images

ইসলাম

স্বামী-স্ত্রীর সংসারে বদনজর, রুকইয়ার পদ্ধতি কী

ধর্ম ডেস্ক

২০ মে ২০২৫, ১০:৪০ এএম

ইসলামে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে, যা একে অপরের উপর স্নেহ, প্রেম, এবং আস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকে। কিন্তু কখনো কখনো সংসারে অশান্তি, বিরোধ, এবং দুরত্ব সৃষ্টি হতে পারে। এর পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে, তবে ইসলামি শিক্ষায় বিশেষভাবে বদনজর বা হিংসা থেকে সংসারে অশান্তি আসতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বদনজর থেকে মুক্তির জন্য রুকইয়াহ পদ্ধতি ইসলামি শিক্ষা অনুযায়ী অত্যন্ত কার্যকর এবং এটি কোরআন ও সহিহ হাদিস দ্বারা সমর্থিত। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেছেন, বদনজর লাগা একটি সত্য ব্যাপার। (আবু দাউদ: ৩৮৭৯)

বদনজর কী এবং এর প্রভাব

বদনজর এমন এক ধরনের ক্ষতিকর দৃষ্টি যা ঈর্ষা বা হিংসা থেকে উদ্ভূত হয় এবং এর মাধ্যমে একজন ব্যক্তি অন্যকে অজান্তে ক্ষতি করতে পারে। বদনজর একটি বাস্তব ঘটনা এবং ইসলামে এটি এক ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব হিসেবে চিহ্নিত। এটি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করতে পারে এবং সংসারে ঝগড়া বা সম্পর্কের অবনতির কারণ হতে পারে।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- وَإِن يَكَادُ الَّذِينَ كَفَرُوا لِيُزْلِقُونَكَ بِأَبْصَارِهِمْ لَمَّا سَمِعُوا الذِّكْرَ وَيَقُولُونَ إِنَّهُ لَمَجْنُونٌ ‘আর যারা কুফরি করেছে তারা প্রায় আপনাকে চোখের দৃষ্টির মাধ্যমে ফাঁকি দিতে চায় যখন তারা কোরআন শোনে এবং তারা বলে- নিশ্চয়ই সে পাগল।’ (সুরা কলম: ৫১)

এ আয়াতে আল্লাহ বদনজরের প্রভাবের বিষয়ে ইঙ্গিত করেছেন, যেখানে কুফরি (অবিশ্বাসী) লোকেরা বদনজরের মাধ্যমে নবী (স.)-এর ক্ষতি করতে চেয়েছিল।

আরও পড়ুন: স্বামী-স্ত্রী কে কোন পাশে ঘুমানো সুন্নত?

রুকইয়াহ কী এবং এর গুরুত্ব

রুকইয়াহ হলো মাসনুন (কোরআন-হাদিসে উল্লেখিত) কালাম বা দোয়াগুলো পড়ে মানুষের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব (যেমন বদনজর, জাদু, শয়তানি প্রভাব) থেকে মুক্তির পদ্ধতি। এটি আল্লাহর অনুমতি ও সাহায্য নিয়ে কার্যকর হয় এবং ইসলামে এর গুরুত্ব অনেক বেশি। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) বিষাক্ত প্রাণীর দংশন, বদনজর ও ব্রণ-ফুসকুড়ি (pimple) সারাতে ঝাড়ফুঁক করার অনুমতি দিয়েছেন। (ইবনে মাজাহ: ৩৫১৬)

এছাড়া, আল্লাহর রাসুল (স.) বদনজর এবং জাদু থেকে মুক্তি পেতে রুকইয়াহ পদ্ধতি ব্যবহার করতেন, এবং এর মাধ্যমে তিনি সাহাবিদেরও সাহায্য করেছেন। এর মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কও পুনরায় মধুর এবং সুশৃঙ্খল হতে পারে।

রুকইয়াহ পদ্ধতির উপাদান

রুকইয়াহ পদ্ধতির মাধ্যমে বদনজর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কোরআনের কিছু বিশেষ আয়াত এবং সহিহ হাদিস অনুসরণ করা হয়। নিচে সেগুলো তুলে ধরা হলো।

আরও পড়ুন: অসুস্থ স্ত্রীর সেবা করলে যে সওয়াব

আয়াতুল কুরসি (সুরা বাকারা ২৫৫)
আয়াতুল কুরসি পৃথিবী ও আকাশের সকল দুর্বিষহ শক্তি থেকে রক্ষা করে এবং যেকোনো ধরণের খারাপ প্রভাব প্রতিহত করতে সক্ষম। এই আয়াতটি নিয়মিত পড়া স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের জন্য খুবই কার্যকর। রাসুল (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আয়াতুল কুরসি রাতের শেষ অংশে পড়ে, আল্লাহ তার জন্য একজন সুরক্ষাকারী ফেরেশতা নিয়োগ করেন।’ (সহিহ বুখারি: ৫০১০)

সুরা ইখলাস, ফালাক ও নাস 
এই তিন সুরা বদনজর, শয়তানের অনিষ্ট ও অন্যান্য ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। নিয়মিত সুরাগুলো পড়লে আল্লাহ তাঁর বান্দাকে সকল খারাপ প্রভাব থেকে রক্ষা করেন। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যা সুরা ইখলাস ও এই দুই সুরা (ফালাক, নাস) পড়বে সে সকল বিপদ-আপদ থেকে নিরাপদ থাকবে। (জামে তিরমিজি: ২৯০৩)

