ধর্ম ডেস্ক
১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৪৮ পিএম
রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব হলো নাগরিকের জীবন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। যে আইন নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তার কার্যকারিতা প্রশ্নের মুখে পড়ে। ইসলাম মানবজীবনের পবিত্রতা রক্ষায় দিয়েছে কিসাসের মতো ভারসাম্যপূর্ণ ও চূড়ান্ত বিধান, যা অন্যায় রক্তপাতরোধে এক শক্তিশালী রক্ষাকবচ।
ইসলামের দৃষ্টিতে কিসাস প্রতিশোধ নয়; বরং সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা ও জীবন রক্ষার কার্যকর ব্যবস্থা। পবিত্র কোরআনে এর উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে বলা হয়েছে- ‘হে বুদ্ধিমানগণ! তোমাদের জন্য কিসাসের মধ্যেই রয়েছে জীবন (রক্ষার ব্যবস্থা), যাতে তোমরা সংযত হও।’ (সুরা বাকারা: ১৭৯)
এই আয়াত প্রমাণ করে, কিসাসের প্রকৃত লক্ষ্য হলো প্রতিরোধ এবং এর মধ্য দিয়ে অসংখ্য জীবন বাঁচানো।
যে সমাজে কিসাসের বিধান যথাযথভাবে প্রয়োগ হয়েছে, সেখানে হত্যা, সন্ত্রাস ও ক্ষমতার অপব্যবহার নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মানবরচিত কোনো আইন জঘন্য অপরাধ দমনে কিসাসের মতো এতটা কার্যকর হয়নি। এটি সমাজে এমন এক নিরাপত্তাবলয় তৈরি করে, যেখানে রাজনৈতিক প্রভাব বা অর্থবল দিয়ে কেউ সহজে রক্তপাতের সাহস দেখাতে পারে না।
আরও পড়ুন: কিসাসই হত্যাকারীদের সমাধান: শায়খ আহমাদুল্লাহ
ইসলামি বিচারব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সমতা। এখানে ধনী-দরিদ্র, শাসক-শাসিত, সাধারণ নাগরিক ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তি সবার প্রতি আইনের দৃষ্টি এক। কোরআনের ঘোষণা স্পষ্ট- ‘প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত এবং ক্ষতের বদলে সমান ক্ষত।’ (সুরা মায়েদা: ৪৫)
এই সুস্পষ্ট সমতার নীতি সমাজে ন্যায়ের ভিত্তি সুদৃঢ় করে এবং প্রত্যেককে অপরাধ করার আগে গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করে।
ইসলাম মানবিকতা ও ন্যায়বিচারের মধ্যে চমৎকার সমন্বয় ঘটিয়েছে। কিসাসের পাশাপাশি ক্ষমার সুযোগ রেখেছে, যার একমাত্র অধিকারী নিহত ব্যক্তির ওয়ারিসগণ। আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘যদি হত্যাকারীকে তার ভাই (নিহতের ওয়ারিস)-এর পক্ষ থেকে কিছুটা ক্ষমা করা হয়, তবে ন্যায়সংগতভাবে দিয়ত (রক্তপণ) দাবি করা হবে এবং উত্তমরূপে তা পরিশোধ করা হবে। এটি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে এক সহজীকরণ ও রহমত।’ (সুরা বাকারা: ১৭৮)
ওয়ারিস চাইলে কিসাস নিতে পারেন, ক্ষমা করতে পারেন বা দিয়ত নিয়ে মাফ করতে পারেন। কিন্তু এই অধিকার শুধু তারই।
আরও পড়ুন: সন্ত্রাসীরা মুসলিম নয়, ইসলামের চূড়ান্ত বিধান
ইসলামি আইনে কিসাস মাফ করার অধিকার কোনো রাষ্ট্রপ্রধান, শাসক বা বিশেষ কর্তৃপক্ষের নেই। যদি রাষ্ট্রপ্রধান খুনিকে ক্ষমা করে দেন, তবে তা শুধু সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের আইনে বৈধ হতে পারে, আল্লাহর আইনে নয় এবং কেয়ামতের দিন এ ক্ষমা গ্রাহ্য হবে না। এখানেই ইসলামি আইনের শ্রেষ্ঠত্ব। এটি ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করে এবং প্রতিটি নাগরিকের হক পূর্ণ নিরাপত্তা দেয়।
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- কিসাস বাস্তবায়নের দায়িত্ব কেবল রাষ্ট্রের। ব্যক্তি বা গোষ্ঠী আইন নিজ হাতে তুলে নিতে পারে না। রাষ্ট্রীয় আদালত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে রায় দেবে এবং রাষ্ট্রই তা বাস্তবায়ন করবে। এটি সামাজিক বিশৃঙ্খলা রোধ করে এবং বিচার ব্যবস্থার পবিত্রতা রক্ষা করে।
কিসাস ইসলামের একটি যুগান্তকারী বিধান, যা শাস্তি নয় বরং জীবন রক্ষা, ইনসাফ প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি। এটি অপরাধ দমনের পাশাপাশি মানবিকতা ও ক্ষমার সুযোগও রাখে, কিন্তু সেই ক্ষমার মালিকানা দেয় নিহতের পরিবারকে; ক্ষমতার কেন্দ্রে নয়। এই ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থাই কিসাসকে করে তোলে মানবজীবনের সর্বোত্তম রক্ষাকবচ এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক, নিরাপদ সমাজ গড়ার অদ্বিতীয় হাতিয়ার।