে শুরু করলো”। (ইবনু মাজাহ: ৪২৭৯; আহমদ: ৩/৩০; হাকিম: ৪/৩২৯)

আবু উমামা বাহেলী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন—

جَاءَ رَجُلٌ إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم، فَقَالَ: يَا رَسُوْلَ اللهِ! أَرَأَيْتَ رَجُلًا غَزَا يَلْتَمِسُ الْأَجْرَ وَالذِّكْرَ، مَا لَهُ؟ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ: لاَ شَيْءَ لَهُ، فَأَعَادَهَا عَلَيْهِ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ، يَقُوْلُ لَهُ رَسُوْلُ اللهِصلى الله عليه وسلم : لاَ شَيْءَ لَهُ، ثُمَّ قَالَ: إِنَّ اللهَ لاَ يَقْبَلُ مِنَ الْعَمَلِ إِلاَّ مَا كَانَ لَهُ خَالِصًا، وَابْتُغِيَ بِهِ وَجْهُهُ

“এক ব্যক্তি রাসুল (স.) এর নিকট এসে বললো, হে আল্লাহর রাসুল! অমুক ব্যক্তি যুদ্ধ করছে সওয়াব ও সুনামের জন্য। এমতাবস্থায় সে পুণ্য পাবে কি? রাসূল (স.) বললেন: সে কিছুই পাবে না। লোকটি রাসুল (সা.)-কে এ কথাটি তিনবার জিজ্ঞেস করলো। আর রাসুল (স.) প্রতিবারই তাকে বললেন, সে কিছুই পাবে না। অতঃপর রাসুল (স.) বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা এমন আমলই গ্রহণ করে থাকেন, যা হবে একেবারেই নিষ্কলুষ এবং যা শুধু তার জন্য নিবেদিত”। (নাসায়ি:৩১৪০; বায়হাকি: ৪৩৪৮)

বিভিন্ন হাদিসে রিয়াকে শিরকে আসগর বা ছোট শিরক এবং শিরকে খাফি বা লুকায়িত শিরক বলা হয়েছে। শিরকে আসগর বা ছোট শিরক বলতে এমন কাজ ও কথাকে বুঝানো হয়, যা তাতে লিপ্ত ব্যক্তিকে ইসলামের গণ্ডি থেকে সম্পূর্ণরূপে বের করে দেবে না বটে, তবে তা কবিরা গুনাহ তথা মহাপাপ অপেক্ষা জঘন্যতম।

আল্লাহ তাআলা বলেন—

فَلاَ تَجْعَلُوْا لِلهِ أَنْدَادًا وَّأَنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ

“সুতরাং তোমরা আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কাউকে শরিক করো না। অথচ তোমরা এ সম্পর্কে সম্যক অবগত রয়েছো” (সুরা বাকারা: ২২)

উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) বলেন—

الْأَنْدَادُ هُوَ الشِّرْكُ أَخْفَى مِنْ دَبِيْبِ النَّمْلِ عَلَى صَفَاةٍ سَوْدَاءَ فِيْ ظُلْمَةِ اللَّيْلِ، وَهُوَ أَنْ تَقُوْلَ: وَاللهِ وَحَيَاتِكَ يَا فُلاَنُ!! وَحَيَاتِيْ، وَتَقُوْلَ: لَـوْلاَ كَلْبَةٌ هَذِهِ لَأَتَانَا اللُّصُوْصُ، وَلَوْلاَ الْبَطُّ فِيْ الدَّارِ لَأَتَى اللُّصُوْصُ، وَقَوْلُ الرَّجُلِ لِصَاحِبِهِ: مَا شَاءَ اللهُ وَشِئْتَ، وَقَوْلُ الرَّجُلِ: لَوْلاَ اللهُ وَفُلاَنٌ، لاَ تَجْعَلْ فِيْهَا فُلاَنًا، هَذَا كُلُّهُ بِهِ شِرْكٌ

‘আনদাদ’ বলতে এখানে শিরককে বোঝানো হচ্ছে, যা অন্ধকার রাতে কালো পাথরে পিঁপড়ার চলার চেয়েও সূক্ষ্ম। যা টের পাওয়া কঠিন। যেমন এ কথা বলা যে—হে অমুক! আল্লাহ তাআলা এবং তোমার-আমার জীবনের কসম!

