images

ইসলাম

অহংকার পতনের মূল সম্পর্কে হাদিস-কোরআন

ধর্ম ডেস্ক

১০ জানুয়ারি ২০২৩, ০২:০৭ পিএম

অহংকারকে আরবিতে বলা হয় উম্মুল আমরাজ। এর অর্থ- সকল পাপের জননী। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম পাপই হচ্ছে অহংকার। আদম (আ.)-কে সৃষ্টির পর তাকে সেজদা করার জন্য আল্লাহ তাআলা যখন সবাইকে আদেশ করেন, তখন ফেরেশতারা সেজদায় লুটিয়ে পড়লেন কিন্তু ফেরেশতাদের মাঝে বেড়ে ওঠা ইবলিস অস্বীকার করে বসল। সে আগুনের তৈরি বলে অহংকার করল। ফলে তার অধঃপতন হলো। পবিত্র কোরআনের ভাষায়, ‘সে অস্বীকৃতি জানাল এবং অহংকার করল। আর সে ছিল কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সুরা বাকারা: ৩৪)

সে আল্লাহকে যুক্তি দেখিয়েছিল, ‘আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং আদমকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে’ (সুরা আরাফ: ১২)। অতএব ‘আমি কি তাকে সেজদা করব, যাকে আপনি মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন?’ (সুরা ইসরা: ৬১)

এই হলো অহংকারের ইতিহাস। কোরআনে বর্ণিত প্রথম পাপের বর্ণনা। এরপর থেকে শয়তান বিভ্রান্ত করে যাচ্ছে বনি আদমকে। অহংকারের পথ থেকে সে এক ইঞ্চিও সরে আসেনি। মানুষের মধ্যেও যারা অহংকারী, তাদের ভেতরে কিছুদিন এ রোগ লুকিয়ে থাকলেও একসময় তা প্রকাশ পেতে দেখা যায়। তাই অহংকার বিবেচিত হয় সবচেয়ে ভয়ংকর আত্মিক রোগ হিসেবে। 

আরও পড়ুন: ইসলামে ‘গরিবের অহংকার’ বেশি ঘৃণিত কেন

কোনো বিষয়ে নিজেকে বড় মনে করে অন্যকে তুচ্ছ মনে করার নামই অহংকার। শক্তি-সামর্থ্যে, বয়সে, অভিজ্ঞতায় যে ছোট তাকে ছোট মনে করা অহংকার নয়। অহংকার হচ্ছে- সে ছোট বলে তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করা। কাড়ি কাড়ি টাকা যার ব্যাংক একাউন্টে সঞ্চিত, সে অর্থবিত্তে কাউকে ছোট মনে করতেই পারে। এটিও অহংকার নয়। অহংকার হচ্ছে তাকে তাচ্ছিল্য করা, গরিব বলে তাকে হেয় করা। রাসুল (স.) বলেছেন, ‘ওই ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যার অন্তরে কণা পরিমাণ অহংকার রয়েছে। তখন এক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, লোকেরা চায় যে, তাদের পোশাক সুন্দর হোক, জুতা জোড়া সুন্দর হোক। জবাবে তিনি বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ সুন্দর। তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন। অহংকার হলো সত্যকে দম্ভের সঙ্গে পরিত্যাগ করা এবং মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করা।’ (মুসলিম: ৯১)

অহংকারীর স্থান জাহান্নাম
অহংকারী ব্যক্তি জান্নাতে যেতে পারবে না। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে কেয়ামতের দিন তুমি তাদের মুখগুলো কালো দেখতে পাবে. অহংকারীদের আবাসস্থল কি জাহান্নামে নয়? (সুরা যুমার: ৬০)
তাদেরকে ‘বলা হবে- জাহান্নামের দরজা দিয়ে প্রবেশ করো, তোমাদেরকে চিরকাল এখানে থাকতে হবে। অহংকারীদের আবাসস্থল কতই না নিকৃষ্ট!’ (সুরা যুমার: ৭২)

