images

ইসলাম

মৃতের আত্মা ঊর্ধ্বাকাশে নেওয়ার সময় ফেরেশতারা যা করেন

ধর্ম ডেস্ক

২২ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:১৬ পিএম

মৃত্যু এক নির্মম সত্য। সকল প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। এরপর শুরু হবে অনন্তকালের পথ। এই যাত্রাপথ কারও জন্য হয় সুখের, কারও জন্য নরক-গহ্বর। যারা পাপে নিজের নফসকে কলুষিত করেছে, তারা চরম দুর্ভাগা। মৃত্যু থেকে বাঁচতে তারা প্রাণপণ চেষ্টা করে। কিন্তু মৃত্যুর ফেরেশতারা টেনেহিঁচড়ে তাদের প্রাণ বের করে নেন। পক্ষান্তরে পুণ্য ও সৎকাজে যারা জীবন আবাদ করে, তাদের মৃত্যু হয় সহজ ও স্বস্তিদায়ক। সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে তাঁদের প্রাণ হরণ করা হয়। ফেরেশতারা তাঁদের ‘আহলান সাহলান’ জানান। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘ফেরেশতারা যাদের মৃত্যু ঘটায় উত্তম অবস্থায়, তারা বলে, ‘তোমাদের উপর সালাম।’ (সুরা নাহল: ৩২)

প্রাণিদেহের ‘রূহ কবজ’ করার প্রধান দায়িতে থাকেন ‘মালাকুল মাউত’। কিন্তু তাঁর সহযোগী হিসেবে আরও কিছু ফেরেশতা সঙ্গে থাকেন। তাঁরা মালাকুল মাউতের নির্দেশ মেনে কাজ করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তিনিই স্বীয় বান্দাদের উপর পরাক্রমশালী এবং তিনিই তোমাদের রক্ষক প্রেরণ করেন। অবশেষে যখন তোমাদের কাহারও মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন আমার প্রেরিতরা তাহার মৃত্যু ঘটায় এবং তাহারা কোন ত্রুটি করে না।’ (সুরা আনয়াম: ৬১)

হজরত বারা ইবনে আজেব (রা.) থেকে বর্ণিত মুসনাদে আহমদে এক দীর্ঘ হাদিস বর্ণিত হয়েছে, যেখানে জান কবজ করা এবং এর পরের সময় ফেরেশতাদের কাজ নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। বর্ণিত হয়েছে, নিশ্চয়ই ঈমানদারের যখন দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে পরকালের পথে যাত্রার সময় ঘনিয়ে আসে, তখন উজ্জ্বল শুভ্র চেহারার ফেরেশতারা তাঁর কাছে নেমে আসেন। তাঁদের চেহারাগুলো যেন একেকটি সূর্য। তাঁদের সঙ্গে থাকে জান্নাতি কাফন ও জান্নাতি সুগন্ধি।তাঁরা তাঁর কাছে বসে পড়েন। তারপর মৃত্যুর ফেরেশতা এসে তাঁর মাথার পাশে বসে বলেন, হে পবিত্র আত্মা! আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টির দিকে বেরিয়ে এসো।

আরও পড়ুন: নিকৃষ্ট মৃত্যু থেকে রক্ষার বিশেষ আমল

রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, তারপর পাত্রের মুখ থেকে গড়িয়ে পড়া ফোঁটার মতো তাঁর আত্মা বেরিয়ে আসে। আজরাইল (আ.) সেই আত্মাকে বরণ করে নেন। আজরাইল (আ.) হাতে নেওয়ামাত্র চোখের পলকে অন্য ফেরেশতারা সেই আত্মা নিয়ে জান্নাতি কাফনে ও জান্নাতি সুগন্ধিতে রেখে দেন। তার থেকে মেশকের চেয়ে উত্তম সুগন্ধি ছড়িয়ে পড়ে, যা (কখনো কখনো) জমিনেও অনুভূত হয়।

রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, এরপর তাঁরা সেই আত্মা নিয়ে ঊর্ধ্বারোহণ করতে থাকেন। যখনই কোনো ফেরেশতা পাশ দিয়ে অতিক্রম করেন ফেরেশতারা জিজ্ঞেস করেন, এটা কার পবিত্র আত্মা? তাঁরা তাঁর নাম উল্লেখ করে বলেন, অমুকের ছেলে অমুক।

