খলিলুর রহমান
০১ অক্টোবর ২০২৩, ০৯:১১ এএম
চারদিকে সমুদ্রের কড়া পাহারায় নজরকাড়া রূপে সজ্জিত দেশ অস্ট্রেলিয়া। বৃহত্তম শহর সিডনি চেনেন না এমন মানুষ খুব কমই আছে। কারণ, আধুনিক প্রযুক্তির বিস্ময়কর স্থাপত্যশৈলী অপেরা হাউজ এখানেই। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ পর্যটক এই অপেরা হাউজে আসেন। মন ভরে উপভোগ করেন এখানকার পরিবেশ। সবমিলিয়ে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সমুদ্রের গর্জনের সঙ্গে সঙ্গে পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত থাকে ওশেনিয়া মহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই বিনোদন কেন্দ্রটি।
অপেরা হাউজে এসে পর্যটকদের কেউ কেউ তাদের সুমধুর কণ্ঠে গানও পরিবেশন করেন। আবার কেউবা প্রীয়তমার সঙ্গে এখানে আড্ডা দিয়েই ভবিষ্যতের জন্য সুন্দর স্মৃতির সঞ্চার করেন। কেউ আবার আনমনে ভেসে আসা সমুদ্রের গর্জন আর দক্ষিণা বাতাস উপভোগ করেন। কেউ কেউ আবার মশগুল থাকেন সমুদ্রের তীরে থাকা খাবারের দোকানগুলোয় বসে মজার মজার সব খাবার খেতে।
শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) অপেরা হাউজ ঘুরে কথা হয় ইদ্রিস আলীর সঙ্গে। অপেরা হাউজে এসে গানের সঙ্গে হইহুল্লোড়ে মেতে ওঠা এই পর্যটক ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি একজন বাংলাদেশি। দীর্ঘদিন থেকে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরে বসবাস করছি। সপ্তাহের শনিবার ও রোববার ছুটি থাকে। তাই ছুটির দিনে সমুদ্রের তীরে গড়ে উঠা অপেরা হাউজে এসে জমিয়ে আড্ডা দেই। এখানে আসলে মনের কষ্ট দূর হয়ে যায়।
অপেরা হাউজে এসে আরও কথা হয় নাহিদা সুলতানা নামে অপর এক তরুণ পর্যটকের সঙ্গে। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি লেখাপড়ার জন্য দুই বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরে এসেছি। এখানে আসার পর থেকে প্রায়সময় অপেরা হাউজে আসা হয়। এখানকার পরিবেশ আমাকে রীতিমতো মুগ্ধ করে।
নাহিদা সুলতানা বলেন, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বন্দরের বেনেলং পয়েন্ট থেকে রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে অপেরা হাউজ যেন তার মুগ্ধতা ছড়িয়ে দেয় বহুগুণ। আর নীল আকাশের নিচে পাইপটাইল জ্বলজ্বল করে জ্বলে। যখন সন্ধ্যা নামে এখান থেকে চোখ ফেরানো যায় না। বাহারি আলো যখন পানিতে পড়ে, তখন এর রূপ যেন মোহনীয় জাদু দিয়ে চারপাশ ঘিরে রাখে। আধুনিকতা আর স্থাপত্য কলার অপরূপ এক মেলবন্ধনে বিশ্বের ভ্রমণপিপাসুদের মন কেড়ে নেয় অপেরা হাউজটি।
শুধু ইদ্রিস আলী ও নাহিদাই নন, সিডনির অপেরা হাউজ বিশ্বজুড়ে পর্যটকদের আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। পোল্যান্ড থেকে আসা পর্যটক বেরেসজিনস্কি ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি ছুটি উপভোগ করার জন্য পোল্যান্ড থেকে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে এসেছি। এখানে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেছি। এখন সিডনির অপেরা হাউজে এসেছি। এখানের পরিবেশ চমৎকার। আমি অনেক এনজয় করছি।
অপেরা হাউজে দেখার কি আছে?