মহানবী (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘তিল পরিমাণ অহংকার যার অন্তরে আছে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না, আর তিল পরিমাণ ঈমান যার অন্তরে আছে সে দোজখে যাবে না।’ (জামে তিরমিজি: ১৯৯৮)

অহংকার আল্লাহর চাঁদর
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘ইজ্জত-সম্মান হচ্ছে আমারই পোশাক এবং গর্ব-অহংকার হচ্ছে আমারই চাদর। তাই যে ব্যক্তি এ দুয়ের কোনোটি নিয়ে টানাটানি করবে, তাকে আমি কঠোর শাস্তি দেবো। (রিয়াজুস সালেহিন: ৬২৩; মুসলিম: ২৬২০; আবু দাউদ: ৪০৯০, ইবনু মাজাহ: ৪১৭৪, আহমদ: ৭৩৩৫)

অহংকারীর অপমানজনক শাস্তি
হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, ‘দাম্ভিক ব্যক্তিদের কেয়ামতের দিন ক্ষুদ্র পিপড়ার ন্যায় মানুষের রূপে সমবেত করা হবে। তাদেরকে চারদিক হতে অপমান ও লাঞ্ছনা ছেয়ে ফেলবে। জাহান্নামের বুলাস’ নামক একটি কারাগারের দিকে তাদেরকে টেনে নেওয়া হবে, আগুন তাদেরকে গ্রাস করবে, জাহান্নামীদের গলিত রক্ত ও পুঁজ তাদেরকে পান করানো হবে।’ (তিরমিজি: ২৪৯২)

আরও পড়ুন: জাহান্নামের খাবার

অহংকারী বিপদ ডেকে আনে
‘কোনো ব্যক্তি অহংকারবশত নিজকে বড় মনে করে লোকজনকে উপেক্ষা করে চলতে থাকে। পরিশেষে অহংকারী ও উদ্ধতদের মধ্যে তার নাম লিখা হয়, তারপর সে অহংকারী ও উদ্ধত লোকদের বিপদে পতিত হয়।’ (রিয়াজুস সালেহিন: ৬২৫)

অহংকারীর অন্তর মোহরাবৃত
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘পৃথিবীতে যারা অন্যায়ভাবে অহংকার প্রকাশ করে তাদেরকে অবশ্যই আমি আমার নিদর্শনাবলী থেকে বিমুখ করে রাখব’ (সুরা আরাফ: ১৪৬)। ফলে হক-বাতিলের পার্থক্য সে করতে পারে না। ইরশাদ হচ্ছে, ‘এভাবে আল্লাহ প্রত্যেক অহংকারী দাপুটে ব্যক্তির অন্তরে মোহর মেরে দেন।’ (সুরা গাফির: ৩৫)

অবিশ্বাসীরা অহংকারী 

‘তোমাদের মাবুদ এক মাবুদ। সুতরাং যারা আখেরাতে ঈমান রাখে না তাদের অন্তর অস্বীকারকারী এবং তারা অহংকারী। স্পষ্ট কথা- তারা যা গোপনে করে তা আল্লাহ জানেন এবং যা প্রকাশ্যে করে তা-ও। নিশ্চয়ই তিনি অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা নাহল: ২২-২৩)

অহংকারীদের সঙ্গে আল্লাহ কথা বলবেন না
কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা অহংকারী ও দাম্ভিকের সঙ্গে কথা বলবেন না, তার দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না, তাকে গুনাহ থেকে পবিত্র করবেন না। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (স.) ইরশাদ করেন, ‘তিন ব্যক্তির সঙ্গে কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা কথা বলবেন না, তাদের গুনাহ থেকেও পবিত্র করবেন না, তাদের দিকে রহমতের দৃষ্টিতেও তাকাবেন না এবং তাদের জন্য আছে কঠিন শাস্তি। তারা হচ্ছে বৃদ্ধ ব্যভিচারী, মিথ্যুক রাষ্ট্রপতি ও দাম্ভিক ফকির।’ (মুসলিম: ১০৭)

