ধর্ম ডেস্ক
২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৪:৩০ পিএম
আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে সৃষ্টির পর কখনও তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে অজ্ঞতায় রাখেননি। যুগে যুগে নবী-রাসুল প্রেরণের মধ্য দিয়ে তাদের জীবন পরিচালনার নির্দেশিকাও দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু স্রষ্টার এসব প্রতিনিধিদের এবং তাঁরই দেওয়া নির্দেশিকাকে যারা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজের নফসের বন্দেগি করেছে, তাদের আল্লাহ ধ্বংস করে দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি প্রত্যেককেই তার অপরাধের কারণে পাকড়াও করেছি। তাদের কারো প্রতি প্রেরণ করেছি প্রস্তরসহ প্রচণ্ড বাতাস, কাউকে পেয়েছে বজ্রপাত, কাউকে বিলিন করেছি ভূগর্ভে এবং কাউকে পরিণত করেছি সলিল সমাধিতে।’ (সুরা আনকাবুত: ৪০)
এখানে পবিত্র কোরআনের বর্ণনায় সাত জাতির ধ্বংস হওয়ার কারণগুলো তুলে ধরা হলো—
মুসা (আ.)-এর জাতি
হজরত মুসা (আ.) ছিলেন বনি ইসরাইল বংশের। প্রেরিত হয়েছিলেন ফেরাউন সম্প্রদায়ের কাছে। ফেরাউন একজন তাওহিদবিরোধী শক্তিশালী শাসক ছিল। নিজেকে সে আল্লাহ বলে দাবি করত। হজরত মুসা (আ.) যখন তাকে দ্বীনের দাওয়াত দেন, তখন সে মুসা (আ.)-কে মাতাল, জাদুকর, ইত্যাদি বলতে থাকে। ফেরাউনের অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে আল্লাহ তাআলা হজরত মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের লোহিত সাগরের ভেতর দিয়ে রাস্তা করে দিয়ে রক্ষা করেন। আর ফেরাউন ও তার অনুসারীদের ডুবিয়ে মারেন। আল্লাহ তাআ লা বলেন- ‘ফেরাউনের জাতিকে পানিতে ডুবিয়ে মারার মধ্যে রয়েছে আল্লাহ তাআলার কুদরতের মহানিদর্শন; কিন্তু তাদের অনেকেই বিশ্বাস করে না।’ (সূরা শুয়ারা: ৬৭)
ইবরাহিম (আ.)-এর জাতি
হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে আল্লাহ তাআলা প্রেরণ করেছিলেন নমরুদের কাছে। নমরুদ ছিল পুরো দুনিয়ার শাসক। মূর্তিপূজায় ডুবেছিল তার সব প্রজা। ইবরাহিম (আ.)- প্রথমে তাঁর পিতা আজর ও তাঁর জাতিকে মূর্তিপূজা বর্জন করতে বলেন। তারা প্রত্যুত্তরে বলল- আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের যে কাজের ওপর পেয়েছি তোমার কথায় তো ছাড়তে পারি না। নির্দিষ্ট দিনে তারা মেলায় চলে গেলে তিনি মূর্তিগুলো ভেঙে চুরমার করে, বড়টির কাঁধে কুঠার দিয়ে মূর্তির অসারতা প্রমাণ করলেন। এতে রাজা ক্ষুব্ধ হয়ে হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে আগুনে পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত নেয়। আল্লাহ তাআলা ইবরাহিম (আ.)-কে রক্ষা করেন। আর নমরুদ ও তার বাহিনীকে মশা দিয়ে ধ্বংস করেন। আল্লাহ তাআলা ইচ্ছা করলে ক্ষুদ্র প্রাণী দিয়েও শক্তিশালী জাতিকে ধ্বংস করে দিতে পারেন, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নমরুদের জাতি ধ্বংস হওয়া। তাফসিরের কিতাবে এসেছে, ‘কালো রঙের একটা মেঘ দেখা যাচ্ছিল, যখন সেটা কাছে চলে এলো, লাখ লাখ মশার গুনগুন শব্দে ময়দান মুখরিত হলো। কিন্তু নমরুদ অবজ্ঞার সুরে বলল, এ তো মশা! তুচ্ছ প্রাণী, তা-ও আবার নিরস্ত্র। এ সময়ের মধ্যে প্রত্যেক সৈন্যের মাথার ওপর মশা অবস্থান নিল। অতঃপর তাদের বুঝে ওঠার আগেই মশাগুলো তাদের নাক দিয়ে মস্তিষ্কে প্রবেশ করল। তারপর দংশন করা শুরু করল। সৈন্যদের মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হলো। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে তীরন্দাজরা ঊর্ধ্বে তীর নিক্ষেপ আর পদাতিক সেনারা নিজেদের চারপাশে অন্ধের মতো তরবারি চালাল, যার ফলে একে অপরকে নিজেদের অজান্তেই আহত বা নিহত করে ফেলল। মশার সঙ্গে যুদ্ধ চলাকালে নমরুদ পালিয়ে প্রাসাদে চলে এলো। এ সময় একটি দুর্বল লেংড়া মশা তাকে তাড়া করল এবং কিছুক্ষণ মাথার চারপাশে ঘুরে নাসিকাপথে মস্তিষ্কে ঢুকে পড়ল। এরপর মগজে দংশন করা শুরু করল। নমরুদ যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে উন্মাদের মতো প্রাসাদে প্রবেশ করল এবং যন্ত্রণায় দিশাহারা হয়ে পাদুকা খুলে নিজের মাথায় আঘাত করতে শুরু করল। অবশেষে মাথায় মৃদু আঘাত করার জন্য একজন সার্বক্ষণিক কর্মচারী নিযুক্ত করল নমরুদ। সুদীর্ঘ ৪০ বছর তাকে এই দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছিল। অবশেষে মাথার আঘাতের ব্যথায় নমরুদের মৃত্যু হয়। (তাফসিরে ইবনে কাসির, পৃষ্ঠা-৬৮৬)
আরও পড়ুন: মানবজাতি থেকেই কেন নবী-রাসুল?
