বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

যাকে নেতা মানলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:২৮ পিএম

শেয়ার করুন:

যাকে নেতা মানলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন

ইসলামে নেতৃত্ব একটি পবিত্র আমানত, যা সমাজকে সত্য, ন্যায়, ঈমান এবং কল্যাণের পথে পরিচালিত করে। যোগ্য ব্যক্তির নেতৃত্ব জাতিকে উন্নতির দিকে নিয়ে যায়, আর ভুল নেতৃত্ব সমাজে ফিতনা, অন্যায়, দুর্নীতি ও ঈমানি দুর্বলতা সৃষ্টি করে। বিশেষত যদি নেতৃত্বের আসনে মুনাফিক উঠে আসে, তাহলে তা আল্লাহর গজবকে ডেকে আনে।

নবীজি (স.) মুনাফিকদের চরিত্র, তাদের ক্ষতি এবং তাদের সাথে মুসলমানদের কেমন আচরণ করা উচিত সে বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। সেই নির্দেশনার মধ্যেই রয়েছে- মুনাফিককে কখনো নেতা বলা যাবে না। এই প্রতিবেদনে সেই নিষেধাজ্ঞার গুরুত্ব, কোরআন ও হাদিসের দলিল এবং সঠিক নেতৃত্বের নীতিমালা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।


বিজ্ঞাপন


রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সতর্কবার্তা: মুনাফিককে নেতা বানানো হারাম

নবীজি (স.) বলেন- لَا تَقُولُوا لِلْمُنَافِقِ سَيِّدٌ، فَإِنَّهُ إِنْ يَكُ سَيِّدًا فَقَدْ أَسْخَطْتُمْ رَبَّكُمْ عَزَّ وَجَلَّ ‘মুনাফিককে সাইয়্যিদ (নেতা) বলে ডেকো না। কারণ যদি সে সত্যিকার অর্থেই তোমাদের নেতা হয়ে থাকে, তাহলে তোমরা নিজেদের রবকে রাগান্বিত করলে।’ (সুনানে আবু দাউদ: ৪৯৭৭)

এ হাদিসের মূল শিক্ষা হলো- নেতৃত্ব সম্মান ও মর্যাদার জায়গা; সেখানে মুনাফিককে বসানো মানে সত্যকে অপমান করা এবং সরাসরি আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করা।

আরও পড়ুন: যেসব ফেতনার ব্যাপারে বিশেষভাবে সতর্ক করেছেন নবীজি


বিজ্ঞাপন


কোরআনে মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য ও নেতৃত্বের অযোগ্যতা

১. মুনাফিকরা মিথ্যাবাদী: ‘নিশ্চয় মুনাফিকরা তো মিথ্যাবাদী।’ (সুরা মুনাফিকুন: ১) মিথ্যাকে নেতা বানানো সমাজে মিথ্যাকে বৈধতা দেয়।

২. তারা দ্বিমুখী চরিত্রের অধিকারী: ‘মুমিনদের কাছে গেলে বলে ‘আমরা ঈমান এনেছি’, আর নিজেদের শয়তান সঙ্গীদের কাছে গেলে বলে- ‘আমরা অবশ্যই তোমাদের সঙ্গেই আছি।’ (সুরা বাকারা: ১৪) দ্বিমুখী লোক কখনোই সত্য ও ন্যায়ের নেতৃত্ব দিতে সক্ষম নয়।

৩. তারা অহংকারী এবং সত্য গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক: ‘আপনি দেখবেন তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তারা তো অহংকারী।’ (সুরা মুনাফিকুন: ৫) এমন অহংকারী ও ঈমানদ্বেষী মানুষ নেতৃত্বে এলে আল্লাহর গজব আসে।

৪. তারা সমাজে ফ্যাসাদ ছড়ায়: ‘যখন তাদেরকে বলা হয়, তোমরা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করো না, তারা বলে, আমরা তো শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী।’ (সুরা বাকারা: ১১) মুনাফিকরা নিজেকে ‘ভালো’ দাবি করলেও সমাজে নষ্টামি ছড়ায়।

৫. তাদের পরিণতি ভয়াবহ: ‘নিশ্চয় মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে থাকবে।’ (সুরা নিসা: ১৪৫) যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে এত নিচু অবস্থার অধিকারী, তাকে নেতৃত্বে বসানো আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণ।

আরও পড়ুন: কেয়ামতের আগে যেসব ঘটনা বেড়ে যাবে

হাদিস থেকে নেতৃত্বে মুনাফিকদের নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ

১. তারা সমাজকে বিভ্রান্ত করে: রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘এই উম্মতের জন্য যাকে আমি সবচেয়ে ভয়ংকর ও বিপজ্জনক মনে করি এবং সবচেয়ে ভয় করি, সে হচ্ছে অতিশয় বাকপটু মুনাফিক।’ (মুসনাদে আহমদ: ৩১০) অর্থাৎ সুন্দর কথা বললেও তাদের অন্তর নষ্ট—এমন লোক নেতৃত্বে এলে জাতি ধ্বংস হয়।

২. অযোগ্য নেতৃত্ব আল্লাহর গজব ডেকে আনে: একটি হাদিসে এসেছে- ‘যে ব্যক্তি এমন কাউকে নেতা বানায়, যার চেয়ে যোগ্য ব্যক্তি উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও; সে আল্লাহর গজবের সম্মুখীন হবে।’ (সহিহ আল-জামে: ৬০১৮) মুনাফিককে নেতা বানানো হলো অযোগ্যকে নেতৃত্ব দেওয়ার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।

সঠিক নেতৃত্ব কেমন হওয়া উচিত

ইসলাম নেতৃত্বের জন্য কিছু অপরিহার্য গুণ নির্ধারণ করেছে-

১. তাকওয়াবান: ‘তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত সেই, যে সবচেয়ে বেশি আল্লাহভীরু।’ (সুরা হুজরাত: ১৩)

২. আমানতদার: নবীজি (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘যখন আমানত নষ্ট করা হবে তখন কেয়ামতের অপেক্ষায় থাক। জিজ্ঞাসা করা হলো, আমানত কীভাবে নষ্ট করা হবে? তিনি বললেন, অযোগ্য ব্যক্তির হাতে দায়িত্ব অর্পণ করা আমানত নষ্টের শামিল।’ (বুখারি: ৫৯)

৩. ন্যায়পরায়ণতা: ‘কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি শত্রুতা তোমাদেরকে যেন এতটা উত্তেজিত না করে যে তোমরা ইনসাফ ত্যাগ করবে।’ (সুরা মায়েদা : ৮)

৪. সত্যবাদিতা ও ঈমানি চরিত্র: ইসলাম সৎ, যোগ্য ও দ্বীনদার ব্যক্তিকেই নেতৃত্বে বসানোর নির্দেশ দিয়েছে।

৫. প্রজ্ঞাবান ও দুরদৃষ্টিসম্পন্ন: আল্লাহ তাআলা বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ওপর তাকে (তালুতকে) (নেতা হিসেবে) পছন্দ করেছেন এবং সুন্দর শারীরিক গঠন ও জ্ঞানের প্রাচুর্য দান করেছেন।’ (সুরা বাকারা: ২৪৭)

৬. দৃঢ়চিত্ত ও সৎসাহসের অধিকারী: উবাদাহ ইবনে সামিত (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘যেখানেই থাকি না কেন, সত্যের ওপর দৃঢ় থাকব কিংবা বলেছিলেন, সত্য কথা বলব এবং আল্লাহর কাজে কোনো নিন্দুকের নিন্দার ভয় করব না।’ (বুখারি: ৭২০০)

আরও পড়ুন: নেতার যোগ্যতা সম্পর্কে কোরআন-হাদিস

মুনাফিককে নেতা মানার ক্ষতিকর পরিণতি

১. আল্লাহর গজব নেমে আসে: হাদিসে সরাসরি বলা হয়েছে।
২. সমাজে ফিতনা ছড়ায়: অন্যায়, দুর্নীতি ও দ্বিচারিতা বাড়ে।
৩. সত্য ও ন্যায়ের পতন ঘটে।
৪. মুমিনদের মনোবল ভেঙে পড়ে।
৫. ঈমান ও আদর্শ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ইসলাম নেতৃত্বকে ইবাদত ও আমানত হিসেবে দেখেছে। আর এই পবিত্র দায়িত্ব কখনোই মুনাফিক, প্রতারক, দুর্বৃত্ত বা দ্বিমুখী মানুষের হাতে দেওয়া যাবে না। কারণ, মুনাফিককে নেতৃত্ব দেওয়া মানে হলো- সত্যকে অপমান করা, অন্যায়কে শক্তিশালী করা, সমাজকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া এবং সর্বোপরিআল্লাহকে অসন্তুষ্ট করা।

অতএব, আমাদের সমাজ, জাতি ও ঈমানকে রক্ষা করতে হলে আমাদের প্রয়োজন সৎ, আমানতদার, আল্লাহভীরু, ন্যায়পরায়ণ ও যোগ্য নেতৃত্ব। আল্লাহ তাআলা আমাদের সমাজকে মুনাফিকদের নেতৃত্ব থেকে রক্ষা করুন এবং নেককার নেতৃত্ব দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর