images

ইসলাম

নবীজির মোজেজা: চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ

ধর্ম ডেস্ক

০৪ জুলাই ২০২৫, ০৬:৪৪ পিএম

ইসলামের ইতিহাসে নবী মুহাম্মদ (স.)-এর মোজেজাগুলোর মধ্যে ‘শাক্কুল কামার’ (চন্দ্রবিদারণ) সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনাগুলোর একটি। এই মোজেজা শুধু ইসলামি সূত্রেই নয়, বরং অন্যান্য ধর্মীয় ঐতিহ্য এবং আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায়ও সমর্থিত। এই প্রতিবেদনে আমরা এই অলৌকিক ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ, বিভিন্ন সভ্যতার ঐতিহাসিক রেকর্ড এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণাগুলো পর্যালোচনা করব।

১. কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত ঘটনা

কোরআনের সাক্ষ্য: সুরা আল-কামারের প্রথম আয়াতে আল্লাহ বলেন- ‘কেয়ামত নিকটবর্তী হয়েছে এবং চন্দ্র বিদীর্ণ হয়েছে। তারা যদি কোনো নিদর্শন দেখে তবে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে, ‘এটা তো প্রবল যাদু!’ (সুরা আল-কামার: ১-২)

এই আয়াত সরাসরি মক্কার কাফিরদের সামনে সংঘটিত চন্দ্রবিদারণের ঘটনাকে নির্দেশ করে।

হাদিসে যা বলা হয়েছে: সহিহ হাদিসগ্রন্থগুলোতে এই মোজেজার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন, ‘মক্কাবাসীরা রাসুলুল্লাহ (স.)-কে বলল, ‘আপনি যদি সত্যিই নবী হন, তাহলে চাঁদকে দু'ভাগ করে দেখান।’ তখন নবীজি আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন এবং চাঁদ দু’ভাগ হয়ে গেল।’ (সহিহ বুখারি: ৩৬৩৭)

অন্য হাদিসে হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) বর্ণনা করেন, মক্কাবাসীরা রাসুল (স.)-এর কাছে কোনো নিদর্শন দেখতে চাইল। তখন আল্লাহ তাআলা চন্দ্রকে দ্বিখণ্ডিত করে দেখিয়ে দিলেন। তারা দেখতে পেল যে, চাঁদের দুই খণ্ড হেরা পাহাড়ের দুই পার্শ্বে চলে গেছে। (সহিহ বুখারি: ১/৫৪৫; সহিহ মুসলিম: ২/৩৭৩; জামে তিরমিজি: ৩২৮৫; মুসনাদে আহমদ: ৩/১৬৫)

আরও পড়ুন: নবীজির যে মোজেজা দেখে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) ঈমান এনেছিলেন

ইবন মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সঙ্গে মিনায় ছিলাম। এমন সময় চাঁদ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ল- একটি অংশ পাহাড়ের ওদিকে অপর অংশটি এদিকে। রাসুলুল্লাহ (স.) আমাদের বললেন- (اِقۡتَرَبَتِ السَّاعَۃُ وَ انۡشَقَّ الۡقَمَرُ) ‘কেয়ামত আসন্ন, চন্দ্র বিদীর্ণ হল (সুরা কামার: ১) আয়াতটির মর্ম এই। (সুনানে তিরমিজি: ৩২৮৫)

২. অন্যান্য ঐতিহাসিক উৎস

এই অলৌকিক ঘটনা শুধু মুসলিম ঐতিহ্যেই নয়, বরং অন্যান্য ধর্ম ও সভ্যতার ইতিহাসেও কিছুটা প্রতিফলিত হয়েছে।

ক. হিন্দু ধর্মের প্রাচীন পুঁথিতে উল্লেখ: ভারতের কেরালা রাজ্যের মহারাজা চক্রবর্তী থিরুমুনালপাদের (৯-১০ম শতাব্দী) একটি প্রাচীন সংস্কৃত পাণ্ডুলিপিতে এই ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। এতে বলা হয়েছে- ‘মালাবার অঞ্চলের মানুষ একটি আশ্চর্য ঘটনা দেখেছিল—চাঁদ দু’ভাগ হয়ে গিয়েছিল এবং পুনরায় একত্রিত হয়েছিল।’ (The Cambridge History of India, Vol. 3, p. 152)

