images

ইসলাম

অহংকারীরা কেন নিজের ভুল দেখে না, কোরআন-হাদিসের আলোকে বিশ্লেষণ

ধর্ম ডেস্ক

০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৪:৩১ পিএম

অহংকার (কিবর) ইসলামে অন্যতম ভয়াবহ আত্মিক রোগ। এটি মানুষের চিন্তা ও চরিত্রকে এমনভাবে প্রভাবিত করে যে, সে নিজের ভুল বুঝতে অক্ষম হয়ে পড়ে। সত্য সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও অহংকারী তা গ্রহণ করতে চায় না। একটি অদৃশ্য মানসিক পর্দা তার দৃষ্টিশক্তিকে আবদ্ধ করে ফেলে। কোরআন ও হাদিসে অহংকারকে ব্যক্তিগত পতন এবং সমাজের অবক্ষয়ের প্রধান কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এই প্রতিবেদনে কোরআন-সুন্নাহর দলিলের আলোকে ব্যাখ্যা করা হবে- অহংকার কীভাবে দৃষ্টি-চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে, মানুষকে নিজের ভুল দেখতে বাধা দেয় এবং এর প্রতিকার কী।

অহংকার সত্য দর্শনের প্রধান বাধা

আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘আমি তাদের অন্তরের উপর আবরণ দিয়েছি; যেন তারা কোরআন বুঝতে না পারে এবং তাদের কানে বধিরতা সৃষ্টি করেছি। তুমি তাদেরকে সৎপথে আহবান করলেও তারা কখনো সৎপথ পাবে না।’ (সুরা কাহাফ: ৫৭)

অহংকার মানুষের অন্তরে এমন এক অদৃশ্য পর্দা সৃষ্টি করে, যা তাকে সত্যের আলো দেখতেই দেয় না। 

আল্লাহ তাআলা আরও ইরশাদ করেন- ‘যারা পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে অহংকার করে, আমি তাদেরকে আমার নিদর্শনগুলো থেকে বিমুখ করে দেব। ফলে তারা সব নিদর্শন দেখলেও তাতে বিশ্বাস স্থাপন করবে না।’ (সুরা আরাফ: ১৪৬)

অহংকার এখানে হৃদয় ও বুদ্ধির ওপর আধ্যাত্মিক অন্ধত্ব হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। অহংকারী দেখেও দেখে না, শুনেও শোনে না।

আরও পড়ুন: অহংকার আল্লাহর চাঁদর, টানাটানি করলেই শাস্তি

অহংকারের সংজ্ঞা ও প্রভাব

রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন- ‘অহংকার হলো সত্যকে প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে তুচ্ছজ্ঞান করা।’ (সহিহ মুসলিম: ৯১)

এই দুই বৈশিষ্ট্য অহংকারীকে নিজের ভুল দেখতে দেয় না। সত্যকে অস্বীকার করার প্রবণতা তাকে সংশোধন গ্রহণে বাধা দেয়। অন্যকে ছোট ভাবায় সে মনে করে, ‘এ মানুষ আমাকে কী শিখাবে?’

জান্নাত থেকে বঞ্চনার কারণ

‘যার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (সহিহ মুসলিম: ৯১)

অহংকারের কারণে আত্মশুদ্ধির পথ বন্ধ হয়ে যায়। যে নিজের ভুল দেখে না, তার তওবা ও সংশোধনের সুযোগও সংকুচিত হয়।

 স্ব-পরীক্ষা: আমার মধ্যে অহংকার আছে কি?

  • আপনি কি সহজে ‘দুঃখিত’ বা ‘আমি ভুল ছিলাম’ বলতে পারেন?
  • যার সাথে মতবিরোধ আছে, তার কাছ থেকেও ভালো পরামর্শ নিতে পারেন কি?
  • নিজের জ্ঞান, পদ বা সম্পদ নিয়ে গোপনে ‘আমি অন্যের চেয়ে উত্তম’ এই ভাবনা আসে কি?

উপরের যেকোনো একটি প্রশ্নের উত্তর ‘না’ হলে, সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে।

আরও পড়ুন: জাহান্নামের 'বুলাস' কারাগারে কারা যাবে? কোরআন-হাদিসে ভয়াল চিত্র

অহংকার যুগে যুগে মানুষকে যেভাবে ধ্বংস করেছে

  • শয়তান বলেছিল- ‘আমি তার চেয়ে উত্তম; আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন আগুন থেকে, আর তাকে মাটি থেকে।’ (সুরা আরাফ: ১২)
  • জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও অহংকার তাকে সত্য স্বীকার করতে দেয়নি- এটাই তার ধ্বংসের কারণ।
  • ফেরাউন বলেছিল- ‘হামান! আমার জন্য একটি উচ্চ প্রাসাদ তৈরি কর… আমি মুসার আল্লাহকে দেখে আসি।’ (সুরা গাফির: ৩৬–৩৭)
  • প্রমাণ সামনে থাকা সত্ত্বেও সে অহংকারে অন্ধ হয়ে মুসা (আ.)-কে মিথ্যাবাদী বলত।
  • কারুন বলত ‘এ সম্পদ আমি আমার জ্ঞানবলে পেয়েছি।’ (সুরা কাসাস: ৭৮) এই ‘স্ব-কৃতিত্বের অহংকার’ তাকে নিজের ভ্রান্তি বুঝতে দেয়নি, ফলেই তার ধ্বংস ঘটে।

