ধর্ম ডেস্ক
১৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৪৬ পিএম
ইসলামের ইতিহাসে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর মক্কা জীবনের একটি বিশেষ অধ্যায়কে ‘কষ্টের ত্রিবর্ষ’ নামে স্মরণ করা হয়। নবুয়তের সপ্তম থেকে দশম বছর পর্যন্ত এই সময়টিতে তিনি এমন সব পরীক্ষার সম্মুখীন হন, যা মানবীয় সহনশীলতার সীমাকেও অতিক্রম করে।
নবুয়তের সপ্তম বছরে কুরাইশ নেতারা ইসলাম বিস্তার রোধে শেষ পদক্ষেপ হিসেবে বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিব গোত্রের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবরোধ’ ঘোষণা করে। মূলত তারা রাসুল (স.)-কে হত্যা বা থামাতে ব্যর্থ হয়ে আশ্রয়দাতা গোত্র বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিবের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল, যাতে তারা রাসুল (স.)-কে তাদের হাতে তুলে দেয়। কিন্তু চাচা আবু তালিবের নেতৃত্বে গোত্রদ্বয় রাসুলকে রক্ষা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল।
কুরাইশদের এই নিষ্ঠুর সিদ্ধান্তকে লিখিত আকারে কাবা প্রাঙ্গণে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। তাতে লেখা ছিল- বনু হাশিমের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখা যাবে না, তাদের সঙ্গে বিয়ে-শাদি নিষিদ্ধ, কোনো প্রকার ক্রয়-বিক্রয় বন্ধ এবং সম্পর্ক ছিন্ন করা বাধ্যতামূলক।
এই তিন বছর রাসুলুল্লাহ (স.) ও তাঁর অনুসারীরা চরম কষ্ট ভোগ করেন। ক্ষুধার যন্ত্রণায় সাহাবায়ে কেরাম গাছের পাতা ও পশুর চামড়া সিদ্ধ করে খেতেন। ওই উপত্যকা থেকে ক্ষুধার্ত শিশুদের কান্না শোনা যেত। তখন তারা সমাজ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন: নবীজিকে যেভাবে দুনিয়া থেকে সরাতে চেয়েছিল ইহুদি নারী
অবশেষে আল্লাহর কুদরতে অবরোধপত্রটি পোকায় খেয়ে ফেলে, কেবল ‘বিসমিকা আল্লাহুম্মা’ লেখা অংশ ছাড়া। এই অলৌকিক ঘটনায় প্রভাবিত হয়ে কুরাইশ নেতারা অবরোধ তুলে নিতে বাধ্য হয়।
অবরোধ শেষ হতেই রাসুলুল্লাহ (স.)-এর জীবনে নেমে আসে আরেক ভয়াবহ অধ্যায় ‘দুঃখের বছর’। এই বছর চাচা আবু তালিব ও প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা (রা.)-এর মৃত্যু হয়। খাদিজা (রা.) ছিলেন ইসলামের প্রথম বিশ্বাসী, রাসুল (স.)-এর মানসিক আশ্রয়, সবচেয়ে বড় সমর্থক এবং আর্থিক সহায়তার উৎস। আর আবু তালিব ছিলেন নবীজির গোত্রীয় রক্ষক ও কুরাইশদের বিরুদ্ধে একমাত্র ঢালস্বরূপ। তাঁর মৃত্যুতে নবীজির সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ও বিলীন হয়ে যায়। এক বছরে এই দুই প্রিয়জনকে হারিয়ে রাসুলুল্লাহ (স.) সম্পূর্ণ একাকী হয়ে পড়েন। ব্যক্তিগত সান্ত্বনা ও সামাজিক সুরক্ষা—উভয়টিই হারান তিনি। ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেছেন, আবু তালেবের ইন্তেকালের পর কুরাইশরা নবী (স.)-এর ওপর এত বেশি নির্যাতন চালিয়েছিল, যা তাঁর জীবদ্দশায় তারা চিন্তাও করতে পারেনি। (ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪১৬)
আরও পড়ুন: হিজরতের রাত: কোরাইশ হত্যাকারীদের চোখের সামনেই কিভাবে রওনা হলেন নবীজি
এই সময় নবীজি (স.) নতুন সমর্থন খুঁজে বের করার আশায় ‘তায়েফে’ যাত্রা করেন। কিন্তু সেখানে তাঁকে স্বাগত জানানো হয়নি; বরং তাঁকে কঠিনভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়, অপমান করা হয়, শিশুদের দিয়ে পাথর নিক্ষেপ করানো হয়। রক্তাক্ত অবস্থায় তিনি মক্কায় ফিরে আসেন। এটি ছিল নবীজির জীবনের সবচেয়ে বেদনাদায়ক মুহূর্তগুলোর একটি।
ঠিক এই সময়েই আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় হাবিবকে দান করেন সর্বোচ্চ সান্ত্বনা- ইসরা ও মেরাজের মহা সফর। ‘পবিত্র তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে রজনীযোগে ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখাবার জন্য।’ (সুরা ইসরা: ১) অন্য আয়াতে এসেছে, ‘তার দৃষ্টি বিভ্রম হয়নি, দৃষ্টি লক্ষ্যচ্যুতও হয়নি। অবশ্যই তিনি তাঁর রবের মহান নিদর্শনাবলীর কিছু দেখেছিলেন (সুরা নাজম: ১৭-১৮)
আরও পড়ুন: হিজরতের সময় যেভাবে আবু জেহেলরা সবাই অন্ধ হয়ে গিয়েছিল
ইতিহাসবিদদের মতে, এই তিন বছর ছিল নবীজির জীবনের ‘পরীক্ষার চূড়ান্ত অধ্যায়’। এই দুঃসহ অভিজ্ঞতাই মদিনায় ইসলামের বিজয়ের ভিত্তি স্থাপন করেছিল।
প্রিয়নবী (স.)-এর জীবন আমাদের শেখায়- কষ্টই আত্মিক ও সামাজিক উন্নতির সোপান। আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় বান্দাদের বড় পুরস্কারের আগে বড় পরীক্ষায় ফেলেন।
সূত্র: আর-রাহিকুল মাখতুম; নবীয়ে রহমত; আস-সিরাতুন নবাবিয়্যা; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া