ধর্ম ডেস্ক
০২ নভেম্বর ২০২৫, ০৪:১৪ পিএম
মসজিদ মুসলমানদের ধর্মীয়, সামাজিক ও নৈতিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। এটি ইবাদতের স্থান ছাড়াও শিক্ষা, দান-সদকা ও সামাজিক ঐক্যের অন্যতম ভিত্তি। ফলে মসজিদের দান ও তহবিলের অর্থ ব্যবস্থাপনা ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি বিষয়। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়- এই দান ও তহবিলের ব্যবহার কতটা স্বচ্ছ এবং পরিচালনায় কতটা জবাবদিহি নিশ্চিত হচ্ছে?
বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্বের বহু মসজিদে এই প্রশ্ন আজ বাস্তব উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতার অভাবে দাতাদের আস্থায় ফাটল ধরছে আর মসজিদের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
ইসলাম দান ও তহবিলকে ‘আমানত’ হিসেবে ঘোষণা করেছে, যার সঠিক ব্যবহার ঈমানি দায়িত্ব। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দেন যে, তোমরা আমানত তাদের হকদারদের নিকট পৌঁছে দাও।’ (সুরা নিসা: ৫৮)
রাসুলুল্লাহ (স.) সতর্ক করে বলেছেন, ‘দায়িত্ব হচ্ছে একটি আমানাত। আর কেয়ামতের দিন এ হবে লাঞ্ছনা ও অনুশোচনা। তবে যে এর হক সম্পূর্ণ আদায় করবে তার কথা ভিন্ন।’ (সহিহ মুসলিম: ১৮২৫)
অতএব, মসজিদের তহবিল পরিচালনায় সততা ও স্বচ্ছতা ঈমানি ও নৈতিক দায়িত্ব।
আরও পড়ুন: মসজিদ ফান্ডের উদ্বৃত্ত টাকা সামাজিক কাজে ব্যয় করা যাবে?
মসজিদের দান ব্যবস্থাপনায় অস্পষ্টতা ও আস্থাহীনতার পেছনে কিছু সাধারণ কারণ প্রায় সব জায়গায় দেখা যায়—
প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অভাব: অধিকাংশ মসজিদ স্বাধীনভাবে পরিচালিত হয়, কেন্দ্রীয় কোনো মানদণ্ড বা নজরদারি নেই।
অডিট ও হিসাব যাচাইয়ের অনুপস্থিতি: পেশাদার নিরীক্ষা বা আর্থিক রিপোর্ট প্রকাশের অভাবে আয়-ব্যয় শুধু কয়েকজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
কমিটি গঠন ও পক্ষপাত: অনেক সময় রাজনৈতিক প্রভাব, ব্যক্তিগত স্বার্থ বা প্রভাবশালী মহলের চাপ আর্থিক স্বচ্ছতাকে ব্যাহত করে।
প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা: ডিজিটাল হিসাব বা অনলাইন রিপোর্টিং এখনো খুবই সীমিত।
দাতাদের অংশগ্রহণহীনতা: দাতারা হিসাব জানতে না পেরে বা প্রশ্ন করতে না পেরে ধীরে ধীরে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছেন।
ইসলামে মসজিদের অর্থ ব্যবহারের প্রতিটি ধাপেই পরামর্শ, আমানতদারিতা ও দলিল সংরক্ষণকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। দানের অর্থ আল্লাহর পথে ব্যয় করার জন্য; তা ব্যক্তিগত সুবিধা, রাজনৈতিক প্রভাব বা নাম-যশের জন্য নয়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে- ‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ ও রাসুলের সঙ্গে খেয়ানত করো না এবং তোমাদের আমানতের ব্যাপারে খেয়ানত করো না, অথচ তোমরা জানো।’ (সুরা আনফাল: ২৭)
অতএব, মসজিদ কমিটি বা দায়িত্বপ্রাপ্তদের জন্য সততা ও স্বচ্ছতা রক্ষা করা কেবল প্রশাসনিক কিংবা নৈতিক নয়, ঈমানের পরীক্ষাও বটে।
আরও পড়ুন: ইমামের বেতন নিয়ে শরিয়তের নির্দেশনা: মসজিদ কমিটির করণীয়
মসজিদের সুষ্ঠু পরিচালনার মূল স্তম্ভ হলো যোগ্য ও ঈমানদার কমিটি। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, বেশ কিছু মসজিদে কমিটির পদকে ‘প্রভাবের আসন’ মনে করা হয়, যা ইসলামি দৃষ্টিতে গুরুতর ভুল। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যখন অযোগ্যকে দায়িত্ব দেওয়া হবে, তখন কেয়ামতের অপেক্ষা করো।’ (সহিহ বুখারি: ৬৪৯৬)
কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা
রাসুল (স.) বলেছেন, ‘যারা নেতৃত্ব চায় এবং এর লোভ করে, আমরা তাদেরকে এ পদে নিয়োগ করি না।’ (সহিহ বুখারি: ৭১৪৯)
আরও পড়ুন: মসজিদের আদব: আল্লাহর ঘরে নিষিদ্ধ ১১ কাজ
আজকের যুগে প্রযুক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতির সাহায্যে মসজিদের স্বচ্ছতা অনেক সহজে নিশ্চিত করা সম্ভব। কিছু বাস্তবধর্মী উদ্যোগ হতে পারে—
সৌদি আরব: মসজিদ তহবিল সরকারি মন্ত্রণালয়ের অধীনে এবং প্রতিটি ব্যয় নিরীক্ষিত।
মালয়েশিয়া: ডিজিটাল ওয়াকফ ও ফান্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালু; দাতারা অনলাইনে হিসাব দেখতে পারেন।
এসব মডেল অনুসরণ করলে বাংলাদেশেও মসজিদ ব্যবস্থাপনায় আস্থার নতুন দিগন্ত খুলে যেতে পারে।
মোটকথা, মসজিদ পরিচালনার মূল চাবিকাঠি হলো বিশ্বাস ও আমানতদারিতা। যেখানে দানের অর্থে খেয়ানত ঘটে, সেখানে ইবাদতের আলোও ম্লান হয়ে যায়। তাই মসজিদ কমিটি, ইমাম-মুয়াজ্জিন, দাতা ও সাধারণ মুসল্লি সবাই মিলে যদি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সংস্কৃতি গড়ে তোলেন, মসজিদ আবারও হবে প্রকৃত অর্থে আল্লাহর ঘর, যেখানে প্রতিষ্ঠিত হবে বিশ্বাস, সততা ও ন্যায়ের আলোকিত আদর্শ।