দাজ্জালের আগমন কেয়ামতের সবচেয়ে বড় আলমত। বিষয়টি কোরআন-সুন্নাহ সমর্থিত। ইসলামি আকিদারও অংশ এটি। মিথ্যে জান্নাত-জাহান্নামের চিত্র দেখিয়ে সে মুমিনকে বিভ্রান্ত করবে। দাজ্জাল পৃথিবীতে ৪০দিন অবস্থান করবে। প্রথম দিন হবে এক বছরের সমান। দ্বিতীয় দিন এক মাস ও তৃতীয় দিন হবে এক সপ্তাহের সমান। বাকি দিনগুলো হবে দুনিয়ার সাধারণ দিনের মতো। তখন নামাজের সময় নির্ধারণ করতে হবে অনুমান করে (মুসলিম-কিতাবুল ফিতান)।
‘দ্রুতগামী বাতাস বৃষ্টিকে যেভাবে চালিয়ে নেয়, দাজ্জালের চলার গতিও সেরকম হবে’(মুসলিম- কিতাবুল ফিতান)। ‘দাজ্জালের সঙ্গে দুটি নদী প্রবাহিত থাকবে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে একটিতে সুন্দর পরিস্কার পানি দেখা যাবে। অন্যটিতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলবে। যার সঙ্গে দাজ্জালের সাক্ষাৎ হবে, সে যেন দাজ্জালের আগুনে ঝাপ দিয়ে পড়ে এবং সেখান থেকে পান করে। কারণ সেই পানি সুমিষ্ট। তার চোখের উপরে মোটা আবরণ থাকবে। কপালে কাফের লেখা থাকবে। মূর্খ ও শিক্ষিত সকল ঈমানদার লোকই তা পড়তে সক্ষম হবে’ (মুসলিম- কিতাবুল ফিতান)।
দাজ্জাল মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করবে। ‘সে মানুষের কাছে গিয়ে বলবে, আমি যদি তোমার মৃত পিতা-মাতাকে জীবিত করে দেখাই, তাহলে কি তুমি আমাকে প্রভু হিসেবে মানবে? সে বলবে অবশ্যই মানব। এ সুযোগে শয়তান তার পিতা-মাতার আকৃতি ধরে বলবে, হে সন্তান! তুমি তার অনুসরণ কর। সে তোমার প্রতিপালক’ (সহিহ জামে আস্-সগীর: ৭৭৫২)। ‘দাজ্জালের অধিকাংশ অনুসারী হবে ইহুদি এবং মহিলা’(মুসনাদে আহমদ)। ‘ইস্পাহানের সত্তর হাজার ইহুদী দাজ্জালের অনুসরণ করবে। তাদের সবার পরনে থাকবে সেলাই বিহীন চাদর’ (মুসলিম- কিতাবুল ফিতান)।
জড় পদার্থ ও পশুরাও দাজ্জালের ডাকে সাড়া দেবে। ‘দাজ্জাল এক জনসমাজে গিয়ে মানুষকে তার প্রতি ঈমান আনার আহ্বান জানাবে। এতে তারা ঈমান আনবে। দাজ্জাল তাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করার জন্য আকাশকে আদেশ দেবে। তখন আকাশ বৃষ্টি বর্ষণ করবে, জমিন ফসল উৎপন্ন করবে এবং তাদের পশুপাল ও চতুষ্পদ জন্তুগুলো অধিক মোটা-তাজা হবে এবং পূর্বের তুলনায় বেশী দুধ দেবে। অন্য একটি জনসমাজে গিয়ে মানুষকে তার প্রতি ঈমান আনয়নের আহ্বান জানালে লোকেরা প্রত্যাখ্যান করবে। দাজ্জাল তাদের নিকট থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসবে। এতে তারা চরম অভাবে পড়ে যাবে। তাদের ক্ষেত-খামারে ফসলহানি দেখা দেবে। দাজ্জাল পরিত্যক্ত ভূমিকে তার নিচে লুকায়িত গুপ্তধন বের করতে বলবে। গুপ্তধনগুলো বের হয়ে মৌমাছির দলের মতো তার পেছন পেছন চলতে থাকবে’’ (মুসলিম- কিতাবুল ফিতান)
উপরোক্ত আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে, দাজ্জালের ফিতনা হবে খুবই মারাত্মক। সেই ভয়াবহ ফিতনা থেকে বেঁচে থাকা খুব কঠিন হবে। তাই ঈমান বাঁচতে ইসলামি সমাধান জানা মুসলিম উম্মাহর জন্য জরুরি। সমাধানগুলোর মধ্যে একটি স্বীকৃত আমল হচ্ছে সুরা কাহাফ তিলাওয়াত। পবিত্র কোরআনের ১৮তম সুরা এটি। দাজ্জাল যে চার ফেতনার মাধ্যমে মানুষকে ঈমানহারা করবে, সুরা কাহাফে তেমনই চারটি ঘটনার মাধ্যমে সজাগ ও সতর্ক করা হয়েছে। যেমন—