অথবা এ কথা বলা যে, যদি কুকুরটা না হতো, চোর অবশ্যই আসত। যদি ঘরে হাঁসগুলো না থাকতো তাহলে অবশ্যই চোর ঢুকত। অথবা সঙ্গীকে এ কথা বলা যে, আল্লাহ তাআলা এবং তুমি না চাইলে কাজটা হতো না, অথবা আল্লাহ তাআলা এবং অমুক না থাকলে কাজটা হতো না। কারণ, এসব কথা শিরকের অন্তর্ভুক্ত।”

কাউকে দেখানো বা রিয়া, শোনানো বা সুমআহ—এই শির্কগুলো দ্বারা মানুষের প্রশংসা কুড়ানো বোঝায়। কোনো নেক আমল গোপনে করার পর, তা কাউকে জানিয়ে দেয়াও এ শিরকের অন্তর্ভুক্ত।

আল্লাহ তাআলা বলেন—

قُلْ إِنَّمَآ أَنَا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يُوْحَى إِلَيَّ أَنَّمَآ إِلاَهُكُمْ إِلاَهٌ وَّاحِدٌ، فَمَنْ كَانَ يَرْجُوْ لِقَآءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا، وَلاَ يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا

“আপনি বলে দিন, নিশ্চয়ই আমি তো তোমাদের মতোই একজন মানুষ। তবে আমার প্রতি এ প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের মাবুদই একমাত্র মাবুদ। সুতরাং যে ব্যক্তি তার প্রভুর সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে শরিক না করে“। (সুরা কাহফ: ১১০)

উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহ.) বলেন—

كَمَا أَنَّ اللهَ وَاحِدٌ، لاَ إِلاَهَ سِوَاهُ، فَكَذَلِكَ يَنْبَغِيْ أَنْ تَكُوْنَ الْعِبَادَةُ لَهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ، فَكَمَا تَفَرَّدَ بِالْإِلاَهِيَّةِ يَجِبُ أَنْ يُفْرَدَ بِالْعُبُوْدِيَّةِ، فَالْعَمَلُ الصَّالِحُ هُوَ الْـخَالِصُ مِنَ الرِّيَاءِ الْـمُقَيَّدُ بِالسُّنَّةِ

“যখন আল্লাহ্ তাআলা একক। তিনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই। তখন সকল ইবাদত একমাত্র তাঁরই জন্য হতে হবে। অতএব নেক আমল বলতে রাসুল (স.)-এর আদর্শসম্মত রিয়ামুক্ত ইবাদতকেই বুঝানো হয়। মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্য থাকলে তা নেকআমল বলে গণ্য হবে না“।

শিরক থেকে আত্মরক্ষার দোয়া

রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘পিপড়ার নিঃশব্দ গতির মতোই শিরক তোমাদের মধ্যে গোপনে অনুপ্রবেশ করে। তিনি আরো বললেন, ‘আমি তোমাদের একটি উপায় বলে দিচ্ছি, যা করলে তোমরা বড় শিরক ও ছোট শিরক থেকে নিরাপদ থাকতে পারবে। তোমরা প্রতিদিন তিনবার পড়বে—

اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ أَنْ أُشْرِكَ بِكَ شَيْئًا وَأَنَا أَعْلَمُ وَأَسْتَغْفِرُكَ لِمَا لاَ أَعْلَمُ

উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা আন উশরিকাবিকা শাইয়ান ওয়া আনা আঅলামু ওয়া আসতাগফিরুকা লিমা লা আঅলামু।

অর্থ: হে আল্লাহ! আমি তোমার সঙ্গে কাউকে শরিক করা থেকে আশ্রয় চাই। জানা-অজানা (শিরক-গুনাহ) থেকেও ক্ষমা চাই।’ (আদাবুল মুফরাদ: ৭২১)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে গোপন শিরক বোঝার তাওফিক দান করুন এবং তা থেকে হেফাজত করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর