images

রাজনীতি

ঢাকা-৮ আসনে শক্ত অবস্থানে আব্বাস, উত্তাপ ছড়াচ্ছেন হেলাল-হাদিও

মাহফুজুর রহমান

০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭:১৮ এএম

রাজধানীর আসনগুলোর মধ্যে ঢাকা-৮ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়, ব্যাংকপাড়া মতিঝিল, আন্দোলন সংগ্রামের চারণভূমি পল্টন-প্রেসক্লাব এই আসনের অন্তর্ভুক্ত। বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ও এখানে অবস্থিত। 

বরাবরের মতোই এবারের নির্বাচনেও আলোচনার তুঙ্গে রয়েছে আসনটি। ভোটের তফসিল ঘোষণার আগেই এখানকার নির্বাচনি উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। প্রচার-প্রচারণায় সরগরম ঢাকা-৮ আসনের প্রতিটি এলাকা।  

এবারের নির্বাচনে এই আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন দলের হেভিওয়েট নেতা ও সাবেক মন্ত্রী মির্জা আব্বাস। তিনি এই অঞ্চলের সাবেক সংসদ সদস্য। ছিলেন ঢাকার মেয়রও। রাজধানী ঢাকায় বেড়ে ওঠা এবং রাজনীতি করার কারণে তিনি এখানে বেশ শক্ত অবস্থানে রয়েছেন। তার সঙ্গেই অন্য প্রার্থীদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে ধারণা করছেন এলাকাবাসী। 

WhatsApp_Image_2025-12-02_at_18.08.49_e4a763ab

এই আসনে মির্জা আব্বাসের বিপরীতে রয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী ড. হেলাল উদ্দিন। তিনি দলের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য এবং ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের নায়েবে আমির। দৃষ্টি কাড়ছেন জুলাই আন্দোলনের অন্যতম নেতা ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদিও। এই আসনে তরুণদের নেতৃত্বাধীন নতুন দল এনসিপি প্রার্থী করেছে সুজন নামে এক রিকশাওয়ালাকে। তিনি জুলাই আন্দোলনের আইকনিক ‘সেল্যুট হিরো’ হিসেবে পরিচিত। যিনি রিকশাচালক হয়েও গত আন্দোলনের সময় হাত উঁচিয়ে সেলুট দেওয়া ছবির মাধ্যমে সারাদেশে পরিচিত হন। এর বাইরে এই আসনে বাংলাদেশ রিপাবলিক পার্টির ইঞ্জিনিয়ার কামাল হোসেন, বাংলাদেশ বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী সাইফুল হক, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মুফতি কেফায়েত উল্লাহ কাশফী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন। 

এত বৈচিত্র্যময় প্রার্থীর উপস্থিতি নির্বাচনি প্রতিযোগিতাকে রঙিন করেছে। তাদের প্রচার-প্রচারণার ধরন, ভোটার–সংযোগ, সংগঠনভিত্তিক শক্তি এবং ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার ওপর নির্ভর করে আসনটিতে ভোটের উত্তাপ ভালোমতোই ছড়িয়ে পড়েছে। 

পল্টন-মতিঝিল-রমনা এলাকা নিয়ে গঠিত আসনটিতে মির্জা আব্বাস একাধিকবার বিজয়ী হয়েছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আসনটি নতুন ভৌগলিক সীমানা পায়। সেই নির্বাচনে মির্জা আব্বাসের সঙ্গে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন। পরের দুই নির্বাচনেও মেনন এখানে বিজয়ী হন। সবশেষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বিজয়ী হন। 

5a

শক্ত অবস্থানে মির্জা আব্বাস

সব বিচারেই এই আসনে শক্তিশালী প্রার্থী মির্জা আব্বাস। তিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য। ঢাকায় বিএনপির রাজনীতি যারা দীর্ঘদিন ধরে নিয়ন্ত্রণ করছেন তাদের শীর্ষে রয়েছেন মির্জা আব্বাস। তিনি অবিভক্ত ঢাকার মেয়রও ছিলেন। পালন করেছেন মন্ত্রীর দায়িত্বও। যুব ও শ্রমিক রাজনীতি থেকে উঠে আসা এই নেতা বারবার ভোটের মাঠে অবতীর্ণ হয়েছেন। তিনি একজন শিল্পপতিও। ফলে ভোটের মাঠে তাকে দেখা হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে। 

ধানের শীষের প্রাথমিক মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকেই মির্জা আব্বাস এলাকায় সরব রয়েছেন। এবার তার প্রচারণায় দেখা যাচ্ছে ব্যতিক্রমী উপস্থাপন- ভোরের প্রচারণা। প্রায়ই সকালে তিনি রমনা পার্কে চলে যান। সেখানে তিনি হাঁটাহাঁটি করেন এবং হাঁটতে আসা সাধারণ মানুষ, অফিসগামী কর্মজীবী মানুষ কিংবা ব্যায়ামরত প্রবীণ প্রত্যেকের কাছে তিনি সরাসরি ভোট চান। কথোপকথনে স্থানীয় সমস্যা শোনেন, সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেন।

রমনার এক প্রবীণ ভোটারের ভাষায়- ‘তিনি আমাদের সঙ্গে অনেকটা স্বাভাবিক মানুষের মতো কথা বলেন। নেতার মতো নয়, বরং এলাকাবাসীর একজন পরিচিত মানুষ হিসেবে।’

WhatsApp_Image_2025-12-02_at_18.08.48_f612ca03

রমনা–শাহবাগ–সিদ্ধেশ্বরী–মগবাজার বিস্তৃত এলাকাজুড়ে দিনের বাকি সময়েও তিনি গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক, স্থানীয় দোকানপাটে গিয়ে আলাপ, বাড়ি–বাড়ি গিয়ে পরিচিতি সব মিলিয়ে অভিজ্ঞতাকে তিনি কাজে লাগাচ্ছেন পুরোপুরিভাবে।

অবস্থান সুসংহত জামায়াত প্রার্থীরও

এই আসনে জামায়াতের প্রার্থীর অবস্থানও বেশ সুসংহত। ঢাকার যেসব এলাকায় জামায়াত আগে থেকেই সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী এর মধ্যে পল্টন এলাকাও রয়েছে। এবার সাংগঠনিক সেই শক্তিকে কাজে লাগাতে চান ড. মো. হেলাল উদ্দিন। এছাড়া তার ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি, ইসলামি শিক্ষায় দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও কমিউনিটিভিত্তিক নেটওয়ার্ক তাকে ভোটারদের কাছে জনপ্রিয় করে তুলছে।

তার প্রচারণায় দেখা যায় মসজিদভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মতবিনিময়, উঠান বৈঠক এবং দরিদ্র মানুষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সুশাসন তার মূল বার্তা।

দাঁড়িপাল্লার প্রার্থী ড. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণের প্রতিনিধি শাসক হয় না, সেবক হয়। জনগণের সেবায় নিয়োজিত থাকে। যার কারণে আজ পর্যন্ত কোনো ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার ফ্যাসিবাদ হয়ে উঠতে পারেনি, পারবে না। কারণ ইসলামি রাষ্ট্র পরিচালিত হয় আল্লাহর আইনে। আল্লাহর আইনে জনগণকে শোষণ করা যায় না, জনগণের সেবা করতে হয়। মানুষের তৈরি আইনে জনগণকে সেবার নয় শোষণ করা হয়। যারা নিজস্ব তৈরি আইনে জনগণকে শোষণ করতে চায়, তারা ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করছে। তারা জনগণকে ভয়ভীতি লাগাচ্ছে জামায়াত ক্ষমতায় গেলে মানুষের হাত কেটে ফেলবে, নারীদেরকে ঘরে বন্দী করে রাখবে, কিন্তু না জামায়াত ক্ষমতায় গেলে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবে। ইসলামি রাষ্ট্রে কেউ চুরি করলে চোরের হাত কেটে দেওয়ার বিধান।’

3

জামায়াত প্রার্থী বলেন, ‘অতীতে যারা ক্ষমতায় ছিল তাদের কাজই ছিল জনগণের সম্পদ চুরি করা! দেশের সম্পদ চুরি করে তারা বিদেশে পাচার করেছে। তারা আবারো ক্ষমতায় এলে একই কাজ করবে। জামায়াত ক্ষমতায় এলে জনগণের ভয়ের কারণ নাই, চোরদের ভয়ের কারণ রয়েছে। নারীদের ঘরে বন্দী করে রাখা ইসলামের বিধান নয়। ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থায় নারীও অংশগ্রহণ করতে পারে এবং বাংলাদেশেও করবে।’

তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘ইসলামী ছাত্রশিবির মনোনীত প্যানেল নির্বাচিত হয়ে ডাকসুর নেতৃত্ব দিচ্ছে। সেখানে নারী-পুরুষ বা ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে কোনো বৈষম্য করা হচ্ছে না। ছাত্রীদের নিরাপত্তা, স্বাধীনতা, অধিকার ও সুরক্ষায় ডাকসু যেভাবে ভূমিকা রাখছে একইভাবে জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় গেলে নারীদের নিরাপত্তা, স্বাধীনতা, অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে।’

সিদ্ধেশ্বরীর এক ব্যবসায়ীর মন্তব্য, ‘হেলাল সাহেব অত্যন্ত ভালো মানুষ, তিনি ধর্মভীরু একজন মানুষ শান্তভাবে কথা বলেন, প্রতিশ্রুতিও বাস্তবসম্মত। বিশেষ করে নৈতিক শিক্ষার যে কথা বলেন, তা অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য।’

ব্যতিক্রমী প্রচারে নজর কাড়ছেন হাদি

ঢাকা-৮ আসনে আলোচিত চরিত্র ওসমান হাদি। তরুণদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে। তার প্রচারণার ধরন পুরোপুরি ব্যতিক্রমী। তিনি বড় মিছিল–মাইক এড়িয়ে ছোট আকারের ঘনিষ্ঠ কথোপকথনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। হাদির ভ্যান গাড়ির বহর নিয়ে ব্যত্রিক্রমী প্রচারণাও ব্যাপক সাড়া ফেলে।

ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদি বলেন, ঢাকা-৮ এ যদি এমন কোনো প্রার্থী থাকেন, যিনি সংসদে দাঁড়িয়ে ইনসাফ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে আমার চেয়েও জোরালো ভূমিকা রাখতে পারবেন, ২৯৯ জনের বিপরীতে জোরালো কণ্ঠে পাহাড়ের মতো অবিচল থাকবেন জনতার কাতারে, তাহলে আমার ভোটটাও তাকেই দেওয়ার চিন্তা করবো।

এছাড়া আমার প্রিয়তম পিতাও যদি ঢাকা-৮ এ নির্বাচন করেন, আমরা এখান থেকে এক সুতো সরবো না। আমরা নড়বো না। আমাদের লড়াই ভীষণ নিঃসঙ্গ। বড্ড বন্ধুর। তবু কঠিনেরে ভালোবাসিলাম।

26

মালিবাগের এক কলেজপড়ুয়া তরুণের মন্তব্য, ‘হাদি ভাই আমাদের অভ্যুত্থানের বিপ্লবী নেতা। তিনি কখনও অন্যায়ের সাথে আপস করেন না। হাদি ভাই শুধু কথা বলেন না; আমরা কী চাই তা মন দিয়ে শোনেন।’

তরুণ ভোটারদের পাশাপাশি গৃহিণী এবং কর্মজীবী মানুষও তার প্রচারণাকে প্রশংসা করছেন।

ঢাকা–৮ আসনে প্রধান তিন প্রতিদ্বন্দ্বীর অবস্থান ভিন্ন। তাদের প্রচারণায় মানুষ কী বলছে—তা বিশ্লেষণে পাওয়া গেল তিন ধরনের প্রতিক্রিয়া।

শান্তিনগরের এক ফার্মাসিস্ট বললেন, ‘মির্জা আব্বাস অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ, এলাকার সমস্যা কীভাবে সমাধান করতে হয় জানেন।’

মালিবাগের এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী বললেন, ‘হাদী ভাইয়ের কথায় আশাবাদী হওয়া যায়। নতুন রাজনীতির দরজা খুলতে পারেন।’

সিদ্ধেশ্বরীর এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘ড. হেলাল উদ্দিন নরম স্বভাবের, কথা কম বলেন, কিন্তু কাজের কথা বলেন। এজন্য অনেকেই তাকে পছন্দ করে।’

রমনার এক তরুণ বলেন, ‘হাতপাখার প্রার্থী কাশফী সাহেব সৎ এবং সরল মানুষ। তার ধর্মভিত্তিক বক্তব্য অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য।’

রমনা পার্কের এক প্রবীণ ভোটার হয়তো পুরো পরিস্থিতির সারাংশই বলে দিয়েছেন, ‘এই নির্বাচনে কেউই সহজে জিতবে না। ভোট হবে মানুষ, প্রচারণা আর প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে। কে আসবেন সেটা নির্ধারণ করবে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে সাধারণ মানুষই।’

এম/জেবি