ধর্ম ডেস্ক
৩০ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:০৬ পিএম
মানবসভ্যতা আজ যেন এক অদৃশ্য ঝড়ের মধ্যে; যেখানে সত্য ঢেকে যায়, অন্যায় শক্তিশালী হয়ে ওঠে, আর ঈমান হয়ে পড়ে দুর্লভ সম্পদ। নবী কারিম (স.) বহু আগে সতর্ক করেছিলেন, কেয়ামতের আগে এমন এক সময় আসবে, যখন ফিতনা তথা বিপর্যয়, নৈরাজ্য ও বিভ্রান্তি মুষলধারার বৃষ্টির মতো নেমে আসবে।
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘কেয়ামতের আগে এমন সময় আসবে, যখন ফিতনা-ফ্যাসাদ মুষলধারার বৃষ্টির মতো নেমে আসবে; একজন মানুষ সকালে মুমিন থাকবে, আর সন্ধ্যায় কাফির হয়ে যাবে।’ (সহিহ মুসলিম: ১১৮)
এই হাদিস আজ যেন বাস্তবের প্রতিচ্ছবি। নিচে নবীজির বর্ণনা ও আলেমদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সবচেয়ে ভয়াবহ পাঁচটি ফিতনা তুলে ধরা হলো—
এটাই সবচেয়ে ভয়াবহ ফিতনা, যা অজান্তেই মানুষের অন্তর থেকে ঈমান কেড়ে নেয়। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘মানুষের ওপর এমন সময় আসবে, যখন দ্বীনের ওপর স্থির থাকা হবে হাতে জ্বলন্ত অঙ্গার ধরার মতো কঠিন।’ (সুনানে তিরমিজি: ২২৬০)
আজ চারদিকে ইসলামকে বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে, নতুন মতবাদ ও চিন্তাধারা ছড়িয়ে পড়ছে, যা ধীরে ধীরে মানুষকে ঈমান থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে।
আরও পড়ুন: যে ফিতনা দাজ্জালের চেয়েও ভয়ংকর
নবীজির (স.) ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, শেষ যুগে সত্যিকার জ্ঞান লোপ পাবে, অজ্ঞতা ছড়িয়ে পড়বে। ‘কেয়ামতের পূর্বে জ্ঞান তুলে নেওয়া হবে, অজ্ঞতা ছড়িয়ে পড়বে এবং হারজ (হত্যা) বেড়ে যাবে।’ (সহিহ বুখারি: ৭০৬৪)
আজ আমরা তথ্যের প্রাচুর্যে বাস করছি, কিন্তু প্রকৃত জ্ঞান যা মানুষকে আল্লাহভীরু করে, তার অভাব ক্রমেই বাড়ছে।
আরও পড়ুন: দাজ্জাল সামনে এলে এই ৪ কাজ অবশ্যই করবেন
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের ব্যাপারে দারিদ্রের ভয় করি না। কিন্তু তোমাদের ব্যাপারে এ আশঙ্কা করি যে, তোমাদের উপর দুনিয়া এরূপ প্রসারিত হয়ে পড়বে যেমন তোমাদের অগ্রবর্তীদের উপর প্রসারিত হয়েছিল। আর তোমরাও দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়বে, যেমন তারা আকৃষ্ট হয়েছিল। আর তা তোমাদের বিনাশ করবে, যেমন তাদের বিনাশ করেছে।’ (সহিহ বুখারি: ৩১৫৮) আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোনো না কোনো ফিতনা ছিল। আর আমার উম্মতের ফিতনা হলো ধন-সম্পদ।’ (তিরমিজি: ২৩৩৬)
ভোগ-বিলাস, অর্থের প্রতিযোগিতা ও খ্যাতির লালসা আজ মানুষকে দুনিয়ার বন্দি বানিয়ে ফেলেছে।
আরও পড়ুন: 'মানুষ নিজেও জানবে না সে আর মুসলিম নেই'