নুহ (আ.)-এর জাতি
আল্লাহর নবী নুহ (আ.) তাঁর জাতিকে ৯৫০ বছর দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন। তারা তাঁর দাওয়াত তো গ্রহণ করেইনি; উপরন্তু তাঁকে দেশ থেকে বহিষ্কার করার হুমকি দেয়। তিনি তখন আল্লাহ তাআলার আশ্রয় কামনা করেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে একটি নৌকা তৈরির নির্দেশ দেন। তিনি ৩০০ হাত দৈর্ঘ্য, ৫০ হাত প্রস্থ ও ২০ হাত উঁচু একটি বিশাল নৌকা তৈরি করেন। আল্লাহ তাআলা জোড়া জোড়া সব প্রাণী এবং তাঁর উম্মতকে নৌকায় আরোহণের নির্দেশ দেন। আল্লাহ তাআলা নূহ (আ.) ও তাঁর জাতিকে নৌকার মাধ্যমে রক্ষা করেন, আর তাঁর জাতিকে পানিতে ডুবিয়ে মারেন। নবীর কথা না শুনলে কী অবস্থা হতে পারে- নূহ (আ.)-এর জাতি এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তারা (নুহ আ.-এর জাতি) তাকে (নুহ আ.) মিথ্যাবাদী বলেছে। অতঃপর তাকে ও তার সঙ্গে যারা নৌকায় ছিল, আমি তাদের উদ্ধার করি এবং (পৃথিবীতে) তাদের স্থলাভিষিক্ত করি। আর তাদের ডুবিয়ে দিয়েছি, যারা আমার নিদর্শন প্রত্যাখ্যান করেছিল।’ (সুরা ইউনুস: ৭৩)
হুদ (আ.)-এর জাতি
হজরত হুদ (আ.) প্রেরিত হয়েছিলেন আদ জাতির কাছে। তারা বিনা প্রয়োজনে প্রাসাদ নির্মাণ ও বড় বড় অট্টালিকা তৈরিতে ব্যস্ত ছিল। তারা বলত- পৃথিবীতে আমাদের চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী কে আছে? তাছাড়া তারা ছিল জালেম ও নিষ্ঠুর স্বভাবের। পার্থিব সুখ শান্তিকেই তারা প্রাধান্য দিত। পরকালের প্রতি তাদের বিশ্বাস ছিল না। হুদ (আ.) আল্লাহকে মান্য করার এবং তাঁর আনুগত্য করার কথা বললে তারা বলল- ‘(আল্লাহ তাআলার বাণী) ‘তুমি উপদেশ দাও বা নাই দাও, উভয়ই আমাদের জন্য সমান’ (সুরা শুআরা: ১৩৬)। অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাদের শাস্তিস্বরূপ প্রেরণ করেন প্রবল ঘূর্ণিঝড়। সাত দিন ধরে অবিরাম ঝড়-তুফান চলতে থাকে। হুদ (আ.)-এর প্রতি তিন হাজার কয়েক শ’ ব্যক্তি ঈমান এনেছিল। তারা ছাড়া অন্যদেরকে আল্লাহ তাআলা এ ঝড়-তুফানে ধ্বংস করে দেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি অশুভ কিছু দিনে তাদের প্রতি পাঠালাম প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়া, তাদের দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করানোর জন্য। আর আখেরাতের শাস্তি তো আরো বেশি লাঞ্ছনাকর এবং (সেখানে) তারা পাবে না কোনো সাহায্য।’ (সুরা ফুছছিলাত: ১৬)
আরও পড়ুন: ঝড়-বাতাস শুরু হলে যে দোয়া পড়বেন
সালেহ (আ.)-এর জাতি
হজরত সালেহ (আ.) প্রেরিত হয়েছিলেন সামুদ জাতির কাছে। তারা পার্থিব ভোগ বিলাসে মত্ত ছিল। পাহাড়কে সহজেই গৃহে রূপান্তরিত করতে পারত। তাছাড়া বিনা প্রয়োজনে তারা অট্টালিকা নির্মাণ করত। পরকালের ভয় তাদের অন্তরে মোটেও ছিল না। হজরত সালেহ (আ.) তাদেরকে দ্বীনের দাওয়াত দিলে তারা মুজিজা প্রত্যাশা করল। তিনি পাথর থেকে গর্ভবতী উষ্ট্রী বের করেন। তাদের সামনে উষ্ট্রীটি বাচ্চা প্রসব করে। কিন্তু তারা জাদু বলে তা প্রত্যাখ্যান করে। তিনি তাদের বলেন, তারা