images

ইসলাম

শিরক যে কারণে বড় জুলুম

ধর্ম ডেস্ক

১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৩১ পিএম

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা শিরককে বড় জুলুম বলে সাব্যস্ত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-  وَ اِذۡ قَالَ لُقۡمٰنُ لِابۡنِهٖ وَ هُوَ یَعِظُهٗ یٰبُنَیَّ لَا تُشۡرِكۡ بِاللّٰهِ ؕؔ اِنَّ الشِّرۡكَ لَظُلۡمٌ عَظِیۡمٌ ‘আর স্মরণ করুন সেই সময়ের কথা, যখন লুকমান উপদেশ দিয়ে তার পুত্রকে বলল, হে বৎস, আল্লাহর সঙ্গে শরিক করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা বড় জুলুম।’ (সুরা লুকমান: ১৩)

অন্যান্য আয়াতেও শিরকের বিরুদ্ধে মহান আল্লাহর কড়া হুঁশিয়ারি রয়েছে। যেমন এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন- اِنَّ اللّٰهَ لَا یَغۡفِرُ اَنۡ یُّشۡرَكَ بِهٖ وَ یَغۡفِرُ مَا دُوۡنَ ذٰلِكَ لِمَنۡ یَّشَآءُ ۚ وَ مَنۡ یُّشۡرِكۡ بِاللّٰهِ فَقَدِ افۡتَرٰۤی اِثۡمًا عَظِیۡمًا ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে ব্যক্তি তাঁর সঙ্গে শরিক করে। এ ছাড়া অন্য পাপ তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে শিরক করল, সে অত্যন্ত গুরুতর অপবাদ আরোপ করল।’ (সুরা নিসা: ৪৮)

শিরক অর্থ- অংশীদার করা, সহযোগী বানানো, সমকক্ষ করা ও সম্পৃক্ত করা। কার্যত এমন সব বিশ্বাস, কাজ, কথা ও অভ্যাসকে শিরক বলা হয়, যার দ্বারা মহান আল্লাহর রুবুবিয়্যাত (রব), উলুহিয়্যাত (ইলাহ), নাম ও গুণাবলীতে অপর কারো অংশীদারিত্ব বা সমকক্ষতা প্রতীয়মান হয়। আকিদার পরিভাষায়, শিরক হচ্ছে আল্লাহর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ও সীমাবদ্ধ কোনো বিষয় অন্যকারো জন্য করা। তাওহিদের সম্পূর্ণ বিপরীত দিকটি হচ্ছে শিরক।

আরও পড়ুন: শিরক না করার কারণে যেসব প্রতিদান পাবেন

জুলুমের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে, কারো অধিকার হরণ করা এবং ইনসাফবিরোধী কাজ করা। শিরক বড় জুলুম এ কারণে যে, মানুষ আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমন সব সত্তাকে নিজের স্রষ্টা, রিজিকদাতা ও নেয়ামতদানকারী হিসেবে বরণ করে, যাতে তাদের কোনো অংশই নেই। যাদের কোনো ভূমিকাই নেই। এটা এত বড় অন্যায়, যার চেয়ে বড় কোন অন্যায়ের কথা চিন্তাই করা যায় না। শুধু আল্লাহ তাআলার বন্দেগী করা এবং শিরক না করা বান্দার ওপর স্রষ্টার অধিকার। কিন্তু বান্দা যখন অন্যের বন্দেগি ও পূজা-অৰ্চনা করার মাধ্যমে তাঁর অধিকার হরণ করে, এর চেয়ে বড় জুলুম হতে পারে না। 

শিরক মহান আল্লাহর কাছে এতই জঘন্য অপরাধ যে, এর কারণে তিনি জান্নাত হারাম করে দেন। মহান আল্লাহ বলেন- اِنَّهٗ مَنۡ یُّشۡرِكۡ بِاللّٰهِ فَقَدۡ حَرَّمَ اللّٰهُ عَلَیۡهِ الۡجَنَّۃَ وَ مَاۡوٰىهُ النَّارُ ؕ وَ مَا لِلظّٰلِمِیۡنَ مِنۡ اَنۡصَارٍ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন। তার ঠিকানা জাহান্নাম। আর যারা (এরূপ) জুলুম করে তাদের কোনো রকমের সাহায্যকারী লাভ হবে না।’ (সুরা মায়েদা: ৭২)

আসলে যেকোনো গুনাহই নিজের প্রতি জুলুম। এজন্য মুমিনরা দোয়া মাসুরায় প্রার্থনা করে- ‘হে আল্লাহ আমি নিজের প্রতি অনেক জুলুম করেছি, আপনি ছাড়া ক্ষমা করার কেউ নেই।’ এ ধরনের গুনাহের চেয়ে অধিকতর বড় জুলুম হলো অন্য মানুষের অধিকার হরণ করা, অবিচার করা। এসবের চেয়েও জঘন্য জুলুম হলো- সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা। যে ব্যাপারে এখানে আলোচনা করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন: শিরক থেকে বাঁচতে যে দোয়া শিখিয়েছেন মহানবী (স.)

