২৩ অক্টোবর ২০২৩, ০৬:১৯ পিএম
মানুষ সামাজিক জীব। সবাইকে মিলেমিশে থাকতে হয়। পরস্পর শরণাপন্ন হতে হয়। কারও ওপর অন্যায় আচরণ, জুলুম, অত্যাচার, মানবতা বিরুদ্ধ কাজ করা যাবে না। ক্ষমতার দাপটে, টাকার প্রাচুর্যে, বংশের দাম্ভিকতায় গরিব ও অসহায়কে কষ্ট দেওয়া যাবে না।
নির্যাতন, জুলুম বা অত্যাচার করা অবৈধ। এমনকি কোনো জীবের ওপরও জুলুম করা অপরাধ। আল্লাহ তাআলা অত্যাচারীকে পছন্দ করে না। সবসময় আল্লাহ মজলুমের পক্ষে থাকেন। তার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াতে আল্লাহ মানবসমাজকে প্রত্যাদেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা কালামে পাকে ইরশাদ করেছেন, ‘হে ইমানদাররা! আর তোমাদের কী হলো যে, তোমরা আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করছ না দুর্বল সেই পুরুষ, নারীও শিশুদের পক্ষে, যারা বলে হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের এই জনপদ থেকে নিষ্কৃতি দান করুন! এখানকার অধিবাসীরা যে অত্যাচারী! আর আপনার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য পক্ষাবলম্বনকারী নির্ধারণ করে দিন এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য সাহায্যকারী নির্ধারণ করে দিন’। (সুরা নিসা: ৭৫ )
আরও পড়ুন: বিশ্বের সব মুসলমানের জন্য যে দোয়া করবেন
অত্যাচারী আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত। জান্নাত থেকে বিতাড়িত। জালিমের বিরুদ্ধে আল্লাহর অবস্থান কঠোর। তিনি জালিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান চালাতে ও তাদের মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। পবিত্র কোরআনে তিনি ইরশাদ করেন, ‘তোমরা জালিম সম্প্রদায়ের মোকাবেলায় তোমাদের সাধ্যানুযায়ী প্রস্তুতি গ্রহণ কর’। (সুরা আনফাল: ৬০)
জালিম আল্লাহর বিধান লঙ্ঘনকারী। আল্লাহর বিধানকে উপেক্ষা করে সে জীবন পরিচালিত করে। আল্লাহর কাছে তার জীবনের কোনো মূল্য নেই। তার ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সাবধান! জালিমদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ’। (সুরা হুদ: ৮ )
মজলুম ও নির্যাতিতকে সাহায্য করা গুরুত্বপূর্ণ নেক আমল। এতে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (স.) খুশি হন। সাহায্যকারীর জন্য জান্নাতের ঘর তৈরি করেন। তার আপ্যায়নে আল্লাহ তাআলা অপেক্ষা করেন। মজলুমকে সাহায্যের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ হয়। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘তোমার ভাইকে সাহায্য কর। সে জালিম হোক বা মজলুম। আনাস (রা.) বলেন হে আল্লাহর রাসুল! মজলুমকে সাহায্য করব তা তো বুঝলাম কিন্তু জালিমকে কী করে সাহায্য করব? তিনি বললেন, তুমি তার হাত ধরে তাকে বিরত রাখবে।’ (বুখারি: ২৪৪৪)
আরও পড়ুন: জুলুম থেকে বাঁচার দোয়া
আরেক হাদিসে বিধৃত হয়েছে বারা ইবনে আযিব থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুল (স.) আমাকে সাতটি বিষয়ের হুকুম দিয়েছেন যেগুলো হচ্ছে, ‘রোগীর শুশ্রূষা করা ও মজলুমকে সহায়তা দান করা’। ( সহিহ বুখারি: ৫১৭৫ )
যে ব্যক্তি এমন স্থানে অপর মুসলিমের সাহায্য পরিত্যাগ করে, যেখানে তার সম্ভ্রম-মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়, আল্লাহ তাকে এমন স্থানে সাহায্য করা থেকে বিমুখ থাকবেন, যেখানে সে তাঁর সাহায্য কামনা করে। আর যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের সম্ভ্রম-মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হওয়ার স্থানে তাকে সাহায্য করে, আল্লাহ তাকে এমন স্থানে সাহায্য করবেন, যেখানে সে তাঁর সাহায্য প্রত্যাশা করে। (সুনানে আবু দাউদ: ৪৮৮৪; মুসনাদে আহমদ: ১৬৩৬৮)
মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে নিজে তার ওপর জুলুম করবে না এবং তাকে জালিমের হাতে সোপর্দ করবে না। (অন্য বর্ণনায় রয়েছে—তার সহযোগিতা পরিত্যাগ করবে না। (সহিহ মুসলিম: ২৫৬৪; মুসনাদে আহমদ: ২০২৭৮)
মুসলমানরা যদি আল্লাহর কোনো বান্দাকে মাজলুম হতে দেখেও জালিমকে প্রতিহত না করে, তাহলে আল্লাহ তাদের সকলকে আজাবে আক্রান্ত করবেন। মাজলুমের সহায়তা পরিত্যাগ করার দ্বারা তারা নিজেরাও জালিম বলে বিবেচিত হবে। হাদিসে এসেছে, মানুষ যদি কোনো অত্যাচারীকে অত্যাচারে লিপ্ত দেখেও তার দু-হাত চেপে ধরে তাকে প্রতিহত না করে, তাহলে আল্লাহ তাআলা অতি শীঘ্রই তাদের সকলকে তার ব্যাপক শাস্তিতে নিক্ষিপ্ত করবেন। (সুনানে তিরমিজি: ২১৬৮; আবু দাউদ: ৪৩৩৮)
মজলুম ব্যক্তির ফরিয়াদ আল্লাহর কাছে খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছায়। আল্লাহ তার ডাক শোনেন। তার দোয়া কবুল করেন। আল্লাহ মজলুমের অসহায়ত্ব মানুষকে অনুধাবন করতে বলেন। মহানবী (স.) যখন মুয়াজ (রা.)-কে ইয়ামানে পাঠান তাকে বলেন ‘মজলুমের ফরিয়াদকে ভয় করবে। কেননা তার ফরিয়াদ এবং আল্লাহর মধ্যে কোনো পর্দা থাকে না’। (সহিহ বুখারি: ২৪৪৮)
জুলুম অন্ধকার। জুলুম শয়তানের পছন্দের কাজ। জুলুম কেয়ামত দিবসে ব্যক্তির বিরূদ্ধে সাক্ষী দেবে। জুলুম অত্যাচারীকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। মহানবী (স.) বলেছেন, ‘জুলুম কেয়ামতের দিন অনেক অন্ধকারে রূপ নেবে’। (সহিহ বুখারি: ২৪৪৭)
আরও পড়ুন: দোয়া ২ কারণে তাৎক্ষণিক কবুল হয় না
সমাজে বিরাজমান অত্যাচার-অনাচার ও বিশৃঙ্খলা-অস্থিরতার মূল কারণ হলো জুলুম। জুলুমকারী ব্যক্তিরা ইসলামের পরিভাষায় সীমালঙ্ঘনকারী। সীমালঙ্ঘনের অপরাধে আল্লাহ তাআলা পৃথিবীর পরাশক্তি, প্রতাপশালী রাজা-বাদশাহ কাউকে ছাড় দেননি। মানবতার বিচারে জুলুম এতই অপছন্দনীয় যে, স্বয়ং আল্লাহ তাআলা নিজের জন্যও এটি হারাম করেছেন। হাদিসে কুদসিতে এসেছে, ‘হে আমার বান্দা, আমি নিজের ওপর জুলুম হারাম করেছি এবং তোমাদের জন্যও তা হারাম করেছি। অতএব তোমরা একে অপরের ওপর জুলুম করো না।’ (মুসলিম: ৬৭৩৭)
জুলুম করা ও কারো জুলুমের শিকার হওয়া থেকে রক্ষার জন্য দোয়ার শিক্ষা রয়েছে হাদিসে। এমন একটি দোয়া হলো— اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْفَقْرِ وَالْقِلَّةِ وَالذِّلَّةِ وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ أَنْ أَظْلِمَ أَوْ أُظْلَمَ উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মা ইন্নী আউজুবিকা মিনাল ফাকরি ওয়াল কিল্লাতি ওয়াজ্জিল্লাতি, ওয়া আউজুবিকা মিন আন আজলিমা আও উজলামা।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাইছি দরিদ্রতা থেকে, আপনার কম দয়া থেকে ও অসম্মানি হওয়া থেকে। আমি আপনার কাছে আরো আশ্রয় চাইছি জুলুম করা থেকে অথবা অত্যাচারিত হওয়া থেকে।’ আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল্লাহ (স.) এই দোয়া করতেন। (আবু দাউদ: ১৫৪৪)
মাজলুমের দোয়া আল্লাহ ফেরত দেন না। মহান রব বলেন, আমার সম্মানের শপথ, কিছুটা বিলম্ব হলেও আমি তোমাকে অবশ্যই সাহায্য করব।’ (তিরমিজি: ৩৫৯৮)
মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াতে তাঁর বান্দাদের জুলুমের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। এটি মানুষকে আল্লাহ তাআলার আজাব ও গজবের সম্মুখীন করে এবং মানুষের সফলতার পথকে রুদ্ধ করে দেয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘অচিরেই জালিমরা জানতে পারবে, তাদের প্রত্যাবর্তনস্থল কোথায় হবে।’ (সুরা শুআরা: ২২৭)