অহংকার চিন্তাশক্তিকে কীভাবে বিকল করে

ইসলামি মনোবিজ্ঞান ও আলেমরা অহংকারের তিনটি প্রধান মানসিক প্রভাব উল্লেখ করেছেন-

১. আত্ম-মুগ্ধতা (উজব): ইমাম গাজ্জালি (রহ.) বলেন- ‘উজব হলো সেই অন্ধত্ব, যেখানে মানুষ নিজের দোষ দেখতে পায় না; অন্যের ছোট দোষও বড় হয়ে দেখা দেয়।’

২. ভুলকে সঠিক প্রমাণের প্রবণতা (Rationalization): ফেরাউন মুজেজাকে ‘জাদু’ বলেছিল। আধুনিক মনোবিজ্ঞানে যা ‘কগনিটিভ ডিসোন্যান্স’ ভুলকে যুক্তি দিয়ে ঢেকে রাখা।

৩. পরামর্শ গ্রহণে অক্ষমতা: রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন- ‘মুমিন মুমিনের দর্পণের মতো।’ (আবু দাউদ: ৪৯১৮) অহংকারী দর্পণের মুখ ঘুরিয়ে রাখে। তাই কেউ তাকে সংশোধন করতে পারে না।

আরও পড়ুন: সুন্দর পোশাক: অহংকার নাকি শুকরিয়া?

অহংকার দূর করার পথ

১. দৈনিক আত্মসমালোচনা (মুহাসাবা): ওমর (রা.)-এর উপদেশ- ‘নিজেদের হিসাব নাও, হিসাব নেওয়ার আগেই।’ এটি অহংকার দূরিকরণের উত্তম প্রতিশেধক।

২. বিনয়ের চর্চা: রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন- ‘যার ইলম বাড়ে অথচ বিনয় বাড়ে না, সে আল্লাহ থেকে দূরে সরে যায়।’ (বায়হাকি) ইলম অর্জন এবং বিনয়ের চর্চা দুটোর সমন্বয় অংহকারকে দাবিয়ে রাখে।

৩. সাধারণ মানুষের সাথে মেলামেশা ও সেবা: রাসুলুল্লাহ (স.) দাস ও মিসকিনদের সঙ্গেই বসতেন; এটি অহংকারের দেয়াল ভেঙে দেয়।

৪. অন্যের কল্যাণ কামনা ও দোয়া: যখন মানুষ অন্যের জন্য মঙ্গল কামনা করে, হৃদয়ের কড়াকড়ি নরম হয়ে যায়, অহংকার ভেঙে পড়ে।

আধুনিক যুগে অহংকারের নতুন রূপ

আজ অহংকার প্রকাশ পায় তিনটি সূক্ষ্ম উপায়ে-

  • বুদ্ধিবৃত্তিক অহংকার: জ্ঞান বা ডিগ্রির গর্ব
  • আধ্যাত্মিক অহংকার: ইবাদত নিয়ে আত্মগর্ব
  • নিষ্ক্রিয় অহংকার: ভুল স্বীকার না করে নীরব থাকা বা অনর্থক সত্যের বিপরীত কথা বলা।

কোরআন-হাদিসের দলিল ও ইতিহাসের নির্মম শিক্ষা স্পষ্ট: অহংকার প্রথমে তার ধারককেই ধ্বংস করে। এটি তাকে আত্মসমালোচনার শক্তি, সংশোধনের সুযোগ এবং শেষ পর্যন্ত আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত করে। ইসলাম যে বিনয় ও আত্মমূল্যায়নের পথ দেখিয়েছে, তা কোনো কঠোর নিষেধ নয়; বরং এটি আমাদেরকে আত্ম-ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহর এক মহান অনুগ্রহ।

‘পৃথিবীতে গর্বভরে চলো না; তুমি কখনোই পৃথিবী চিরে ফেলতে পারবে না, পর্বতের উচ্চতায়ও পৌঁছতে পারবে না।’ (সুরা ইসরা: ৩৭)

হে আল্লাহ! আমাদের অন্তর থেকে অহংকার, দাম্ভিকতা ও আত্ম-মুগ্ধতা দূর করে দিন। আমাদেরকে বিনয়ী বানান এবং নিজের ভুল দেখার ও স্বীকার করার সাহস দান করুন। আমিন।