এই আয়াতটি যখন নাজিল হয়- اَلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ لَمۡ یَلۡبِسُوۡۤا اِیۡمَانَهُمۡ بِظُلۡمٍ اُولٰٓئِكَ لَهُمُ الۡاَمۡنُ وَ هُمۡ مُّهۡتَدُوۡنَ ‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং তাদের ঈমানের সঙ্গে জুলুমের (শিরকের) সংমিশ্রণ ঘটায়নি তাদের জন্যই নিরাপত্তা এবং তারা হেদায়েতপ্রাপ্ত।’ (সুরা আনআম: ৮২) তখন সাহাবিদের কাছে বিষয়টা খুব কঠিন মনে হলো। তারা বলতে লাগলেন, আমরা সবাই তো কোনো না কোনো জুলুম তথা গুনাহ করে ফেলি। একেবারে জুলুমমুক্ত আমাদের মধ্যে কে আছে?  রাসুল (স.) তাদের এ কথা শুনে বলেন, তোমরা ব্যাপারটাকে যেমন ভেবেছ বিষয়টা তেমন নয়। তোমরা কি দেখো না যে লুকমান তার ছেলেকে কী নসিহত করেছেন! তিনি বলেছেন, ‘হে প্রিয় বৎস, আল্লাহর সঙ্গে শিরক করবে না। মনে রেখো, শিরক সবচেয়ে বড় জুলুম।’ রাসুল (স.)-এর কথা ও লুকমান হাকিম (রহ.)-এর উপদেশ—এ দুইয়ের আলোকে এ কথা দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট যে এই পৃথিবীতে আল্লাহর সঙ্গে শিরক করার চেয়ে বড় কোনো জুলুম তথা অপরাধ নেই। শিরক হচ্ছে সবচেয়ে বড় গুনাহ। 

শিরক থেকে বেঁচে থাকা বান্দার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি বিষয়। এর ফজিলত অনেক বেশি। হাদিসে কুদসিতে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে আদম সন্তান, তুমি যদি পৃথিবী পরিমাণ গুনাহ নিয়ে আমার কাছে আসো এবং আমার সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক না করে থাকো, তাহলে আমিও সমপরিমাণ ক্ষমা নিয়ে তোমার কাছে আসব।’ (সুনানে তিরমিজি: ৪০৩৫)

উল্লেখিত হাদিসে আল্লাহ এমন ব্যক্তিদের জন্য ক্ষমার ঘোষণা দিয়েছেন, যারা আল্লাহর সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করে না এবং আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি নিখাদ বিশ্বাস লালন করে। সুতরাং মুমিনের জন্য ঈমান-ইবাদতসহ জীবনের সর্বত্র শিরক পরিহার করা আবশ্যক। স্মরণ রাখতে হবে, অনেক শিরক আছে, যা খুবই সূক্ষ্ম। যার কারণে বেশির ভাগ মানুষ ঈমান আনার পরও মুশরিক। পবিত্র কোরআনে বিষয়টি এসেছে এভাবে- ‘আবার অনেক মানুষ আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে, কিন্তু তারা শিরক করে। (সুরা ইউসুফ: ১০৬)

আরও পড়ুন: নামাজের মধ্যেও মানুষ শিরক করে যেভাবে

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে কাসির বলেন, যেসব মুসলিম ঈমান থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন প্রকার শিরকে লিপ্ত রয়েছে, তারাও এ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত। এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, আমি তোমাদের জন্য যেসব বিষয়ের আশঙ্কা করি, তন্মধ্যে সবচাইতে বিপজ্জনক হচ্ছে ছোট শিরক। সাহাবায়ে কেরামের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, রিয়া (লোক দেখানো ইবাদাত) হচ্ছে ছোট শিরক। (মুসনাদে আহমদ: ৫/৪২৯) এমনিভাবে অন্য হাদিসে আল্লাহ ছাড়া অন্যের কসম করাকেও শিরক বলা হয়েছে। (সহিহ ইবনে হিব্বান: ১০/১৯৯, হাদিস: ৪৩৫৮) আল্লাহ ছাড়া অন্যকারো নামে মান্নত করা এবং জবেহ করাও শিরকের অন্তর্ভুক্ত। (আবু দাউদ: ৩৩১৫; ইবনু মাজাহ: ২১৩০) কবর, মাজারকে আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম বানানো কিংবা তাদের পূজা করা জঘন্য শিরক। (সুরা যুমার: ৩)

প্রতিটি মুসলমানের উচিত, যেকোনো মূল্যে শিরকমুক্ত থাকার চেষ্টা করা। অতীতে শিরক হয়ে গেলে তার ওপর অনুতপ্ত হয়ে মহান আল্লাহর কাছে খাঁটি তাওবা করা। এবং আগামীতে কখনো এ ধরনের গুনাহে লিপ্ত না হওয়ার দৃঢ় সংকল্প করা। মহান আল্লাহ সবাইকে এ ধরনের গুনাহ থেকে দূরে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।