আরও পড়ুন: যেসব গুনাহের কারণে আল্লাহ রাগ করেন

অহংকারীদের ওপর আল্লাহর রাগ
অহংকার এত বড় অপরাধ যে কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা বিচারকার্য শুরু করার আগে রাগান্বিত অবস্থায় ঘোষণা করবেন ‘আইনাল মুতাকাববিরুন’ অর্থাৎ দুনিয়াতে যারা অহংকার করে চলতো তারা কোথায়? এরপর তিনি অহংকারীদের পাকড়াও করার নির্দেশ দেবেন। তখন ফেরেশতারা তাদের পাকড়াও করবেন।

আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা আকাশমণ্ডলী গুটিয়ে নেবেন অতঃপর তিনি আকাশমণ্ডলীকে ডান হাতে ধরে বললেন, আমিই বাদশাহ। কোথায় জবরদস্ত লোকেরা, কোথায় অহংকারীরা? এরপর তিনি বাম হাতে সমস্ত জমিন গুটিয়ে নেবেন এবং বললেন, আমিই বাদশাহ। কোথায় জবরদস্ত লোকেরা, কোথায় অহংকারীরা? (সহিহ মুসলিম: ৭২২৮-৬৯৪৪)

দুনিয়ায় অহংকারের শাস্তি
কেউ পছন্দ করে না অহংকারীদের। হয়ত সে তাৎক্ষণিক টের পায় না। এক আরবি গল্পে এর উপমা খুব চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে কেউ যখন নিচে তাকায়, তখন সবকিছুই তার কাছে ছোট ছোট মনে হয়। নিজের দুই চোখ দিয়ে হাজারো মানুষকে সে ছোট করে দেখে। কিন্তু যারা নিচে আছে তারাও তাকে ছোটই দেখে। অর্থাৎ অহংকারী যখন সবাইকে তুচ্ছ মনে করে তখন সেই অহংকারীকেও অন্য সবাই তুচ্ছ মনে করে। একবার বনি ইসরাইলের এক ব্যক্তি গর্ব করলে আল্লাহ তাআলা তাকে কঠিন শাস্তি দেন। রাসুলুল্লাহ (স.)-এর যুগেও এমন একটি ঘটনা ঘটে।

‘একদা এক ব্যক্তি এক জোড়া জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরে (রাস্তা দিয়ে) চলছিল। তা নিয়ে খুব গর্ব বোধ হচ্ছিল তার। তার জমকালো লম্বা চুলগুলো সে খুব যত্নসহকারে আঁচড়ে রেখেছিল। হঠাৎ আল্লাহ তাআলা তাকে ভূমিতে ধসিয়ে দেন এবং সে কেয়ামত পর্যন্ত এভাবেই নিচের দিকে নামতে থাকবে।’ (বুখারি: ৫৭৮৯)

সালামা ইবনে আকওয়া (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, ‘একজন মানুষ সর্বদা অহংকার করতে থাকে, অতঃপর একটি সময় আসে, তার নাম জাব্বারিনদের (অহংকারী জালেম) খাতায় লিপিবদ্ধ করা হয়। তখন তাকে এমন আজাব গ্রাস করে, যা অহংকারীদের গ্রাস করেছিল’। (তিরমিজি: ২০০০, হাদিসটি হাসান)

আরও পড়ুন: জাহান্নামের আগুন থেকে পরিবারকে বাঁচাবেন যেভাবে

এই হাদিসের বাস্তব নমুনা হলো- মানুষ প্রথমেই বড় ধরণের জালেম হয় না। বরং তা হলো চলমান প্রক্রিয়া। এক পর্যায়ে সে জাব্বারিনদের কাতারে অর্থাৎ অহংকারী ফেরাউন, হামান ও কারূনের কাতারে শামিল হয়। 

