ধর্ম ডেস্ক
০২ নভেম্বর ২০২২, ০১:৩৫ পিএম
প্রতিবেশী মানবসমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ইসলামে প্রতিবেশীর অধিকার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো- বর্তমান সমাজে এ বিষয়ে চরম গাফিলতি পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে। পাশের বাড়ির কারো সঙ্গে কোনো কথা হয় না, খোঁজখবর নেওয়া হয় না; বরং বিভিন্নভাবে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া হয়। অথচ ইসলামে প্রতিবেশীর সঙ্গে সদাচরণ ঈমানের সঙ্গে যুক্ত।
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন প্রতিবেশীর সঙ্গে সদাচরণ করে। (সহিহ মুসলিম: ১৮৫) ইসলামে প্রতিবেশীর অধিকারকে পিতামাতা ও আত্মীয়-স্বজনের অধিকারের পাশেই স্থান দেওয়া হয়েছে। নির্দেশ দিয়েছে তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহারের। এতেই বুঝা যায় প্রতিবেশীর হক বিষয়টি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো। কোনো কিছুকে তার সঙ্গে শরিক করো না এবং পিতামাতা, আত্মীয়-স্বজন, এতিম, অভাবগ্রস্ত, নিকট-প্রতিবেশী, দূর-প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির ও তোমাদের দাস-দাসীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করো। নিশ্চয় আল্লাহ দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা নিসা: ৩৬)
এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, জিব্রাইল (আ.) আমাকে প্রতিবেশীর হকের ব্যাপারে এত বেশি তাকিদ করেছেন যে, আমার কাছে মনে হয়েছে প্রতিবেশীকে মিরাসের অংশীদার বানিয়ে দেওয়া হবে। (বুখারি: ৬০১৪; মুসলিম ২৫২৪) আরও পড়ুন: গোপনে দান করার সওয়াব
প্রতিবেশীর সঙ্গে সদাচারের পাশাপাশি অভাব-অনটনে পাশে থাকাও মুমিনের কর্তব্য। সংকটের সময় এ দায়িত্ব বেড়ে যায়। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ওই ব্যক্তি মুমিন নয়, যে পেট পুরে খায় অথচ তার পাশের প্রতিবেশী না খেয়ে থাকে। (আদাবুল মুফরাদ: ১১২)
প্রতিবেশীর হক আদায় করা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। হাদিসে এসেছে- ঘরে ভালো রান্না করলে, সে খাবারেও প্রতিবেশীর হক রয়েছে। আবু জার (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (স.) বলেন, ‘তুমি তরকারি রান্না করলে তাতে ঝোল বেশি দিয়ো এবং তোমার প্রতিবেশীদের পর্যন্ত তা পৌঁছে দিয়ো।’ (ইবনে মাজাহ: ৩৩৬২) সাহাবায়ে কেরামগণ সামাজিক জীবনে নবীজির এই শিক্ষা বাস্তবায়ন করেছেন। আমাদের অবশ্যই সেই শিক্ষা সমাজে বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রতিবেশী যদি অসহায়-দরিদ্র হয়, তাহলে অবশ্যই অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করতে হবে। পবিত্র কোরআনে ‘সাকার’ নামের জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হিসেবে দরিদ্রদের না খাওয়ানোকে অন্যতম গণ্য করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, (জাহান্নামিকে জিজ্ঞেস করা হবে) ‘কোন বিষয়টি তোমাদের ‘সাকার’ নামের জাহান্নামে ঠেলে দিয়েছে? (তারা বলবে) ‘আমরা নামাজ পড়তাম না এবং দরিদ্রকে খানা খাওয়াতাম না।’ (সুরা মুদ্দাসসির: ৪২-৪৪)
আরও পড়ুন: মুনাফিকের কাছে ভারী দুই নামাজ
রাসুলুল্লাহ (স.) প্রতিবেশীকে হাদিয়া দিতে নারীদের সংকোচ করতে নিষেধ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুসলিম নারীগণ! তোমাদের কেউ যেন প্রতিবেশীকে হাদিয়া দিতে সংকোচবোধ না করে। যদিও তা বকরির খুরের মতো নগণ্য বস্তুও হয়। (বুখারি: ৬০১৭) প্রতিবেশীর দৃষ্টিতে ভালো মানুষ মানে সত্যিকার অর্থেই ভালো মানুষ। আর সত্যিকার ভালো মানুষ হওয়ার জন্য হৃদ্যতা বাড়াতে হবে। সেই হৃদ্যতা বাড়ানোর উপায় হিসেবে হাদিয়া আদান-প্রদান করতে উৎসাহিত করা হয়েছে হাদিসে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা হাদিয়া আদান-প্রদান করো। এতে তোমাদের মধ্যে হৃদ্যতা সৃষ্টি হবে।’ (বুখারি: ৫৯৪)
রাসুলুল্লাহ (স.) আরও বলেছেন, ... যে স্বীয় প্রতিবেশীর দৃষ্টিতে ভালো সেই সর্বোত্তম প্রতিবেশী। (সহিহ ইবনে খুজাইমা: ২৫৩৯; শুআবুল ঈমান বায়হাকি: ৯৫৪১; মুসনাদে আহমদ: ৬৫৬৬)
প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া বড় গুনাহের কাজ। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, কেয়ামতের দিন প্রথম বাদী-বিবাদী হবে দুই প্রতিবেশী। (মুসনাদে আহমদ: ১৭৩৭২; আল-মুজামুল কাবির, তাবারানি: ৮৩৬) আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়, আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়, আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়! সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল সে কে? রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, যে ব্যক্তির অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়। (সহিহ বুখারি: ৬০১৬)
প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়ার গুনাহ ১০ গুণ বেশি। হাদিসে এসেছে, ‘১০ বাড়িতে চুরি করা যত বড় অন্যায় প্রতিবেশীর বাড়িতে চুরি করা এর চেয়েও বড় অন্যায়। (মুসনাদে আহমদ: ২৩৮৫৪; আদাবুল মুফরাদ: ১০৩) আরও পড়ুন: সবচেয়ে বড় চুরি হয় নামাজে
সুতরাং প্রতিবেশীর সঙ্গে সুখে-দুখে সুসম্পর্ক রাখতে হবে। বিশেষ করে সংকটপূর্ণ সময়ে অবশ্যই প্রতিবেশীর দিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে। তারা কি ঠিকমতো খাচ্ছে, পরছে, অসুস্থতায় আছে—সবকিছু খেয়াল রাখতে হবে এবং সাহায্য-সহযোগিতার মাধ্যমে পাশে থাকতে হবে। এটাই ইসলামের শিক্ষা।
বিশ্বব্যাপী চলমান এ সংকটপূর্ণ সময়ে আমাদের সবার উচিত প্রতিবেশীদের প্রতি ভালোবাসা, সহমর্মিতা রাখা। সর্বোপরি তাদের অভাব-অনটনে সাহায্য-সহায়তার হাতকে প্রসারিত করা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সেই তাওফিক দান করুন। আমিন।