যাতে এ উষ্ট্রী ও তার বাচ্চার কোনো ক্ষতি না করে এবং নির্দিষ্ট দিনে উভয়কে পানি পান করতে দেয়। কিন্তু তারা নির্দিষ্ট দিনে পানি পান করতে দেয়নি। এমনকি কেদার নামক এক ব্যক্তি উষ্ট্রীটিকে হত্যা করে তার গোশত বণ্টন করে নিয়ে যায়। হজরত সালেহ (আ.) তখন দাওয়াতি কাজে বাইরে ছিলেন। ফিরে এসে তাদের তিন দিনের মধ্যেই এ কর্মের জন্য তওবা করতে বলেন। কিন্তু তারা তওবা করেনি। ফলে চতুর্থ দিন আসমান থেকে এক প্রকট আওয়াজ হলো, এতে সামুদ জাতি সবাই মৃত্যুবরণ করল। শুধু মুমিনরা রক্ষা পেলেন। আওয়াজ দিয়ে যে একটি জাতিকে আল্লাহ তাআলা ধ্বংস করে দিতে পারেন, তার দৃষ্টান্ত হজরত সালেহ (আ.)-এর জাতি। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘কিন্তু তারা রাসুলের কথা অগ্রাহ্য করল এবং উটনিকে জবাই করে দিল। শেষ পর্যন্ত তাদের পাপের কারণে তাদের প্রতিপালক তাদেরকে ধ্বংস করে মাটিতে মিশিয়ে দিলেন।’ (সুরা শামস: ১৪)
লুত (আ.)-এর জাতি
হজরত লুত (আ.) বর্তমান জর্ডান ও তার আশপাশের এলাকায় নবী হয়ে প্রেরিত হয়েছিলেন। তাঁর গোত্রের প্রধান অপকর্ম ছিল তারা নারীদের পরিবর্তে অল্প বয়স্ক ছেলেদের সাথে ব্যভিচার করত। তিনি তাদেরকে এ অপকর্ম বর্জন করতে বললে, তারা তাঁকে দেশ থেকে বহিষ্কৃত করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করে। অতঃপর তিনি আল্লাহ তাআলার আশ্রয় কামনা করলে তিনি তাদেরকে শাস্তি দেয়ার জন্য পাথরের বৃষ্টি, ভূমিধস ও দেশকে উল্টিয়ে দিয়ে তাদেরকে ধ্বংস করে দেন। জর্ডানের মৃতসাগর কালের সাক্ষী হিসেবে এখনো বিদ্যমান। এই জাতির ধ্বংস হওয়ার কারণ হিসেবে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘অবশেষে আমার (আল্লাহর) আদেশ চলে আসলো, তখন আমি উক্ত জনপদকে ধ্বংস করে দিলাম এবং তাদের উপর স্তরে স্তরে পাথর বর্ষণ করলাম।’ (সূরা হুদ: ৮২)
আরও পড়ুন: সহবাসে সাড়া না দিলে স্ত্রী কি গুনাহগার হবেন?
শোয়াইব (আ.)-এর জাতি
হজরত শোয়াইব (আ.) দুই জাতির প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন। প্রথমত আইকাবাসীর কাছে প্রেরিত হন। আইকা এমন একটি জনপদের নাম, যেখানে প্রচুর গাছগাছালি ছিল। তাদের প্রধান অপকর্ম ছিল- তারা ওজন ও পরিমাপে কম দিত। হজরত শোয়াইব (আ.) তাদের এ কাজ করতে বারণ করলে তারা তার কথা শুনেনি; বরং তাঁকে জাদুকরগ্রস্ত ও মিথ্যাবাদী বলে অপবাদ দেয়। অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাদেরকে শাস্তি দেন। সাত দিন ও সাত রাত তাদের মধ্যে বাতাস বন্ধ করে দেন। অতঃপর অক্সিজেনের অভাবে তাদের মৃত্যু হয়। তিনি দ্বিতীয়বার প্রেরিত হয়েছিলেন মাদায়েন জাতির কাছে। তারাও তার কথা শোনেনি। অতঃপর ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) এক আওয়াজের মাধ্যমে সবাইকে ধ্বংস করে দেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যখন আমার হুকুম এলো, আমি শোয়াইব (আ.) ও তাঁর সঙ্গী ঈমানদারগণকে নিজ রহমতে রক্ষা করি আর পাপিষ্ঠদের ওপর বিকট গর্জন পতিত হলো। ফলে ভোর না হতেই তারা নিজেদের ঘরে উপুড় হয়ে পড়ে রইল।’ (সুরা হুদ: ৯৪)