ধর্ম ডেস্ক
১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৩৭ পিএম
শিশুরা নিষ্পাপ। যে ঘরেই সে জন্মগ্রহণ করুক, তার কোনো পাপ নেই। ইসলামি শরিয়তমতে, মুসলিম-অমুসলিম যার ঔরসেই সন্তানের জন্ম হোক, নাবালেগ অবস্থায় সে একজন মুসলমান। পরে বড় হলে পিতা-মাতা ও পরিবেশ তাকে ইহুদি খ্রিস্টান বা মুশরিক বানায়। এ সম্পর্কে আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদিসে এসেছে- كُلُّ مَوْلُودٍ يُولَدُ عَلَى الفِطْرَةِ، فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ، أَوْ يُنَصِّرَانِهِ، أَوْ يُمَجِّسَانِهِ، كَمَثَلِ البَهِيمَةِ تُنْتَجُ البَهِيمَةَ هَلْ تَرَى فِيهَا جَدْعَاءَ ‘রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, প্রত্যেক নবজাতক ফিতরাতের ওপর (মুমিন হিসেবে) জন্মগ্রহণ করে। এরপর তার মাতাপিতা তাকে ইহুদি বা খ্রিস্টান বা অগ্নি উপাসক বানায়। যেমন চতুষ্পদ জন্তু একটি পূর্ণাঙ্গ বাচ্চা জন্ম দেয়। তোমরা কি তাকে (জন্মগত) কানকাটা দেখেছ? (বুখারি: ১৩৮৫)
অতএব, অমুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া সন্তান যদি নাবালেগ অবস্থায় মারা যায়, তাহলে সে জান্নাতি হবে এবং তার কোনো শাস্তি নেই। সহিহ বুখারিতে মেরাজের ঘটনা সংক্রান্ত এক দীর্ঘ হাদিসের এক পর্যায়ে এসেছে-‘আমরা চলতে চলতে একটি সবুজ বাগানে উপস্থিত হলাম। এতে একটি বড় গাছ ছিল। গাছটির গোড়ায় একজন বয়োবৃদ্ধ লোক ও বেশ কিছু বালক বালিকা ছিল..।’ এই হাদিসের পরের অংশেই বলা হয়েছে- গাছের গোড়ায় যে বৃদ্ধ ছিলেন, তিনি ইবরাহিম (আ.) এবং তাঁর চারপাশের বালক-বালিকারা ছিল আওলাদুন্নাস বা মানুষের সন্তান। (সহিহ বুখারি: ১৩৮৬, ইফাবা-১৩০৩)
হাদিসের বক্তব্য অনুযায়ী, মানুষের শিশু সন্তানরা জান্নাতে ইবরাহিম (আ.)-এর কাছে থাকবে এবং মুসলিম-অমুসলিম সব বাচ্চাই এর শামিল। এ কারণেই ইমাম নববি (রহ) মুসলিম-অমুসলিম সব বাচ্চাকেই জান্নাতি হওয়ার বক্তব্যকে বিশুদ্ধ বলেছেন। (শরহে মুসলিম, খণ্ড ২, হাদিস ৩৩৭, ৭/২৭১৬, ২৭১৭)
আরও পড়ুন: জাহান্নামের আগুন দেখবে না ৩ শ্রেণির মানুষ
তাছাড়া আল্লাহ তাআলা একজনের গুনাহের শাস্তি অন্যজনকে দেন না। যেমনটি পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে যে- وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَىٰ ‘একজনের প্রতিদান অন্যজনকে দেওয়া হবে না।’ ( সুরা ফাতির: ১৮)
তাই মা-বাবা ঈমান না আনার কারণে শিশুকে শাস্তি পেতে হবে না। ইমাম ইবনে হাযম (রহ) বলেছেন, ‘মুসলিম ও মুশরিকদের মৃত সন্তানদেরকে নিয়ে মতভেদ রয়েছে। খারেজিরা বিশ্বাস করে- সকল অমুসলিমদের সন্তান জাহান্নামি ও মুসলিমদের মধ্যে যারা গুনাহগার তাদের সন্তানও জান্নাতি। অপরদিকে অন্যদের মধ্যে অধিকাংশ বলেন যে সব নাবালেগ শিশু জান্নাতে যাবে এবং আমিও এটাই বলি।’ (আল-ফাসল ফি আল-মিলাল ওয়া আল-নিহাল: ৪/১২৭)
