ধর্ম ডেস্ক
০৪ আগস্ট ২০২২, ০৬:১৯ পিএম
ফিতনা শব্দের অর্থ নৈরাজ্য, অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, অন্তর্ঘাত, চক্রান্ত, বিপর্যয় প্রভৃতি। ফিতনা শব্দের আরেক অর্থ পরীক্ষা করা। এই পরীক্ষা প্রচণ্ড আকর্ষণীয় কোনো কিছু (যেমন সম্পদ, সন্তান, নারী) দিয়ে হতে পারে, আবার হতে পারে প্রচণ্ড অপছন্দনীয় কিছু দিয়ে (যেমন অকস্মাৎ বিপদ, গৃহযুদ্ধ, বিশৃঙ্খলা, অত্যাচারী শাসক ইত্যাদি)। ইবনুল আরাবি ফিতনার সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে—
ফিতনা মানে পরীক্ষা, ফিতনা মানে দুর্যোগ, ফিতনা মানে সম্পদ, ফিতনা মানে সন্তান, ফিতনা মানে কুফর, ফিতনা মানে মতপার্থক্য, ফিতনা মানে আগুনে জ্বলা। (লিসান আল আরব-ইবনে মঞ্জুর)। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ফিতনার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহর কাছে ফিতনা হত্যা অপেক্ষা মারাত্মক। (সুরা বাকারা: ২১৭)
কেয়ামতের আগে নানারকম ফিতনার আবির্ভাব ঘটবে। প্রিয়নবী (স.) স্বীয় উম্মতদের ফিতনার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। উসামা ইবনে জায়িদ (রা.) বলেন, ‘একবার নবী (স.) মদিনার টিলাগুলোর একটির ওপর উঠে বলেন, আমি যা দেখি তোমরা কি তা দেখতে পাও? জবাবে সাহাবায়ে কিরাম বলেন, না। তখন নবী (স.) বললেন, অবশ্যই আমি দেখতে পাচ্ছি, তোমাদের ঘরগুলোর ফাঁকে ফাঁকে ফিতনা (পাপ ও বিশৃঙ্খলা) বৃষ্টির মতো পতিত হচ্ছে।’ (সহিহ বুখারি: ৭০৬০)
উল্লিখিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) মুসলিম উম্মাহকে অনাগত দিনের বিশৃঙ্খলা ও পাপাচার সম্পর্কে সতর্ক করেছেন, যেন তারা পাপের স্রোতে গা ভাসিয়ে না দিয়ে আত্মরক্ষা করতে পারে। হাদিসের বর্ণনায় ফিতনা দেখার ব্যাখ্যা হচ্ছে—নবীজি (স.) বৃষ্টির মতো ফিতনা ছড়িয়ে পড়তে দেখেছেন। ভবিষ্যতের বিষয় এবং অদৃশ্য বিষয় দেখতে পারা নবী-রাসুল (আ.)-দের অন্যতম মুজিযা। জগতের এমন বহু রহস্য ও ঘটনা আল্লাহ তাঁর নবী (স.)-এর সামনে উন্মোচিত করেছেন, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। যেমন নবী (স.) বলেছেন, ‘আমি আমর ইবনে লুহাইকে তার বহির্গত নাড়িভুঁড়ি নিয়ে জাহান্নামের আগুনে চলাফেরা করতে দেখেছি। সেই প্রথম ব্যক্তি যে দেবতার নামে পশু উৎসর্গ করার প্রথা প্রচলন করে।’ (সহিহ বুখারি: ৩৫২১)
আরও পড়ুন: দাজ্জালের কঠিন ফিতনা থেকে বাঁচার উপায়
ফিতনা থেকে আত্মরক্ষা আবশ্যক
ফিতনা থেকে আত্মরক্ষা করা প্রত্যেক মুমিনের দায়িত্ব। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা এমন ফিতনাকে ভয় করো, যা বিশেষ করে তোমাদের মধ্যে যারা অবিচারকারী কেবল তাদেরই কষ্ট দেবে না। জেনে রেখো, নিশ্চয়ই আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।’ (সুরা আনফাল: ২৫)
বর্তমান ইন্টারনেটের যুগে দেখা যাচ্ছে, সবকিছু সহজলভ্য হওয়ায় দ্রুতগতিতে পাপাচার ছড়িয়ে পড়ছে। এ থেকে মুসলিম মাত্রই বেঁচে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। তা না হলে ফেতনার সাগরে হাবুডুবু খেয়ে দুনিয়া-আখেরাত দুই জাহানই ধ্বংস হবে। নবীজি (স.) হুঁশিয়ার করে বলেন, অচিরেই এমন ফিতনার আত্মপ্রকাশ হবে, বসে থাকা ব্যক্তি দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি হতে উত্তম হবে। আর দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি চলমান ব্যক্তি হতে উত্তম হবে। আর চলমান ব্যক্তি দ্রুতগামী ব্যক্তি হতে ভালো থাকবে। (মুসলিম: ৭১৩৯)।
