ফিতনা শব্দের অর্থ নৈরাজ্য, অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, অন্তর্ঘাত, চক্রান্ত, বিপর্যয়, পরীক্ষা প্রভৃতি। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ফিতনার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহর কাছে ফিতনা হত্যা অপেক্ষা মারাত্মক। (সুরা বাকারা: ২১৭)
কেয়ামতের আগে নানারকম ফিতনার আবির্ভাব ঘটবে। প্রিয়নবী (স.) স্বীয় উম্মতদের ফিতনার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। হাদিস থেকে জানা যায়—
বিজ্ঞাপন
পৃথিবীর শেষ সময়ে উম্মতের মাঝে ছড়িয়ে পড়বে—এমন ফিতনাগেুলোর মধ্যে রয়েছে, ইলম উঠিয়ে নেওয়া হবে এবং মুর্খতা বৃদ্ধি পাবে, হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাবে, বড় বড় দালান নির্মিত হবে, লোকেরা নামাজে ডাকাতি করবে, আমানতের খেয়ানত, সুদের লেনদেন, মিথ্যাকে হালাল মনে করা, দ্বীন বিক্রি করে দুনিয়া অর্জন, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে খারাপ আচরণ, ইনসাফ উঠে যাওয়া, রেশমি কাপড়ের ব্যবহার, অপবাদ বৃদ্ধি, বৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও পরিবেশ উষ্ণ থাকা, নীচ লোকের সম্পদশালী হওয়া ও বিলাসী জীবনযাপন করা, ভদ্রলোকেরা নিগৃহীত হবে।
নেতৃবর্গ জালেম ও অত্যাচারী হবে, আলেম ও কোরআন তেলাওয়াতকারীও বদকার ও ফাসেক হবে, রুপার মূল্য বেড়ে যাওয়া, মসজিদকে কারুকার্যময় করা, ব্যাপকভাবে মদ পান, শরিয়তের দণ্ডবিধিকে অকার্যকর করা হবে।
দাসী স্বীয় মুনিবকে জন্ম দিবে; অর্থাৎ সন্তান মায়ের ওপর কর্তৃত্ব করবে এবং এরূপ ব্যবহার করবে- যেরূপ মুনিব দাসীর সঙ্গে ব্যবহার করে, পুরুষরা মহিলাদের বেশ ও মহিলারা পুরুষদের বেশভূষা ধারণ করবে, দূর থেকে দেখে বোঝা যাবে না- পুরুষ না মহিলা।
গায়রুল্লাহর নামে শপথ করা হবে, শুধু পরিচিত লোকদের সালাম দেওয়া হবে। দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্যে দ্বীনি ইলম শিক্ষা দেওয়া হবে, জাকাতকে জরিমানা মনে করা, সমাজের সবচেয়ে নীচ ও নিকৃষ্ট ব্যক্তিকে নেতা বানানো, মানুষ নিজের পিতার অবাধ্যতা, স্ত্রীর আনুগত্য, অশ্লীল পোষাক পরা স্বাভাবিক বিষয় হবে।
বদকার লোকেরা মসজিদে শোরগোল করবে, গায়িকাদের সম্মান, বাদ্যযন্ত্রের বিশেষ যত্ন, মহিলাদের চুল হবে উটের কুঁজের মতো (অর্থাৎ চুলকে ফুলিয়ে উঁচু করে বাঁধা), পবিত্র কোরআন গানের সুরে তেলাওয়াত, লোকজন বাহনে চড়ে মসজিদে আসবে, উম্মতের প্রথম যুগের লোকদের ওপর বিভিন্ন অপবাদ আরোপ করা হবে, অনিষ্টের ভয়ে মানুষকে সম্মান করা হবে ইত্যাদি।
এসব আলামত নিয়ে একটু চিন্তা করলে দেখা যাবে, বর্তমান সমাজে প্রায় প্রতিটি আলামত বিদ্যমান এবং সমাজে যে অশান্তি বিরাজ করছে তা মূলত ওপরে বর্ণিত বদআমলগুলোরই ফল।
ফিতনা থেকে বাঁচার আমল
ফিতনার সময় নিজেকে আমলে ব্যস্ত রাখা, একান্ত প্রয়োজন ছাড়া বাইরের পরিবেশে না বের হওয়া জরুরি। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, অচিরেই এমন ফিতনার আত্মপ্রকাশ হবে, বসে থাকা ব্যক্তি দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি হতে উত্তম হবে। আর দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি চলমান ব্যক্তি হতে উত্তম হবে। আর চলমান ব্যক্তি দ্রুতগামী ব্যক্তি হতে ভালো থাকবে। (মুসলিম: ৭১৩৯)।