এভাবে তাঁরা প্রথম আসমানে পৌঁছেন। আসমানের দরজা খুলতে আহ্বান করেন। তাঁদের জন্য আসমানের দরজা খোলা হয়। এভাবে সব আসমানের ফেরেশতারা পরবর্তী আসমান পর্যন্ত তাঁর অনুসরণ করে বিদায় জানান। তারপর তিনি সপ্তম আসমানে পৌঁছে যান। তখন আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমার বান্দার আমলনামা ইল্লিয়্যিনে রেখে দাও এবং তাকে দুনিয়ায় ফিরিয়ে নাও। নিশ্চয়ই আমি তাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তাতেই ফিরিয়ে দেব এবং তার থেকে দ্বিতীয়বার বের করে আনব।’

রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, তারপর তাঁর রুহ তাঁর দেহে ফিরিয়ে আনা হয়। এরপর তাঁর কাছে দুজন ফেরেশতা আসেন। তাঁরা তাঁকে বসান। তাঁরা তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, তোমার রব কে? তিনি বলেন, আমার রব আল্লাহ। তাঁরা জিজ্ঞেস করেন, তোমার ধর্ম কী? তিনি বলেন, আমার ধর্ম ইসলাম। তাঁরা বলেন, তোমাদের কাছে পাঠানো এই লোকটি কে? তিনি বলেন, তিনি আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ (স.)। তাঁরা বলেন, তোমার জ্ঞানের উৎস কী? তিনি বলেন, আমি আল্লাহর কিতাব পড়েছি। তার ওপর ঈমান এনেছি এবং তা সত্যায়ন করেছি। তখন ঘোষণা আসে—‘আমার বান্দা সত্য বলেছে। তার জন্য জান্নাতের বিছানা বিছিয়ে দাও। তাকে জান্নাতের পোশাক পরিয়ে দাও। জান্নাতের দিকে তার জন্য একটি দরজা খুলে দাও।’

আরও পড়ুন: ৬ বিষয়ে বিশ্বাস না থাকলে মৃত্যু হবে বেঈমান হিসেবে

রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, এরপর তাঁর কাছে জান্নাতের সুঘ্রাণ ও সুরভি আসতে থাকে এবং তাঁর দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত কবর প্রশস্ত করে দেওয়া হয়। এরপর একজন সুদর্শন সুন্দর পোশাক পরিহিত ও সুগন্ধিযুক্ত লোক আগমন করে বলে, আনন্দদায়ক সুসংবাদ গ্রহণ করো। এটা সেই দিন, যার প্রতিশ্রুতি তোমাকে দেওয়া হয়েছে। তারপর সে বলবে, কে তুমি, হে কল্যাণকামী! সে বলবে, আমি তোমার নেক আমল (অর্থাৎ নেক আমল জীবন্ত হয়ে উঠবে)।

তারপর তিনি বলবেন, হে আমার রব! কেয়ামত কায়েম করুন, আমি যেন আমার পরিবার ও সম্পদের কাছে ফিরতে পারি।

রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন—যখন একজন কাফেরের দুনিয়া থেকে বিদায়ের এবং পরকালের পথে যাত্রার সময় ঘনিয়ে আসে, তখন আসমান থেকে অসুন্দর কিছু ফেরেশতা নেমে আসেন। তাঁদের সঙ্গে থাকে হামানদিস্তা। তাঁরা তার সামনে বসেন। তারপর মালাকুল মউত এসে তার মাথার কাছে বসেন। বলেন, হে অপবিত্র আত্মা! আল্লাহর রাগ ও অসন্তুষ্টির দিকে বেরিয়ে এসো। তারপর তিনি তার দেহে আঁচড়াতে শুরু করেন, যেভাবে ছুরিকে ভেজা পশমে আঁচড়ানো হয় এবং দেহ থেকে আত্মাকে উৎপাটন করে নিয়ে আসেন।

