ঢাকার ব্যস্ত কোনো রাস্তায় ঢুকে পড়লেই দেখা যায় সারি সারি সেলুন। কেউ মাথা ন্যাড়া করছে, কেউ আবার নতুন হেয়ারস্টাইলে ব্যস্ত। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের মাথা থেকে কাটা টনকে টন চুল জমে এই শহরের অসংখ্য সেলুনে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, কাটা চুলগুলো যায় কোথায়? অনেকেই হয়তো ভাবেন, এগুলো ডাস্টবিনে বা নর্দমায় গিয়ে শেষ হয়। কিন্তু না, সেই চুলের একটা বড় অংশেরও আলাদা গল্প আছে। কেউ সেগুলো ফেলে দেয়, কেউ আবার ব্যবসা করে, কেউ তৈরি করে নতুন পণ্য। এই নীরব চুলেরও আছে অর্থনীতি, পরিবেশ ও পুনর্ব্যবহারের এক অজানা জগৎ।
বিজ্ঞাপন
চুলের বাণিজ্য
আগে গ্রামের দিকে বাড়িতে বাড়িতে চুল সংগ্রহ করা হতো। তবে এখন শহরের অলিতে-গলিতেও চুল খুঁজতে আসেন ফেরিওয়ালারা।
কলাবাগান এলাকার একজন নারী বলেন, মেয়েদের ঝরে পড়া চুল নিয়ে যায় ফেরিওয়ালারা। বিনিময়ে মেলে অন্যকিছু। তিনি বলেন, ‘ফেরিওয়ালা আইসা চুল চায়। তারপর ক্লিপ, সেফটিপিন, স্টিলের বাটি, চামচ এগুলা দেয়।’
ওই নারীর সঙ্গে কথা বলে বেরিয়েই একজন ফেরিওয়ালাকে পাওয়া গেল, যিনি পুরনো কাগজ ও চুলের খোঁজ করছিলেন। কী ধরনের চুল নিতে চাযন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মহিলাদের মাথার চুল।’
বাদ নেই ছেলেদের সেলুনও। যদিও সেখানে খুব একটা বড় চুল পাওয়া যায় না। তারপরও সেখান থেকেও চুল সংগ্রহ করার জন্য ঘোরাফেরা করে ফেরিওয়ালারা। এমনটাই জানান বেশ কয়েকটি সেলুনের নরসুন্দর বা নাপিত।
তবে বাংলাদেশে মূলত এ ধরনের চুলের বেশিরভাগ সংগ্রহ করা হয় পার্লার থেকে এবং বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে।
ঢাকার খিলগাঁওয়ের রেলগেট সংলগ্ন একটি বাড়িতে ‘হেয়ারি’ নামে উইগ তৈরির কারখানা। সেখানকার একজন বলেন , ‘এখন বিভিন্ন বয়সের মানুষেরা আসছেন নিজেদের মাথার উইগ বা পরচুলা তৈরির জন্য। কেউ চাকরির ইন্টারভিউ দেবেন বা বিয়ের পাত্রী দেখতে যাবেন, আবার কেউ টেলিভিশনে খবর পড়বেন- এমন অনেকে নিচ্ছেন উইগ। এছাড়া দেশের বাইরে থেকে তাদের কাছে অর্ডারও আসছে।’
কাটা চুল কেজি প্রতি তিন-চার কিংবা ৫০০০ টাকাতেও বেচা-কেনা চলছে। তবে চুলের আকার হতে হবে আট ইঞ্চি লম্বা। বর্তমানে কোনো কোনো কোম্পানি এই চুল আইল্যাশ বা চোখের পাপড়ি তৈরিতেও ব্যবহার করছে।
ঢাকার নিউমার্কেটের পাশে হেয়ার এক্সেসরিজের দোকানে দেখা গেল কিছু কালো বাদামি চুলের বান্ডিল। বিক্রেতা জানালেন, ‘এগুলো দেশি না ভাই, ভিয়েতনাম থেকে আসে। কিন্তু এখন কিছু দেশি চুলও আমরা সংগ্রহ করি, দামও মন্দ না।’
এতেই বোঝা যায়, চুল এখন শুধুই আবর্জনা নয়, বরং ছোট আকারে হলেও এটি পণ্য হয়ে উঠছে বাংলাদেশের বাজারে।
শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর অনেক দেশে কাটা চুল এখন এক গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপণ্য। ভারতের তিরুপতি মন্দিরে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ পূণ্যের অংশ হিসেবে মাথা ন্যাড়া করে। সেই চুলগুলো পরে ধোয়া, প্রক্রিয়াজাত করে রফতানি হয় ইউরোপ, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রে। শুধু সেই এক মন্দির থেকেই বছরে প্রায় ৬ মিলিয়ন ডলারের চুল রফতানি হয়।