নবীজির (স.) বাণী- ‘ আমার পরে এমন সব নেতার উদ্ভব হবে, যারা আমার দেখানো পথে হেদায়াতপ্রাপ্ত হবে না এবং আমার সুন্নতও তারা অবলম্বন করবে না। অচিরেই তাদের মধ্যে এমন সব ব্যক্তির উদ্ভব হবে, যাদের আত্মা হবে মানব দেহে শয়তানের আত্মা।’ (সহিহ মুসলিম: ৪৬৭৯)
আজ বহু জায়গায় নেতৃত্বে ন্যায় হারিয়ে গেছে, অন্যায় ও স্বার্থপরতা রাজত্ব করছে।
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘সেই সত্তার শপথ! যার হাতে আমার জীবন, দুনিয়া ধ্বংস হবে না যে পর্যন্ত না মানুষের কাছে এমন এক যুগ আসে, যখন হত্যাকারী জানবে না যে, কি দোষে সে অন্যকে হত্যা করেছে এবং নিহত লোকও জানবে না যে, কি দোষে তাকে হত্যা করা হচ্ছে।’ (সহিহ মুসলিম: ৭১৯৬)
এই যুগে রক্তপাত যেন সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে—দেশ, মতবাদ, এমনকি সামাজিক কারণে মানুষ একে অপরকে হত্যা করছে।
আরও পড়ুন: কেয়ামতের আলামত: ইলমশূন্য বক্তা বেড়ে যাবে
সবরের মহাসওয়াব: রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের সামনে এমন যুগ আসছে, যখন ধৈর্য ধারণ করা জ্বলন্ত অঙ্গার মুষ্টিবদ্ধ করে রাখার মতো কষ্টকর হবে। এ সময় যথার্থ কাজ সম্পদানকারীকে তার মতই পঞ্চাশজনের সমান পুরস্কার দেয়া হবে।’ (সুনান আবু দাউদ: ৪৩৪১)
সঙ্গী নির্বাচনে সতর্কতা: ‘মানুষ তার বন্ধুর রীতিনীতির (দ্বীন ধর্মের) অনুসারী হয়। কাজেই তোমাদের প্রত্যেকেই যেন লক্ষ্য করে, সে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে।’ (সুনান আবু দাউদ: ৪৮৩৩)
ফিতনা দেখলে সরে যাওয়া: ‘যে ব্যক্তি ফিতনার দিকে তাকাবে, ফিতনা তাকে ঘিরে ধরবে। তখন কেউ যদি কোনো আশ্রয়ের জায়গা কিংবা নিরাপদ জায়গা পায়, তাহলে সে যেন আত্মরক্ষা করে।’ (বুখারি: ৭০৮১)
চুপ থাকা ও ইস্তেগফার করা: ‘নিজের জিহ্বা আয়ত্তে রাখবে, নিজের ঘরে পড়ে থাকবে এবং নিজের পাপের জন্য রোদন করবে।’ (মেশকাত: ৪৮৩৭)
সর্বোপরি সুন্নাহ আঁকড়ে ধরা: রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘আমি তোমাদের মধ্যে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যা অবলম্বন করলে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। তা হলো আল্লাহর কিতাব এবং আমার সুন্নাহ।’ (মুসতাদরাকে হাকেম: ৩১৯)
নবীজির (সা.) ভবিষ্যদ্বাণীকৃত এই ফিতনাগুলো আজ বাস্তবের পরতে পরতে দৃশ্যমান। কিন্তু ভয় নয়; সতর্কতা, সবর ও আল্লাহর দিকে ফিরে আসাই মুমিনের প্রকৃত ঢাল। আল্লাহর স্মরণে হৃদয় স্থির রাখা, নামাজে দৃঢ় থাকা, তাওবা ও ইস্তেগফারে অবিচল থাকা—এটাই এই সময়ের সবচেয়ে বড় কাজ। এক হাদিসে নবীজি এই কথা তিনবার বলেছেন- ‘সৌভাগ্যবান ওই ব্যক্তি যাকে ফিতনা থেকে দূরে রাখা হয়েছে’ (মেশকাত: ৫৪০৫)
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে এই ভয়াবহ ফিতনার যুগে ঈমানের সঙ্গে টিকে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।