ধর্ম ডেস্ক
০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০২:৩৮ পিএম
ইসলামি খেলাফতের ইতিহাসে একটি অদ্ভুত ঘটনা রয়েছে। খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজের নেতৃত্বে মাত্র দুই বছরে সমাজ এতটাই বদলে গিয়েছিল যে, জাকাত দেওয়ার মতো গরীব মানুষ খুঁজে পাওয়া যেত না! এটি কোনো অলীক গল্প নয়, বরং ইসলামের সেই চিরন্তন সত্যের প্রমাণ; সৎ নেতৃত্ব আল্লাহর রহমতের বাস্তব রূপ। কোরআন-হাদিস এবং চৌদ্দশ বছররের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যখনই কোনো সমাজ যোগ্য ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিকে নেতৃত্বে বসিয়েছে, আকাশ থেকে বরকত বর্ষিত হয়েছে।
ইসলাম নেতৃত্বকে ক্ষমতার পদবী নয়, একটি গুরুদায়িত্বপূর্ণ আমানত হিসেবে দেখে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (বুখারি)। এই আমানত যখন যোগ্য হাতে যায়, তখন তা সমগ্র সমাজের জন্য রহমতের কারণ হয়। আল্লাহ তাআলা স্পষ্ট বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ করেন যে, আমানতসমূহ তার হকদারকে প্রত্যর্পণ করবে।’ (সুরা নিসা: ৫৮)। একজন ‘হকদার’ নেতা হলেন তিনি, যিনি জ্ঞান, সততা, ন্যায়পরায়ণতা এবং আল্লাহভীতি রাখেন।
১. আল্লাহর সরাসরি সাহায্য ও রহমত
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তির জন্য আল্লাহর সাহায্য অবধারিত... তাদের একজন হলো ন্যায়পরায়ণ শাসক।’ (সুনান তিরমিজি)। এই সাহায্য শুধু নেতার জন্য নয়, গোটা জাতির জন্য। সুরা আরাফের ৯৬ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘যদি ওই জনপদের লোকেরা ঈমান আনত ও তাকওয়া অবলম্বন করত, তবে আমরা তাদের জন্য আকাশ ও পৃথিবী থেকে বরকতের দরজা খুলে দিতাম।’ সৎ নেতৃত্ব সেই ‘তাকওয়া’র বাস্তব রূপ, যার ফলে গোটা সমাজে ঐশী বরকতের প্রবাহ শুরু হয়।
আরও পড়ুন: যাকে নেতা মানলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন
২. অর্থনৈতিক মন্দা দূর হয়, সমৃদ্ধি আসে
ইতিহাস সাক্ষী, হজরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে রাষ্ট্রের কোষাগার পরিপূর্ণ থাকত, অথচ তিনি নিজে মেরামত করা জামা পরতেন। সৎ নেতৃত্বে দুর্নীতি দূর হয়, সম্পদ সঠিক হাতে বণ্টিত হয় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে আমানতদারিতা বাড়ে। এর ফলাফল স্বয়ংক্রিয়ভাবে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি। মালয়েশিয়ার দ্রুত উন্নয়নের পেছনেও গবেষকরা ইসলামি নৈতিকতাভিত্তিক শাসনব্যবস্থার ভূমিকা খুঁজে পান।
৩. সামাজিক শান্তি ও মানসিক নিরাপত্তা
সৎ নেতা সমাজে ভ্রাতৃত্ব ও ন্যায়ের বন্ধন শক্তিশালী করেন। রাসুল (স.) বলেছেন, ‘তোমাদের ওপর সর্বোত্তম নেতা তারা, যাদের তোমরা ভালোবাসো, আর তারাও তোমাদের ভালোবাসে।’ (সহিহ মুসলিম)। এই পারস্পরিক ভালোবাসা ও আস্থাই সামাজিক শান্তির ভিত্তি তৈরি করে। মানুষ ন্যায়বিচার পাবে—এই নিশ্চয়তাই তার মানসিক শান্তির সবচেয়ে বড় উৎস।
৪. পরকালীন মুক্তি ও সর্বোচ্চ মর্যাদা
ইহকালীন সাফল্যের পাশাপাশি সৎ নেতার জন্য রয়েছে পরকালীন অশেষ পুরস্কার। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘সাত শ্রেণির লোককে আল্লাহ তাঁর আরশের ছায়ায় রাখবেন... তাদের একজন হলো ন্যায়পরায়ণ শাসক।’ (সহিহ বুখারি)। কেয়ামতের ভয়াবহ দিনে আরশের ছায়াই হবে একমাত্র শান্তির স্থান। এছাড়া ন্যায়বিচারকারী নেতা নবীদের পরেই সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে উপবেশন করবেন। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যারা ভালো বা মন্দ কাজ করে বা করার ক্ষমতা ও সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় তারা ওই কর্ম সম্পাদনকারীর সমান সওয়াব বা গুনাহ অর্জন করবে।’ (তিরমিজি-মিশকাত)