চীনে ও ভিয়েতনামে রয়েছে বিশাল হেয়ার-প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রি। ‘রেমি হেয়ার’ নামে পরিচিত মানুষের প্রাকৃতিক চুল দিয়ে তারা উইগ, হেয়ার এক্সটেনশন, ফিল্টার এমনকি শিল্পকর্মও তৈরি করে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আবার চুল ব্যবহৃত হয় তেল দূষণ পরিষ্কারে, ‘হেয়ার বুম’ নামের বিশেষ ম্যাট তৈরি হয়, যা সমুদ্রে তেলের স্তর শোষণ করতে সক্ষম।
সেলুন থেকে ডাস্টবিন পর্যন্ত
মিরপুরের একটি ছোট সেলুনে কাজ করছেন সোহেল মিয়া। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তিনি গড়ে ৩০-৪০ জনের চুল কাটেন। তার সামনে একটা বড় ময়লার ঝুড়ি, তাতে জমে আছে কাটা চুলের স্তূপ। জিজ্ঞেস করতেই হেসে বললেন, ‘ভাই, আমরা তো সব ঝাড়ু দিয়ে ডাস্টবিনে ফেলি। মাঝে মাঝে ময়লা ওয়ালারা নিয়ে যায়, ওরা কোথায় ফেলে জানি না।’
এই ‘ফেলে দেওয়ার’ গল্পটাই মূলত বাংলাদেশের সেলুন চুলের সবচেয়ে বড় পরিণতি। প্রতিদিন ঢাকার হাজারো সেলুন থেকে যে চুল পড়ে, তার সিংহভাগই চলে যায় আবর্জনায় বা নর্দমায়।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের চুল খুব ধীরে পচে। একেকটা চুল সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হতে সময় নেয় প্রায় দুই বছর। ফলে এটি নর্দমা আটকে দেওয়ারও অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশে এখনো কাটা চুল আলাদা করে সংগ্রহ ও পুনর্ব্যবহারের কোনো সংগঠিত উদ্যোগ নেই। তবে কিছু সংগ্রাহক বা রিসেলার চুপিচুপি এই চুল কিনে নেয়, বিশেষ করে নারীদের লম্বা চুল, যা বিদেশে উইগ তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
চুলের পুনর্জন্ম: সার, শিল্প ও গবেষণায় ব্যবহার
বিশ্বের অনেক দেশে চুল পুনর্ব্যবহারের ধারণা বেশ পুরনো। ফ্রান্স ও ইটালিতে কৃষিক্ষেত্রে মানুষের চুল ব্যবহার করা হয় জৈব সার হিসেবে। কারণ চুলে থাকে নাইট্রোজেন, সালফার ও প্রোটিন, যা মাটির উর্বরতা বাড়ায়। আবার ফিলিপাইনে চুল দিয়ে বানানো হয় নেট, যা বন্যায় ভেসে যাওয়া মাটি আটকায়।
বাংলাদেশেও কিছু গবেষক চেষ্টা করছেন মানুষের চুলকে ব্যবহারযোগ্য উপাদানে পরিণত করতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বললেন, ‘চুলে যে পরিমাণ কেরাটিন থাকে, তা বায়োপ্লাস্টিক বা ফিল্টার মেটেরিয়াল হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব। তবে এ নিয়ে এখনো বাণিজ্যিক পর্যায়ে কাজ হয়নি।’
পরিবেশবাদীরা মনে করেন, সেলুন চুল যদি সংগঠিতভাবে সংগ্রহ করা যায়, তাহলে এটি ‘সবুজ উদ্যোগ’ হিসেবে দাঁড়াতে পারে। এতে যেমন নর্দমা আটকে যাবে না, তেমনি একটি নতুন রিসাইক্লিং ইকোনমিও গড়ে উঠবে।
বাংলাদেশে উদ্যোগের অভাব, তবে সম্ভাবনা অনেক
ভারত, চীন, ভিয়েতনাম, এমনকি যুক্তরাজ্যেও এখন ‘গ্রিন সেলুন’ ধারণা জনপ্রিয় হচ্ছে। সেখানে সেলুনগুলো আলাদা বিনে কাটা চুল জমা রাখে, পরে বিশেষ সংগঠনগুলো সেই চুল সংগ্রহ করে পুনর্ব্যবহার করে। যুক্তরাজ্যের ‘গ্রিন সেলুন কালেক্টিভ’ প্রতিষ্ঠানটি এমনকি সেলুনে চুল, ফয়েল, প্লাস্টিক— সব কিছু আলাদা করে রিসাইক্লিংয়ের ব্যবস্থা করেছে। তাদের ওয়েবসাইটেই লেখা, ‘ইভেন হেয়ার হ্যাজ এ সেকেন্ড লাইফ’।
বাংলাদেশে এখনো এমন কোনো বড় উদ্যোগ দেখা যায়নি। ঢাকায় কিছু সৌন্দর্য প্রতিষ্ঠান চেষ্টা করছে চুল আলাদা করে জমাতে, তবে বাজারভিত্তিক কোনো রিসাইক্লিং সাপ্লাই চেইন এখনো তৈরি হয়নি।