ফিতনার সময় করণীয়
আল্লাহর রাসুল (স.) বলেছেন, ‘ফিতনার সময় ঈমানদারের করণীয় হলো- সর্বদা চুপ থাকা। এত পরিমাণ চুপ থাকা, যার কারণে কোনো ফিতনা তাকে আকৃষ্ট করতে না পারে। (আল ফিতান: ৭৩৫)
ফিতনা থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর কাছে অধিক পরিমাণে দোয়া করা। হজরত হুজাইফা (রা.) বলেছেন, আল্লাহর রাসুল (স.) বলেছেন, মানুষের ওপর এমন একটা যুগ আসবে যখন কেউ রক্ষা পাবে না, সে ছাড়া যে দোয়া করছে, ডুবন্ত মানুষের দোয়ার মতো। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা: ৩৬৪৪৭)। অর্থাৎ নদীতে ডুবে যাওয়া ব্যক্তি যেভাবে বাঁচার আকুতি নিয়ে দোয়া করতে থাকে, সেভাবে দোয়া করা। পাশাপাশি নিজের নজরের হেফাজত করা। ফিতনার বিষয় সম্পর্কে জানাতেও বের না হওয়া। ফিতনার দিকে দৃষ্টি বা উঁকি না দেওয়া এবং ফিতনার দিকে না যাওয়া।
রাসুল (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ফিতনার দিকে তাকাবে, ফিতনা তাকে ঘিরে ধরবে। তখন কেউ যদি কোনো আশ্রয়ের জায়গা কিংবা নিরাপদ জায়গা পায়, তাহলে সে যেন আত্মরক্ষা করে।’(বুখারি: ৭০৮১)
আরও পড়ুন: কঠিন ফিতনার দিনে ঈমান রক্ষার আমল
সবসময় সৎ কাজ আঁকড়ে ধরা, অসৎ কাজ পরিহার করা, আল্লাহভীরু মুত্তাকিদের সঙ্গে চলাফেরা করা এবং পাপাচারীদের সঙ্গ ত্যাগ করা। রাসুল (স.) বলেছেন, ‘যখন ফিতনা তীব্র আকার ধারণ করবে তখন তোমরা সৎ কাজকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরবে এবং অসৎ কাজ হতে বিরত থাকবে। তোমাদের মাঝে বিশেষ লোক যারা রয়েছে তাদের প্রতি মনোনিবেশ করবে এবং সর্বসাধারণকে এড়িয়ে চলবে।’(আল ফিতান: ৭২১)
ফিতনার যুগে জান্নাতি হওয়ার উপায়
ফিতনার যুগে কেউ যদি জান্নাতের উপযুক্ত হতে চায়, তার জন্য বিশেষ তিনটা উপায় রয়েছে। হজরত উকবা ইবনে আমির (রা.) বলেন, একদা আমি রাসুলুল্লাহর (স.) সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম এবং বললাম, সেসময় নাজাতের উপায় কী? তিনি বললেন, নিজের জিহ্বা আয়ত্তে রাখবে, নিজের ঘরে পড়ে থাকবে এবং নিজের পাপের জন্য রোদন করবে। (মেশকাত: ৪৮৩৭)
ফেতনা থেকে বাঁচার দোয়া
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) উল্লিখিত দোয়াটি পাঠ করতেন- اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ وَمِنْ عَذَابِ النَّارِ وَمِنْ فِتْنَةِ الْمَحْيَا وَالْمَمَاتِ وَمِنْ فِتْنَةِ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিন আজাবিল কাবরি, ওয়া মিন আজাবিন্না-রি, ওয়া মিন ফিতনাতিল মাহইয়া ওয়াল মামাতি, ওয়া মিন ফিতনাতিল মাসিহিদ্দাজ্জাল। অর্থ: হে আল্লাহ আমি আপনার কাছে কবরের শাস্তি, জাহান্নামের শাস্তি, জীবন ও মৃত্যুর ফিতনা ও দাজ্জালের ফিতনা থেকে আশ্রয় চাই। (বুখারি: ১৩৭৭)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে উপরোক্ত দোয়া ও করণীয় যথাযথ আদায় করার তাওফিক দান করু। বর্তমান ও ভবিষ্যতের নানা ফেতনা থেকে তিনি আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন। আমিন।