এছাড়াও, কাশ্মীরের রাজতরঙ্গিনী নামক প্রাচীন হিন্দু ইতিহাসগ্রন্থে (১২শ শতাব্দী) ৬২০ খ্রিস্টাব্দের দিকে চাঁদে একটি অস্বাভাবিক ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

খ. চীনা প্রাচীন রেকর্ড: চীনের ট্যাং রাজবংশের (৬১৮-৯০৭ খ্রিস্টাব্দ) দাপ্তরিক ইতিহাসে (Old Tang Annals) লেখা আছে- ‘সম্রাটের শাসনামলে (৬২০ খ্রিস্টাব্দে) চাঁদ অদ্ভুতভাবে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল এবং পরে আবার জোড়া লেগেছিল।’ (The Moon's Split: A Study of a Miracle in Early Islam- Dr. Muhammad Hamidullah)

গ. ইউরোপীয় মধ্যযুগীয় রেকর্ড: বাইজেন্টাইন ও মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় কিছু ঐতিহাসিক গ্রন্থেও এই সময়কালে চাঁদে একটি অদ্ভুত ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যদিও তারা এটিকে ‘জ্যোতির্বিদ্যার অস্বাভাবিক ঘটনা’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছে।

আরও পড়ুন: মসজিদুল আকসা নিয়ে নবীজির মোজেজা

৩. আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা

ক. নাসার স্যাটেলাইট ইমেজ ও ‘রিমা অ্যারিডাইয়াস’: ২০০৭ সালে নাসার লুনার রিকনাইস্যান্স অরবিটার (LRO) চাঁদের পৃষ্ঠে একটি বিশাল ও গভীর ফাটল শনাক্ত করে, যার নাম ‘Rima Ariadaeus’। বিজ্ঞানীরা এই ফাটলের কারণ নিয়ে বিভক্ত। কিছু বিজ্ঞানী একে প্রাকৃতিক ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার ফল বলে মনে করেন। অন্যদিকে, কিছু গবেষক (যেমন ড. জাকির নায়েক) উল্লেখ করেন যে, এই ফাটলের গঠন স্বাভাবিক ভূতাত্ত্বিক ফাটল থেকে ভিন্ন এবং এটি একটি আকস্মিক ও অপ্রাকৃতিক বিভাজনের ইঙ্গিত দেয়।

খ. জিওলজিক্যাল স্টাডিজ: জার্নাল অফ জিওফিজিক্যাল রিসার্চে প্রকাশিত এক গবেষণায় (২০১১) বলা হয়েছে, চাঁদের কিছু অংশের শিলাস্তরে অস্বাভাবিকভাবে তীক্ষ্ণ ও সোজা বিভাজন রেখা রয়েছে, যা সাধারণ ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হওয়া সম্ভব নয়।

৪. ঐতিহাসিক ও যুক্তিগত বিশ্লেষণ

ক. কেন এই ঘটনা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত হয়নি?: এই ঘটনা রাতের বেলা সংঘটিত হয়েছিল, তাই সব অঞ্চলের মানুষ এটি দেখেনি। প্রাচীন যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্বল ছিল, তাই ঘটনাটি সব সভ্যতায় ছড়ায়নি। অনেক ঐতিহাসিক এটিকে ‘জ্যোতির্বিদ্যার অস্বাভাবিকতা’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।

আরও পড়ুন: নবীজির বক্ষ বিদারণ কতবার হয়েছিল

খ. ইসলামি পণ্ডিতদের ব্যাখ্যা: ইমাম ইবনে কাসির (রহ.) তাঁর তাফসিরে লিখেছেন- ‘এই মোজেজা শুধু চোখে দেখা ঘটনা নয়, বরং এটি নবুয়তের সত্যতার একটি স্থায়ী প্রমাণ।’ (তাফসির ইবনে কাসির, সুরা আল-কামার)

৫. সিদ্ধান্ত ও শিক্ষা

চন্দ্রবিদারণের ঘটনা শুধু একটি অলৌকিক ঘটনা নয়, বরং এটি মহানবী মুহাম্মদ (স.)-এর সত্যতার জ্বলন্ত প্রমাণ। এটি প্রমাণ করে যে আল্লাহর ক্ষমতা সকল প্রাকৃতিক নিয়মের ঊর্ধ্বে। বিভিন্ন সভ্যতার ঐতিহাসিক রেকর্ড এবং আধুনিক বিজ্ঞান এই ঘটনাকে সমর্থন করে।