ধর্ম ডেস্ক
২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৪:৩৫ পিএম
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ, বিজ্ঞানসম্মত ও বাস্তবভিত্তিক জীবনব্যবস্থা। আল্লাহ তাআলা মানুষের সাধ্যের বাইরে কোনো বিধান চাপিয়ে দেননি। নামাজ ইসলামের অন্যতম মৌলিক ভিত্তি এবং সুস্থ অবস্থায় তা কোনোভাবেই মাফ নেই। তবে বার্ধক্য বা দুরারোগ্য ব্যাধির কারণে মানুষ যখন চরম শারীরিক অক্ষমতার সম্মুখীন হয়, তখন শরিয়ত তার ইবাদতের পদ্ধতিতে বিশেষ ছাড় ও সহজীকরণ (রুখসত) প্রদান করেছে।
প্রায়ই দেখা যায়, মুমূর্ষু রোগী বা দীর্ঘমেয়াদি শয্যাশায়ী ব্যক্তির নামাজের হুকুম এবং মৃত্যুর পর ছুটে যাওয়া নামাজের ‘ফিদিয়া’ আদায় নিয়ে ওয়ারিশরা বিভ্রান্তিতে পড়েন। বিশেষ করে যখন রোগী এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েন যে, শুয়ে মাথা নেড়ে ইশারার মাধ্যমেও নামাজ আদায় করতে অক্ষম হন, তখন করণীয় কী? এই প্রশ্নের সঠিক ফিকহি সমাধান জানা প্রত্যেক মুসলিমের জন্যই জরুরি।
শরিয়তের মৌলিক নীতি হলো- ‘সাধ্য অনুযায়ী সাধন’। অর্থাৎ রোগী যতটুকু সক্ষম, ততটুকুই তার ওপর ফরজ। সে অনুযায়ী অসুস্থ ব্যক্তির নামাজের বিধান হলো-
১. দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে অক্ষম হলে বসে নামাজ আদায় করবে।
২. বসতেও সক্ষম না হলে শুয়ে মাথা দ্বারা ইশারায় নামাজ পড়বে।
৩. ইশারা করতে হবে মাথা দিয়ে; কেবল চোখের ইশারা বা মনে মনে নিয়ত করলে নামাজ আদায় হবে না।
আরও পড়ুন: জামাতে নামাজে যেসব সাধারণ ভুল এড়িয়ে চলা জরুরি
ফিকহে ইসলামির সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলো- অসুস্থতা যদি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, রোগী মাথা দিয়ে ইশারা করেও রুকু-সেজদা করতে সম্পূর্ণ অক্ষম হয়ে পড়েন, তবে ওই সময় থেকে তার ওপর নামাজের শরঈ বাধ্যবাধকতা আর অবশিষ্ট থাকে না।
যদি কোনো ব্যক্তি এই ‘অক্ষম’ অবস্থায় একদিন-একরাত বা তার চেয়ে বেশি সময় অতিবাহিত করেন এবং ওই অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করেন, তবে ওই সময়ের নামাজের জন্য তার পক্ষ থেকে কোনো কাজা বা কাফফারা (ফিদিয়া) আদায় করতে হবে না। কারণ আল্লাহ তাআলা যে আমলের সক্ষমতা দেননি, সেই আমলের দায়ও তিনি তুলে নিয়েছেন। অর্থাৎ এগুলো তাকে আর আদায় করতে হবে না। (মুআত্তা মুহাম্মদ: ২৭৮; দারাকুতনি: ১৮৮৩)
এই মাসয়ালাটি কিতাবুল আছল (১/১৯০), আল-বাহরুর রায়েক (২/১১৬) এবং ইলাউস সুনান (৭/১৯৮)-সহ হানাফি মাজহাবের প্রায় সকল নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে সমর্থিত।
আরও পড়ুন: নামাজে কোনো আয়াত ছুটে গেলে সাহু সেজদা লাগবে?
অনেক সময় অসুস্থ বা প্রবীণ ব্যক্তি শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতার কারণে নামাজের ধারাবাহিকতা যেমন কেরাত, রুকু ও সেজদা মনে রাখতে পারেন না। এ অবস্থায় যদি পাশ থেকে কেউ তাকে বলে দেন- ‘এখন রুকু করুন, এখন সেজদা করুন’ এবং তিনি সেই নির্দেশনা অনুযায়ী নামাজ আদায় করেন, তবে ওই নামাজ শরিয়তসম্মত ও সহিহ বলে গণ্য হবে।
এ বিষয়ে সাহাবায়ে কেরামের আমলেরও প্রমাণ রয়েছে। মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাতে রুকাইন (রহ.) বর্ণনা করেন- ‘আমি আসমা (রা.)-এর বার্ধক্যের সময় তার কাছে গিয়ে দেখলাম, তিনি নামাজ পড়ছেন আর এক মহিলা পাশে দাঁড়িয়ে তাকে নির্দেশ দিচ্ছেন-‘এখন রুকু করুন, এখন সেজদা করুন’।’ (হাদিস: ৩৩৪৯৭)
সুতরাং অসুস্থ অবস্থায় অন্যের সহযোগিতায় আদায় করা নামাজগুলো শুদ্ধ হিসেবে গণ্য হবে এবং এর জন্য কোনো ফিদিয়া বা কাজার প্রয়োজন নেই।
ইসলাম তার অনুসারীদের ওপর অযৌক্তিক কঠোরতা আরোপ করে না। শয্যাশায়ী ও ইশারায় অক্ষম রোগীর নামাজ শরিয়ত কর্তৃক মাফ হয়ে গেলে তার জন্য ফিদিয়া আদায় করার ধারণা সঠিক নয়। ওয়ারিশদের কর্তব্য হলো- মৃত ব্যক্তির মাগফেরাতের জন্য অধিক পরিমাণে দোয়া, ইস্তেগফার করা এবং সামর্থ্য অনুযায়ী নফল দান-সদকা করা।
ইসলামের সৌন্দর্য এই যে, এটি প্রতিটি মানুষকে তার সামর্থ্য ও সক্ষমতার আলোকে ইবাদতের সুযোগ দেয়। যিনি ইশারা করতেও অক্ষম, তার নামাজের জন্য ফিদিয়া ওয়াজিব হয় না। একইভাবে, অসুস্থাবস্থায় অন্যের সহায়তায় আদায় করা নামাজও শরিয়তসম্মতভাবে গ্রহণযোগ্য। সঠিক ইসলামিক জ্ঞানার্জনের মাধ্যমেই আমরা আমাদের ইবাদতকে ত্রুটিমুক্ত ও আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারি।
দ্রষ্টব্য: এই প্রতিবেদনটি সাধারণ ফিকহি নির্দেশনা হিসেবে প্রণীত। ব্যক্তিগত জটিল পরিস্থিতিতে কোনো যোগ্য আলেম বা ইসলামিক স্কলারের সরাসরি পরামর্শ গ্রহণ করা উত্তম।