অপেরা হাউজ হলো বহুমুখী শিল্পকলার থিয়েটার। খ্যাতনামা সব সঙ্গীতবিদ, নৃত্যশিল্পী ও অন্যান্য বিনোদনশিল্পীদের জন্য এক মহামিলনস্থল এটি। তবে জনসাধারণের জন্যও এই অপেরা হাউজটি উন্মুক্ত। তাই দর্শনার্থীদের থিয়েটার বা স্টেজ শো দেখার সঙ্গে সঙ্গে পুরো অপেরা হাউজটি ঘুরে দেখার সুযোগও রয়েছে। এমনকি টিকিটের বিনিময়ে উপভোগ করা যায় স্থাপত্যকলার এই অপরূপ সৌন্দর্য আর মন-মাতানো সব অনুষ্ঠান।
উইকিপিডিয়ার তথ্য বলছে, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বন্দরে অবস্থিত অপেরা হাউজটি দেখতে নৌকার পাল আকৃতির মতো। এখানে প্রতিদিন অনেক ধরনের অনুষ্ঠান হয়। ফলে বিশ্বের কোটি কোটি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে এটি। পাশাপাশি অপেরা হাউজটি মহাসাগরের এক প্রান্তে তৈরি করা হয়েছে, যা দেখতে অনেকটা উপত্যকার মতো।
অপেরা হাউজের ইতিহাস
বর্তমান অপেরা হাউজটি বেনেলং পয়েন্টে তৈরি করা হয়েছে, যা একসময় ম্যাককুইরি বন্দর হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৮১৭ সালে বন্দরটি প্রতিষ্ঠিত হয় ও ১৯০১ সালে বিলুপ্ত করা হয়। ১০ আগস্ট, ১৯০২ সালে ম্যাককুইরি বন্দরে ট্রাম রক্ষণাগার তৈরি করে ১৯৫৮ সালে ভেঙে ফেলা হয়। পরে এই একই জায়গায় ১৯৫৯ সালে সিডনি অপেরা হাউজের নির্মাণ কাজ শুরু হয়।
ড্যানিশ স্থাপত্যবিদ জান আডজেন সিডনি অপেরা হাউজের নকশা প্রণয়ন করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি অপ্রত্যাশিত ও বিতর্কিতভাবে নকশা প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হন। পরে তিনি প্রকল্পের তত্ত্বাবধান ও সহায়তার জন্য সিডনিতে আসেন। ১৯৬৩ সালে তিনি সিডনিতে তার অফিস স্থানান্তরিত করেন। এরপর ১৯৬৬ সালে আডজেন প্রকল্পের কাজ ফেলে রেখে চলে যান। এর প্রধান কারণ ছিল সরকারের অর্থ প্রদানে অস্বীকৃতি। পরবর্তীতে ২০০১ সালে আডজেন অস্ট্রেলিয়ায় আমন্ত্রিত হয়ে অবকাঠামোটির নকশাকে পরিবর্তন করে প্রকৃত অবস্থায় ফিরিয়ে আনেন।
১৯৫৭ সালে অপেরা হাউজের প্রকৃত নির্মাণ ব্যয় ছিল ৭ মিলিয়ন ডলার। সরকার থেকে ১৯৬৩ সালের ২৬ জানুয়ারি অস্ট্রেলিয়া দিবসে নির্মাণ কাজ শেষের ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু প্রকল্পটি ১০ বছর বিলম্বিত হওয়ায় অতিরিক্ত অর্থ মাশুল গুণতে হয় এবং তা শেষ করতে চৌদ্দগুণেরও অতিরিক্ত অর্থ সরকার পক্ষ থেকে সরবরাহ করতে হয়।
কবে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয় অপেরা হাউজ?
অস্ট্রেলিয়ার রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ১৯৭৩ সালের ২০ অক্টোবর আধুনিক স্থাপত্যকলার অন্যতম পদচিহ্ন সিডনি অপেরা হাউজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। বিপুলসংখ্যক আগ্রহী জনতা এতে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু সিডনি অপেরা হাউজের নকশাকার জান আডজেনকে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এমনকি কোথাও তার নাম পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়নি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি সরাসরি টেলিভিশনের পর্দায় দেখানো হয়। আতশবাজি ফোটানো হয় এবং বিথোভেনের ৯ নম্বর সিম্ফনি পরিবেশন করা হয়।
কেআর/আইএইচ