মগবাজারের এক মহিলা সেলুনকর্মী শারমিন আক্তার জানালেন, ‘কিছু কিছু মহিলা গ্রাহক নিজের কাটা চুল ব্যাগে করে নিয়ে যান। কেউ বলেন, ‘মাটি দেব’, কেউ বলেন ‘অমঙ্গল দূর হবে’। কিন্তু বেশিরভাগই ফেলে দিই। যদি কেউ এসে নিয়মিত কিনে নিত, ভালোই হতো।’
এই বক্তব্যে এক ধরনের বাস্তবতা স্পষ্ট— চুল এখনো আবর্জনা হিসেবে দেখা হয়, সম্পদ হিসেবে নয়।
চুলের বাজার: বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রেতা কারা
চুলের বৈশ্বিক বাজার বিশাল। ‘গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চ’-এর তথ্য অনুযায়ী, শুধু হেয়ার উইগ ও এক্সটেনশন বাজারের আকার ২০২৫ সালে পৌঁছাবে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলারে। এই বাজারের ৮০ শতাংশ কাঁচামাল আসে এশিয়া থেকে— বিশেষ করে ভারত, চীন, মায়ানমার ও ভিয়েতনাম থেকে।
বাংলাদেশে এখনো এই বাণিজ্য খুব সীমিত। তবে সস্তা শ্রম ও ক্রমবর্ধমান সৌন্দর্য শিল্পের কারণে ভবিষ্যতে এটি নতুন খাত হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি সরকার বা স্থানীয় উদ্যোক্তারা চুল সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে বিনিয়োগ করেন, তাহলে বছরে অন্তত ২০-২৫ কোটি টাকার সম্ভাব্য বাজার তৈরি হতে পারে।
পরিবেশ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি
চুলে অনেক সময় থাকে রঙ, পার্মিং বা রাসায়নিক পদার্থ। এসব চুল যদি সঠিকভাবে নিষ্পত্তি না হয়, তাহলে তা পরিবেশ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এক পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা জানালেন, ‘অনেক সময় ড্রেন পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখা যায়, বড় বড় চুলের জট নর্দমা বন্ধ করে রেখেছে। এগুলো পচতে অনেক সময় নেয়।’
সে কারণে পরিবেশবিদদের পরামর্শ, চুল ফেলার আগে আলাদা করা, শুকানো ও নির্ধারিতভাবে সংগ্রহ করাই হবে সবচেয়ে ভালো সমাধান।
চুলের ভবিষ্যৎ: আবর্জনা নয়, উপাদান
চুল ফেলে দেওয়ার সংস্কৃতি বদলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। ইউরোপে চুল দিয়ে এখন তৈরি হচ্ছে জুয়েলারি, আর্টওয়ার্ক ও কসমেটিক পণ্য। এমনকি আমেরিকার কিছু গবেষণাগারে চুলের কেরাটিন ব্যবহার হচ্ছে টিস্যু রিজেনারেশনে।
বাংলাদেশেও এমন উদ্যোগের সম্ভাবনা অগাধ। যদি সেলুনগুলো সচেতন হয়, আর স্থানীয় সরকার বা উদ্যোক্তারা এ খাতে বিনিয়োগ করেন, তাহলে এটি হয়ে উঠতে পারে এক নতুন সবুজ অর্থনীতি।
চুলের এই যাত্রা হয়তো নীরব, কিন্তু তা অর্থনৈতিক ও পরিবেশগতভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। একসময় যেটাকে আমরা ময়লা ভেবে ডাস্টবিনে ফেলতাম, ভবিষ্যতে সেটিই হতে পারে এক নতুন সম্পদের উৎস।
ফেরা যাক মিরপুরের সেই সেলুনে। চুল কেটে গ্রাহকের মাথায় শেষবারের মতো ব্রাশ চালিয়ে সোহেল মিয়া আবার ঝাড়ু হাতে নিলেন। ঝুড়িতে জমে থাকা কালো বাদামি চুলের স্তূপের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমাদের তো ওগুলো ময়লা মনে হয়, কিন্তু এখন শুনছি এগুলারও দাম আছে! যদি কেউ নিয়ে যেত, আমরাও উপকার পেতাম।’
হয়তো একদিন সোহেল মিয়ার এই কথাই সত্যি হবে। সেলুনের কাটা চুলও তখন ‘ময়লা’ নয়, বরং নতুন জীবনের উপকরণ হবে।
এম/এএইচ