আল্লাহর রাসুল (স.) আরও বলেছেন, ‘ফিতনার সময় ঈমানদারের করণীয় হলো- সর্বদা চুপ থাকা। এত পরিমাণ চুপ থাকা, যার কারণে কোনো ফিতনা তাকে আকৃষ্ট করতে না পারে। (আল ফিতান: ৭৩৫)
ফিতনা থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর কাছে অধিক পরিমাণে দোয়া করা। হজরত হুজাইফা (রা.) বলেছেন, আল্লাহর রাসুল (স.) বলেছেন, মানুষের ওপর এমন একটা যুগ আসবে যখন কেউ রক্ষা পাবে না, সে ছাড়া যে দোয়া করছে, ডুবন্ত মানুষের দোয়ার মতো। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা: ৩৬৪৪৭)। অর্থাৎ নদীতে ডুবে যাওয়া ব্যক্তি যেভাবে বাঁচার আকুতি নিয়ে দোয়া করতে থাকে, সেভাবে দোয়া করা। পাশাপাশি নিজের নজরের হেফাজত করা। ফিতনার বিষয় সম্পর্কে জানাতেও বের না হওয়া। ফিতনার দিকে দৃষ্টি বা উঁকি না দেওয়া এবং ফিতনার দিকে না যাওয়া।
রাসুল (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ফিতনার দিকে তাকাবে, ফিতনা তাকে ঘিরে ধরবে। তখন কেউ যদি কোনো আশ্রয়ের জায়গা কিংবা নিরাপদ জায়গা পায়, তাহলে সে যেন আত্মরক্ষা করে।’(বুখারি: ৭০৮১)
সবসময় সৎ কাজ আঁকড়ে ধরা, অসৎ কাজ পরিহার করা, আল্লাহভীরু মুত্তাকিদের সঙ্গে চলাফেরা করা এবং পাপাচারীদের সঙ্গ ত্যাগ করা। রাসুল (স.) বলেছেন, ‘যখন ফিতনা তীব্র আকার ধারণ করবে তখন তোমরা সৎ কাজকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরবে এবং অসৎ কাজ হতে বিরত থাকবে। তোমাদের মাঝে বিশেষ লোক যারা রয়েছে তাদের প্রতি মনোনিবেশ করবে এবং সর্বসাধারণকে এড়িয়ে চলবে।’(আল ফিতান: ৭২১)
ফিতনার যুগে কেউ যদি জান্নাতের উপযুক্ত হতে চায়, তার জন্য বিশেষ তিনটা উপায় রয়েছে। হজরত উকবা ইবনে আমির (রা.) বলেন, একদা আমি রাসুলুল্লাহর (স.) সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম এবং বললাম, সেসময় নাজাতের উপায় কী? তিনি বললেন, নিজের জিহ্বা আয়ত্তে রাখবে, নিজের ঘরে পড়ে থাকবে এবং নিজের পাপের জন্য রোদন করবে। (মেশকাত: ৪৮৩৭)
সর্বযুগের অন্যতম বড় ফিতনা হচ্ছে নারীর ফিতনা। আল্লাহর রাসুল (স.) বলেছেন, কোনো নারীর ওপর তোমার দৃষ্টি পড়লে তার প্রতি বারবার দৃষ্টিপাত কর না; বরং দৃষ্টি অতিসত্ত্বর ফিরিয়ে নিও। কারণ তোমার জন্য প্রথমবার ক্ষমা, দ্বিতীয়বার নয়। (মুসনাদে আহমদ: ১৩৬৯)।
নবীজি (স.) আরও বলেছেন, পুরুষের জন্য নারী জাতি অপেক্ষা অধিক ক্ষতিকর কোনো ফিতনা আমি রেখে যাইনি। (বুখারি: ৫০৯৬)।
এই উম্মতের আরও একটি বড় ফিতনা হচ্ছে- ধন-সম্পদের ফিতনা, যা আল্লাহর আনুগত্য থেকে মানুষকে গাফেল রাখে। হজরত কাব ইবনে ইয়াজ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে বলতে শুনেছি, প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোনো না কোনো ফিতনা ছিল। আর আমার উম্মতের ফিতনা হলো ধন-সম্পদ। (তিরমিজি: ২৩৩৬)
ফিতনার যুগে গুরুত্বপূর্ণ একটি অবলম্বন হচ্ছে কোরআন-সুন্নাহ আঁকড়ে ধরা, যা মানুষের মধ্যে না থাকলে যেকোনো সময় ফিতনা গ্রাস করে ফেলতে পারে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন—
‘নিশ্চয় আমি তোমাদের মাঝে এমন বস্তু রেখে যাচ্ছি, তোমরা যদি তা আঁকড়ে ধরে থাকো, তবে কখনই পথভ্রষ্ট হবে না। আর তা হলো আল্লাহর কিতাব ও নবীর সুন্নত।’ (আত-তারগিব ওয়াত তাহরিব: ৪০)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কঠিন ফিতনার দিনে ঈমান ঠিক রাখার তাওফিক দান করুন। সহিহ সুন্নাহর ওপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।