অহংকারীর পরিণাম বর্ণনায় সালামা ইবনে আকওয়া (রা.) বলেন, ‘একদিন এক লোক রাসুলুল্লাহ (স.)-এর দরবারে বাম হাত দিয়ে খাওয়া শুরু করলে আল্লাহর রাসুল (স.) তাকে বললেন, তুমি ডান হাত দিয়ে খাও। উত্তরে লোকটি বলল, আমি পারছি না। তার কথার প্রেক্ষাপটে রাসুলুল্লাহ (স.) তাকে প্রশ্ন করলেন, তুমি পারবে না? মূলত রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কথা অমান্য করতে তাকে অহংকারই বিরত রাখে। বর্ণনাকারী বলেন, লোকটি আর কখনোই তার হাতকে তার মুখ পর্যন্ত ওঠাতে পারেনি। (সহিহ মুসলিম: ২০২১)

অহংকার করার কারণ
১) জ্ঞানের স্বল্পতা ২) পারিবারিক শিক্ষার অভাব ৩) পদ ও ক্ষমতার অপব্যবহার ৪) হিংসুটে মানসিকতা ৫) ধন- সম্পদ আধিক্য ৬) লোক দেখানো আমল ও ইবাদত ইত্যাদি

নিজের মধ্যে অহংকার আছে কি না যাচাই করুন
১. নিজেকে শ্রেষ্ঠ এবং অন্যকে তুচ্ছ ভাবার বদভ্যাস থাকলে বুঝে নেবেন আপনি নিশ্চিত অহংকারী। ঠিক এই দোষেই অভিশপ্ত হয়েছিল ইবলিস। 
২. সত্যকে অস্বীকার করা। নমরুদ, আবু জাহেল, আবু লাহাব, উতবা, শায়বা, আরও অসংখ্য দাম্ভিক সত্য প্রত্যাখ্যান করেছিল। 
৩. হাঁটাচলায় বড়ত্ব প্রকাশ করা।
৪. অর্থ-সম্পদ ও সৌন্দর্যের কারণে অন্যের প্রতি অন্তরে তুচ্ছভাব উদ্রেক হওয়া। 
৫. দরিদ্র মানুষ ও অধীনস্থদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা।
৬. ভুল স্বীকার না করা এবং নিজের ভুল অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া।
৭. নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবা অহংকারের বড় আলামত।

অহংকার দূর করার উপায়
১) নিজের সৃষ্টি ও অস্তিত্ব নিয়ে ভাবা ২) মৃত্যুর কথা সর্বদা স্মরণ করা ৩) পরকালে জবাবদিহিতার ভয়ে ভীত থাকা ৪) আমার প্রত্যেকটি কাজ আল্লাহ্‌ দেখেন এই ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস রাখা ৫) গরিব ও এতিমের সহযোগিতা করা ৬) অসুস্থকে সেবা প্রদান অথবা সেবা প্রদানে সহযোগিতা করা ৭) দম্ভভরে পৃথিবীতে পদচারণা করা থেকে নিজেকে বিরত রাখা ৮) গোপন ও রিয়ামুক্ত আমলে নিজেকে অভ্যস্ত করা ৯) আল্লাহর ভয়ে গোপনে ক্রন্দন করা, ১০) অন্যের সাথে নম্র আচরণ করা ১১) অন্যের ভুল ক্ষমা করে দেওয়া ১২) অহংকার বশত অন্যের সাথে অসদাচরণ করে ফেললে তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া ১৩) ভুলক্রমে অহংকার প্রকাশ পেলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া ১৪) অহংকার থেকে মুক্তি পেতে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া ১৫) অগ্রগামী হয়ে অন্যের আগেই সালাম দেওয়া ১৬) অহংকারীর পোশাক ও চাল চলন পরিহার করা। ১৭) আল্লাহর কাছে বেশি বেশি তাওবা করা।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে অহংকারমুক্ত জীবন যাপনের তাওফিক দান করুন। আমিন।