বিশেষ দোয়া ও রুকইয়াহ পানি

এক গ্লাস পানি নিয়ে কোরআনের উল্লেখিত আয়াতগুলো পড়ে তাতে ফুঁ দিয়ে সেই পানি পান করা, বা স্নানে ব্যবহার করাও কার্যকর। (সূত্র: ইবনে মাজাহ: ৩৫০৯)

আরও পড়ুন: রোগমুক্তিতে কার্যকর কোরআনের ৬ আয়াত

স্বামী-স্ত্রীর জন্য রুকইয়াহ পদ্ধতি

জিকির ও দোয়া
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে সুস্থতা বজায় রাখতে, একে অপরকে নিয়মিত জিকির ও দোয়া করা উচিত। বিশেষভাবে بارك الله لكما وبارك عليكما وجمع بينكما في خير দোয়া করা যেতে পারে, যা সংসারে শান্তি, বরকত এবং ভালোবাসা বৃদ্ধি করে। (ইবনু মাজাহ: ২৯০৫, তিরমিজি: ১০৯১)

অন্তরঙ্গতা বজায় রাখা
স্বামী-স্ত্রী একে অপরের প্রতি সম্মান ও বিশ্বাস রেখে সম্পর্কের মধ্যে স্নেহ বজায় রাখুন। নিয়মিত নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত ও দোয়া সংসারের সুখ-শান্তি নিশ্চিত করবে। স্বামী স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা দেখলে শয়তান সরে যায়। অন্যদিকে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে টানাপোড়েন দেখলে দেখলে সে খুবই আনন্দিত হয়। (মুসলিম: ৭২৮৪; আহমদ: ১৪৩৭৭)

সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় ঘরে দোয়া ও জিকিরের চর্চা করুন
সকাল-সন্ধ্যায় দোয়া ও জিকিরে অভ্যস্থ হলে ওই সংসারকে সবরকম বিপদাপদ ও অনিষ্ট থেকে আল্লাহ নিরাপদ রাখেন। তাই সকাল-সন্ধ্যার মাসনুন দোয়াগুলো পড়ার অভ্যাস করুন।

রুকইয়ার পানি তৈরি ও ব্যবহার
কোররআনের নির্দিষ্ট আয়াত পড়ে পানি, অলিভ ওয়েল বা গোলাপজলে ফুঁ দিন। এটি দিয়ে স্বামী-স্ত্রী গোসল করতে পারেন বা পান করতে পারেন প্রতিদিন। এতে বদনজরের প্রভাব দূর হতে থাকে। সহাবিরা রাসুলুল্লাহ (স.)-এর অনুমতি নিয়ে রুকইয়া করতেন, এবং তিনি বলতেন, তোমরা রুকইয়া করো, যদি তাতে শিরক না থাকে। (সহিহ মুসলিম: ৫৫৪৪)

ঘরে সুরা বাকারা তেলাওয়াতের চর্চা
ঘরে রাতে সুরা বাকারা তেলাওয়াতে অভ্যস্থ হোন। এতে শয়তানের যাবতীয় অনিষ্ট বেঁচে থাকা যায়। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘তোমরা তোমাদের ঘরগুলোকে কবর বানিও না। যে ঘরে সুরা বাকারা পড়া হয় সে ঘর থেকে শয়তান পালিয়ে যায়।’ (সহিহ মুসলিম: ৭৮০)

রুকইয়াকারীর সহায়তা নেওয়া (যদি প্রভাব বেশি হয়)
নিজে ঘরে আমল করার পাশাপাশি কারো মাধ্যমে সহিহ রুকইয়া করানো যেতে পারে। অবশ্যই বিদআত বা শিরকমুক্ত ইসলামি রুকইয়ার চর্চাকারি বেছে নিন।

বিসমিল্লাহ, ইনশাআল্লাহ, মাশাআল্লাহ’র চর্চা করুন
বিসমিল্লাহ অর্থ আল্লাহর নামে শুরু, ইনশাআল্লাহ অর্থ আল্লাহর ইচ্ছায় এবং মাশাআল্লাহ অর্থ আল্লাহ যা ইচ্ছা করেছেন এই পবিত্র শব্দগুলো মর্ম ও ফজিলত বিস্ময়কর। এগুলো আল্লাহর ইচ্ছার বাইরের ইচ্ছাগুলোকে প্রতিহত করে। দুষ্ট জ্বিন ও মানুষের যেকোনো অনিষ্ট থেকে রক্ষা করতে এসব শব্দ কার্যকরি ভূমিকা রাখে।

বদনজর বা হিংসা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ইসলামি পদ্ধতি হিসেবে রুকইয়াহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোরআন ও হাদিসের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীদের মধ্যে যদি এমন কোনো প্রভাব সৃষ্টি হয়, তবে রুকইয়াহ পদ্ধতি তাদের সম্পর্ককে পুনরায় সুস্থ ও সুষ্ঠু করে তুলতে সাহায্য করবে। আল্লাহর সাহায্য চেয়ে নিয়মিত রুকইয়াহ পদ্ধতি অনুসরণ করলে আল্লাহর ইচ্ছায় সংসারের শান্তি ও ভালোবাসা বজায় রাখা সম্ভব।