আজরাইল (আ.) তা হাতে নেওয়ামাত্র অন্য ফেরেশতারা সেই আত্মা হাতুড়িতে ভরে ফেলেন। তার থেকে মৃত পচা লাশের দুর্গন্ধ বের হয়, যা (কখনো কখনো) দুনিয়ার মানুষও অনুভব করে। তাঁরা একে নিয়ে ঊর্ধ্বারোহণ করেন। তাঁরা যখনই ফেরেশতাদের কোনো দলের পাশ দিয়ে অতিক্রম করেন, ফেরেশতারা জিজ্ঞেস করেন, এই নাপাক আত্মা কার? তখন তাঁরা দুনিয়ায় তার কুৎসিত নাম উল্লেখ করে বলেন, অমুকের ছেলে অমুক।

আরও পড়ুন: জান্নাত লাভের উপায় হবে সহজ ১৪ আমল

এভাবে তাঁরা প্রথম আসমানে পৌঁছেন। তার জন্য আসমানের দরজা খোলার আহ্বান করা হয়; কিন্তু তার জন্য দরজা খোলা হয় না। তারপর রাসুল (স.) এই আয়াত তেলাওয়াত করেন, যার অর্থ- ‘তাদের জন্য আসমানের দরজাগুলো খোলা হবে না এবং তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, যতক্ষণ না সুচের ছিদ্রপথে উট প্রবেশ করবে। ’ আল্লাহ তখন বলবেন—তার আমলনামা জমিনের সর্বনিম্নে সিজ্জিনে রেখে দাও। তারপর তার রুহ ছুড়ে ফেলা হয়। এরপর রাসুল (স.) কোরআনের আয়াত পাঠ করেন, যার অর্থ—এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে শরিক করল, সে যেন আকাশ থেকে ছিটকে পড়ল, অতঃপর মৃতভোজী পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল অথবা বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে কোনো দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করল। (সুরা হজ: ৩১)

তারপর তার রুহ দেহে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তার কাছে দুজন ফেরেশতা আসেন। তাঁরা তাকে বসান। তাঁরা তাকে জিজ্ঞেস করেন, তোমার রব কে? সে বলে, হায় আফসোস! আমি জানি না। তাঁরা জিজ্ঞেস করেন, তোমার ধর্ম কী? সে বলে, হায় আফসোস! আমি জানি না। তাঁরা বলেন, তোমাদের কাছে পাঠানো এই লোকটি কে? সে বলে, হায় আফসোস! আমি জানি না।

তখন আসমান থেকে একজন ঘোষক বলেন, ‘সে মিথ্যা বলেছে। তার জন্য জাহান্নামের বিছানা বিছিয়ে দাও। জাহান্নামের দিকে তার জন্য একটি দরজা খুলে দাও।’ ফলে তার কাছে জাহান্নামের উত্তাপ ও লু হাওয়া আসতে থাকে। তার কবর এতটা সংকীর্ণ করে দেওয়া হয় যে, তার এক পাঁজরের হাড়গুলো অন্য পাঁজরে ঢুকে যায়। তার কাছে একজন কুৎসিত চেহারা, দূষিত পোশাক ও দুর্গন্ধযুক্ত এক লোক এসে বলে, দুঃসংবাদ গ্রহণ করো। তোমাকে এই দিনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল।

আরও পড়ুন: কবরে যাদেরকে প্রশ্ন করা হবে না

সে বলবে, তুমি কে? অকল্যাণ নিয়ে এসেছ? লোকটি বলবে, আমি তোমার বদ আমল। তারপর সে বলবে, হে আমার রব! কেয়ামত যেন সংঘটিত না হয়। (মুসনাদে আহমদ: ১৮৫৫৭; ইবনুল কাইয়িম (রহ.) ‘ইলামুল মুওয়াক্কিঈন’ নামক কিতাবে (১/২১৪) এবং শাইখ আলবানি (রহ.) কিতাবুল জানাইজে (পৃষ্ঠা নং ১৫৯) এই হাদিসকে সহিহ বলেছেন)

সর্বাবস্থায় আমাদের উচিত, মৃত্যুকে স্মরণ করা। মৃত্যু যেন সহজ হয়, সেভাবে আমল ও ইবাদত-বন্দেগি করা। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তিনি (একমাত্র আল্লাহ) জীবন দান করেন এবং তিনিই মৃত্যু ঘটান। আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোনো অভিভাবক নেই, কোনো সাহায্যকারীও নেই।’ (সুরা তাওবা: ১১৬)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ে মৃত্যুর ভয় জাগ্রত করে নেক আমলের তাওফিক দিন এবং ভালো মৃত্যু দান করুন। আমিন।