৫. জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মান
ইসলামি ইতিহাসে দেখা যায়, যখন নেতৃত্ব সৎ ও যোগ্য ছিল, তখন শত্রুরাও মুসলিম রাষ্ট্রের ন্যায়বিচার ও শাসনব্যবস্থার প্রশংসা করত। খলিফা ওমর (রা.)-এর ন্যায়বিচারের খ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। সৎ নেতৃত্ব কোনো জাতিকে শুধু আর্থিকভাবে সমৃদ্ধই করে না, তাদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক পরাশক্তিতেও পরিণত করে।
আরও পড়ুন: নেতার যোগ্যতা সম্পর্কে কোরআন-হাদিস যা বলে
অন্যদিকে, অযোগ্য নেতৃত্ব গ্রহণের ব্যাপারে ইসলাম স্পষ্ট সতর্ক করেছে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যখন দায়িত্ব অযোগ্য ব্যক্তির হাতে দেওয়া হবে, তখন কেয়ামতের অপেক্ষা করো।’ (সহিহ বুখারি)। অযোগ্য নেতৃত্ব সমাজে ন্যায়বিচার ধ্বংস করে, দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়, আল্লাহর রহমত সরে যায় এবং সমাজ ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে এগোয়। এটি শুধু রাজনৈতিক ব্যর্থতা নয়, এটি আল্লাহর গজব ডেকে আনার পথ।
ইসলাম শুধু নেতৃত্বের গুরুত্ব বলেনি, বাছাইয়ের স্পষ্ট পদ্ধতিও দিয়েছে-
১. যোগ্যতাই একমাত্র মাপকাঠি: জাতি, গোত্র, বংশ বা অর্থ নয়। নেতা হতে হবে ইলম (জ্ঞান), আদালত (ন্যায়পরায়ণতা), আমানতদারী (সততা) ও কুওয়াত (সামর্থ্য)-এ শ্রেষ্ঠ।
২. শূরা বা পরামর্শ প্রথা: গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের পরামর্শে নেওয়া। আল্লাহ বলেন, ‘আর তাদের কাজ হলো পরস্পর পরামর্শের মাধ্যমে।’ (সুরা শুরা: ৩৮)
৩. জনগণের কল্যাণকামিতা: নেতার উদ্দেশ্য ব্যক্তিগত সুবিধা নয়, জনগণের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করা।
১. দুটি দোয়া করুন: ক. اللَّهُمَّ اهْدِنَا وَاهْدِ بِنَا ‘হে আল্লাহ! আমাদেরকে হেদায়াত দিন এবং আমাদের মাধ্যমে অন্যদের হেদায়াত দিন।’ খ. اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ إِمَارَةِ السُّفَهَاءِ ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে অযোগ্য নেতৃত্ব থেকে আশ্রয় চাই।’
২. নিজের অবস্থান থেকে নেতৃত্ব দিন: নেতা শুধু রাষ্ট্রপ্রধান নন। আপনি যদি পিতা হন, আপনি পরিবারের নেতা। যদি শিক্ষক হন, ক্লাসের নেতা। যদি দোকানদার হন, ব্যবসার নেতা। আপনার ক্ষুদ্র পরিসরে সততা, ন্যায় ও দায়িত্বশীলতা প্রতিষ্ঠা করুন। সমাজ পরিবর্তন বৃহৎ স্তরে শুরু হয় না, ব্যক্তির হৃদয় থেকে শুরু হয়।
আরও পড়ুন: শাসক, পদ-পদবি সম্পর্কে ইসলামি নির্দেশনা
৩. সচেতন নাগরিক হওয়া: নেতা নির্বাচনের সময় চরিত্র ও যোগ্যতা দেখুন। সমাজে সৎ ব্যক্তিদের সমর্থন দিন এবং অযোগ্যদের সমালোচনা করুন জ্ঞান ও নম্রতার সাথে। মনে রাখবেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের নেতা হয় অথচ সে জানে যে, তাদের মধ্যে তার চেয়ে বেশি যোগ্য কেউ আছে, তবে সে আল্লাহ, তাঁর রাসুল এবং সকল মুসলিমের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল।’ (মুসনাদ আহমদ)
শেষ কথা, ওমর ইবনে আবদুল আজিজের ‘অলৌকিক দুই বছর’ শুধু অতীতের গল্প নয়, এটি ভবিষ্যতের রূপরেখা; আমাদের জন্য একটি সম্ভাবনার বার্তা। আমরা যদি আমাদের রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব থেকে শুরু করে পরিবার, কর্মস্থল ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃত্বে সততা, যোগ্যতা ও আল্লাহভীতিকে প্রাধান্য দেই, সেই ঐতিহাসিক বরকতময় সময় আমাদেরও হতে পারে। কারণ, আল্লাহর নিয়ম কখনো পরিবর্তিত হয় না: সৎ নেতৃত্ব মানেই আল্লাহর রহমত—এটি এক চিরন্তন সত্য।