images

ইসলাম

আশুরার দিনে যেসব বিদআত নিয়ে সাবধান করেছেন আলেমরা

ধর্ম ডেস্ক

১৫ জুলাই ২০২৪, ০২:১৯ পিএম

মহররমের ১০ তারিখকে আরবিতে আশুরা বলা হয়। মুসা (আ.)-এর যুগের অত্যাচারী রাজা ফেরাউনের ধ্বংসসহ কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছে এই দিনে। রাসুলুল্লাহ (স.)-এর নবুয়তের আগে মক্কার কুরাইশদের কাছেও দিনটির বিশেষ মর্যাদা ছিল। তারা আশুরার দিনে কাবাঘরে নতুন চাদর পরাত এবং রোজা রাখত। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর আদর্শে তারা যা করত, তাতে রাসুলুল্লাহ (স.)-এরও সম্মতি ছিল। তিনি কুরাইশদের সঙ্গে হজে অংশগ্রহণ করতেন এবং আশুরার রোজা রাখতেন। 

উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত, জাহেলি যুগে কুরাইশরা আশুরার দিন রোজা রাখত। আল্লাহর রাসুল (স.)-ও পরে এ সওম পালনের নির্দেশ দেন। অবশেষে রমজানের রোজা ফরজ হলে রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, যার ইচ্ছা আশুরার সিয়াম পালন করবে এবং যার ইচ্ছা সে সওম পালন করবে না। (বুখারি: ১৮৯৩)

তখনও কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেনি। তাই ইসলামি শরিয়তে ইমাম হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের ঘটনাকেন্দ্রিক কোনো আমল নেই। যেমন— শোক পালন করা, মাতম করা, নতুন নিয়মে নামাজ পড়া, ঈদ বানানো কিংবা শোকে পিপাসার্ত থাকা, তেল মালিশ, মেহেদি ব্যবহার, তাজিয়া মিছিল, পিটে চাবুকের আঘাতে রক্তাক্ত হওয়া, আতশবাজি, আলোকজসজ্জা, পুঁথি পাঠ, হালুয়া-রুটির হৈ-হুল্লোড় ইত্যাদি কাজ সুন্নাহবিরোধী ও বিদআত।

জালালুদ্দীন সুয়ুতি (রহ.) লিখেছেন- কিছু মনপূজারি লোক আশুরার দিন কুসংস্কারে লিপ্ত হয়। যেমন—পিপাসার্ত থাকা, পেরেশান হওয়া, ক্রন্দন করা ইত্যাদি। এগুলো বিদআত। এগুলো আল্লাহ, তাঁর রাসুল, সলফে সালেহিন, আহলে বাইত প্রমুখ অনুমোদিত নয়। নিশ্চয়ই হুসাইন (রা.)-এর হত্যার মাধ্যমে পূর্ব যুগে ফিতনার সূচনা হয়। তাতে আমাদের করণীয় হলো- যা মসিবতের সময় করণীয়। সেটি হলো, ইন্না লিল্লাহ..পড়া, ধৈর্য ধরা, হা-হুতাশ না করা, নিজের আত্মাকে কষ্ট না দেওয়া। অথচ বর্তমানে বিদআতিরা এসব করে থাকে। তাতে তারা অনেক মিথ্যা ও সাহাবাদের ব্যাপারে খারাপ বিবরণ পেশ করে, যা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল অপছন্দ করেন। (হাকিকাতুস সুন্নাহ ওয়াল বিদআতি: ১/১৪৭)

আরও পড়ুন: আশুরার দিনে ৩টি আমল ছাড়বেন না

আল্লামা সুয়ুতি (রহ.) লিখেছেন, বিভিন্ন বিপদের দিনকে শোকের দিন বানানো ইসলাম সমর্থন করে না। এটি জাহেলি কাজ। শিয়া সম্প্রদায় আশুরার দিনে এসব করে এ দিনের মর্যাদাবান রোজা ছেড়ে দেয়। (হাকিকাতুস সুন্নাহ ওয়াল বিদআতি, খণ্ড-১, পৃ. ১৪৮)

অথচ আশুরার রোজার অনেক ফজিলত রয়েছে, এক হাদিসে নবীজি (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘আমি আশাবাদী যে, আশুরার রোজার কারণে আল্লাহ তাআলা অতীতের এক বছরের (সগিরা) গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।’ (সহিহ মুসলিম: ১/৩৬৭; জামে তিরমিজি: ১/১৫৮) 

যারা আশুরাকে কেন্দ্র করে বিদআতে লিপ্ত হয়, তারা হুসাইন (রা.) এর আদর্শের বাইরে। মূলত হুসাইন (রা.)-এর বিরোধীরাই আশুরাকেন্দ্রিক বিদআতগুলো আবিষ্কার করেছে। এগুলো মোস্তাহাব হওয়ার ব্যাপারে শরিয়তের কোনো দলিল নেই। জমহুর আলেমদের মতে, আশুরার দিন রোজা রাখাই মোস্তাহাব আমল। (ইসলাহুল মাসাজিদ, খণ্ড-১, পৃ-১৬৭)

মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাব (রহ.) লিখেছেন- ইবনুল কাইয়ুম (রহ.) বলেন, আশুরার দিন সুরমা লাগানো, তেল লাগানো, সুগন্ধি লাগানো মিথ্যুকদের বানানো কথা। এর বিপরীতে আরেক দল এটিকে শোক ও মাতমের দিন বানিয়েছে। দুই দলই বিদআতি। সুন্নতের বিপরীতে এদের অবস্থান। আর রাফেজিরা বৈধ প্রাণীর গোশত ভক্ষণ নিষিদ্ধ মনে করে। (রিসালাতুন ফির রদ্দি আলার রাফিযা: ১/৪৯)

প্রখ্যাত আধ্যাত্মিক সাধক আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) বলেন, ‘হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের দিনটিকে যদি মাতম বা শোক দিবসের জন্য এতই গুরুত্ব দেওয়া হত, তবে সোমবার দিনটিকে আরো ঘটা করে শোক দিবস হিসেবে পালন করা বেশি বাঞ্ছনীয় ছিল। কারণ, এ দিন মহানবী মুহাম্মদ (স.) ইন্তেকাল করেছেন। এই দিনেই নবীর পর শ্রেষ্ঠ মানব প্রথম খলিফা আবু বকর (রা.) পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন।’ (গুনিয়াতুত তালেবিন: ২/৩৮) 

আল্লামা রুমি (রহ.) বলেন, ‘হুসাইন ইবনে আলী (রা.)-এর শাহাদাতের কারণে রাফেজিদের মতো এ দিনটিকে মাতমের জন্য নির্দিষ্ট করে নেওয়া, বস্তুত দুনিয়ায় নিজেদের পুণ্যময় সব কাজ বিনাশ করার নামান্তর।’ (ফতোয়ায়ে রহিমিয়া: ২/৩৪১-৩৪২) 

মারেফুল কোরআন রচয়িতা মুফতি মুহাম্মদ শফি (রহ.) বলেন, ‘কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা মুসলমানের অন্তরকে সব সময় ব্যথিত করে। শুধু ১০ মহররমকে শোকের জন্য বেছে নেওয়া বোকামি বৈ কিছুই নয়।’ (ইমদাদুল মুফতিয়িন: ১/৯৬)

আরও পড়ুন: আশুরার দিনে কেবল ২ ঘটনা প্রমাণিত

তবে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা আলোড়িত ও হৃদয়বিদারক ঘটনা হলো কারবালার মর্মান্তিক ইতিহাস। যা আশুরার দিনেই সংঘটিত হয়েছিল। রাসুলুল্লাহ (স.)-এর ইন্তেকালের প্রায় ৫০ বছর পর ৬১ হিজরির ১০ মহররম পবিত্র আশুরার দিনে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরন করেছিলেন নবী-দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা.)।

ইয়াজিদের এই পাষণ্ডতা আশুরার দিন এলেই মুসলিম উম্মাহকে ক্ষত-বিক্ষত করে। এটি ভুলে যাবার নয়। মুসলিম উম্মাহ এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে, রক্ত দেবে। একইসঙ্গে নবী পরিবারের জন্য দোয়া করবে। 

কিন্তু এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিদআতমূলক কাজে জড়াতে পারে না। সুন্নতের বাইরে নতুন ইবাদত আবিষ্কারকারীদের ব্যাপারে কঠিন কথা বলা হয়েছে হাদিস শরিফে। নবীজি (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই সর্বোত্তম বাণী আল্লাহর কিতাব। আর সর্বোত্তম আদর্শ মুহাম্মদ (স.)-এর আদর্শ। সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হলো, (দ্বীনের মধ্যে) নব-উদ্ভাবিত বিষয়। নব-উদ্ভাবিত সবকিছুই বিদআত। প্রত্যেক বিদআত ভ্রষ্টতা, আর প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম।’ (মুসলিম: ১৫৩৫; নাসায়ি: ১৫৬০)

বিদআত কাজে জড়িত ব্যক্তি কেয়ামতের দিন চরমভাবে লাঞ্ছিত হবে। সেদিন রাসুল (স.) বিদআতি লোকদের হাউজে কাউসারের পানি পান করাবেন না। তিনি তাদের বলবেন, ‘যারা আমার দ্বীন পরিবর্তন করেছ, তারা দূর হও, দূর হও।’ (বুখারি: ৬৬৪৩)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে প্রত্যেক বিষয়ে সুন্নাহকে গুরুত্ব দেওয়ার ও সুন্নতের ওপর অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন। বিদআত থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।