১. গুহাবাসী যুবকদের ঘটনার মাধ্যমে ঈমানের ফিতনা
২. বাগানের মালিকের ঘটনার মাধ্যমে সম্পদের ফিতনা
৩. হজরত মুসা (আ.) ও হজরত খিজির (আ.)-এর ঘটনার মাধ্যমে জ্ঞান ও তথ্যের ফিতনা
৪. বাদশাহ জুলকারনাইনের ঘটনার মাধ্যমে শাসন ক্ষমতার ফিতনা
উপরোক্ত ৪টি ঘটনার শিক্ষা থেকে যে গুণ অর্জন করতে হবে, তার আলোচনাও এসেছে সুরায়। যেমন-
২৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহর দিকে অধিক মনোনিবেশ থাকার গুণ
২৮ নম্বর আয়াতে নেককার মানুষের সান্নিধ্য ও তাদের সঙ্গে থাকার অভ্যাস করতে হবে
৪৫ নম্বর আয়াতে সম্পদের ফেতনায় না পড়তে পার্থিব জীবনের বাস্তবতা উপলব্ধি
৪৭-৪৯ নম্বর আয়াতে পরকালের প্রতি অধিক স্পৃহা জাগানোর গুণ অর্জন
৬৯ নম্বর আয়াতে ধৈর্যধারণের গুণ অর্জন এবং
১১০ নম্বর আয়াতে বেশি নেক আমল করার গুণ অর্জন।
বিজ্ঞাপন
দাজ্জালের ফিতনা থেকে বাঁচার আমল
দাজ্জালের ফিতনা থেকে বাঁচতে সুরা কাহাফের প্রথম ১০ আয়াত মুখস্ত করতে বলা হয়েছে। হাদিসের বর্ণনায়— যে ব্যক্তি সুরা কাহাফের প্রথম দশটি আয়াত মুখস্থ করবে, সে দাজ্জালের ফিতনা হতে হেফাজতে থাকবে (মুসলিম, কিতাবুল ফিতান)। অন্য হাদিসে এসেছে- ‘তোমাদের কাউকে যদি সে পেয়ে বসে, তাহলে তার ওপর সুরা কাহাফের প্রথম থেকে পড়বে।’(মুসলিম)
সুরা কাহাফ পাঠের নির্দেশ সম্ভবত এজন্য হতে পারে যে, মুমিন ব্যক্তি এগুলো গভীরভাবে পাঠ করলে দাজ্জালের বিস্ময়কর ঘটনা দেখে কিছুতেই বিচলিত হবে না। এতে সে হতাশ হয়ে বিভ্রান্তিতেও পড়বে না। তাই, সুরা কাহাফের ৪টি ঘটনার শিক্ষা অনুধাবন করতে হবে, আর সুরা কাহাফে বর্ণিত উক্ত ৬ গুণে নিজেকে গুণান্বিত করতে হবে।
দাজ্জালের ফিতনা থেকে নিজেকে হেফাজত করতে আরও যেসব আমলের কথা হাদিসে এসেছে-
নামাজের তাশাহহুদে দাজ্জালের ফিতনা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি নবী (স.)-কে নামাজের ভিতরে দাজ্জালের ফিতনা থেকে আশ্রয় চাইতে শুনেছি।’ (বুখারি-কিতাবুল ফিতান)
তিনি নামাজের শেষ তাশাহুদে বলতেন—
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ وَمِنْ عَذَابِ النَّارِ وَمِنْ فِتْنَةِ الْمَحْيَا وَالْمَمَاتِ وَمِنْ فِتْنَةِ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নী আউজুবিকা মিন আজাবিল ক্বাবরি, ওয়ামিন আজাবিন্নারি, ওয়ামিন ফিতনাতিল মাহইয়া ওয়া মামাতি ওয়ামিন ফিতনাতিল মাসীহিদ্দাজ্জাল
অর্থ: হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে কবরের আযাব, জাহান্নামের আযাব, জীবন-মরণের ফিতনা এবং মিথ্যুক দাজ্জালের ফিতনা থেকে আশ্রয় চাই’’ (বুখারি: অধ্যায়-কিতাবুল জানায়েয)
এছাড়াও ইসলামকে সঠিকভাবে যারা আঁকড়ে ধরবে, তাদের জন্য দাজ্জালের ফিতনা থেকে নিজেকে বাঁচানো সহজ হবে। একইসঙ্গে তার কাছ থেকে দূরে পালানোর কথাও এসেছে হাদিসে। তার সময়ে জনসমাগম এড়িয়ে চলাটাই নিরাপদ। সম্ভব হলে মক্কা-মদিনায় আশ্রয় নিতে হবে। কারণ, মক্কা-মদিনার প্রতিটি প্রবেশ পথে ফেরেশতারা পাহারা দেবেন।’ (মুসলিম- কিতাবুল ফিতান)
আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের পূর্ববর্তী সময়ে অভিশপ্ত দাজ্জালের ভয়াবহ ফিতনা থেকে মুসলিম উম্মাহকে রক্ষা করুন। উল্লেখিত আমলসমূহ যথাযথ পালন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।