ইবনে আব্দুল বার (রহ) এই বিষয়ে উল্লেখ করেন যে, জমহুর ওলামার মত হচ্ছে- অমুসলিমদের সন্তানরা জান্নাতি হবে। কিছু আলেমদের মত হচ্ছে তাদের স্থান হবে আল-আরাফে (যা জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যবর্তী স্থান) এবং এই আল-আরাফবাসীদের চূড়ান্ত নিয়তি হচ্ছে তারা জান্নাতে স্থান পাবে। (আল তামহিদ: ১৮/৯৬)
ইমাম বুখারিও মুশরিকদের নাবালেগ সন্তানরা জান্নাতি—এই মতের পক্ষে ছিলেন, যা ইবনে হাজার আসকালানি (রহ) উল্লেখ করেছেন। (ফাতহুল বারি: ৩/২৯০)
আরও পড়ুন: মুসলিম হয়েও ইসলামে যার অংশ নেই
তবে আলেমদের একটি বড় অংশ এ ব্যাপারে মতভেদ করেছেন। তাঁদের মতে, অমুসলিমদের শিশুদেরকে আল্লাহ কেয়ামতের দিন পরীক্ষা করবেন। যারা পরীক্ষায় পাস করবে তাদেরকে জান্নাত দেওয়া হবে আর যারা পরীক্ষায় ফেল করবে তারা জাহান্নামি হবে। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া, ইবনুল কাইয়িম, ইবনে বায (রহ)-এর মতও এটি। (মাজমুউল ফতোয়া, ইবনে বায: ২/৭১২)
আলেমদের আরেকটি অভিমত হলো— অমুসলিম শিশুদের পরকালীন অবস্থা কেমন হবে তা একমাত্র আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন। কেননা এসম্পর্কে রাসুল (স.)-কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন- اللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا كَانُوا عَامِلِينَ بِهِ‘তারা (বড়ে হয়ে) কী আমল করত সে ব্যাপারে আল্লাহই ভালো জানেন।’ (বুখারি: ৬৫৯৭, মুসলিম: ২৬৬০)
এই হাদিসের ভিত্তিতে তারা বলেন যে, অমুসলিম শিশুদের জান্নাতে বা জাহান্নামে দেওয়া হবে কি না তা স্পষ্ট করে বলার অবকাশ নেই। অর্থাৎ তারা জান্নাতে যেমন যেতে পারে আবার জাহান্নামেও যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর উত্তরে ইবনে হাযম (রহ) বলেছেন, আল্লাহ জানেন যে তারা কী করবে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে তারা কাফের বা তাদেরকে জাহান্নামে দেওয়া হবে বা জান্নাতে দেওয়া হবে না। তারা বেঁচে থাকলে কী করত সেটার উপর ভিত্তি করে তাদেরকে দোষারোপ করা হবে না। (আল-ফাসল ফি আল-মিলাল ওয়া আল-নিহাল: ৪/১৩২-৩৩)
কেউ কেউ বলেছেন, অমুসলিম শিশুরা জান্নাতের সেবক হবে। এ অভিমতটির ব্যাপারেও সংশয় রয়েছে। ইবনে তাইমিয়া (রহ) বলেন, কিছু লোক বলেছেন কাফেরদের সন্তানরা জান্নাতবাসীদের দাস হবে। কিন্তু এই কথার কোনো ভিত্তি নেই। (মাজমুউল ফতোয়া: ৪/২৭৯)
মোটকথা, অপেক্ষাকৃত বিশুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য মত হলো—নাবালেগ শিশুরা মুসলিম বা অমুসলিম যা-ই হোক, তারা জান্নাতে যাবে। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে যেকোনো বিষয়ে হক চেনার তাওফিক দান করুন এবং হক কথার ওপর অটল থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।