ঢাকা-৭, জাতীয় সংসদের ৩০০টি নির্বাচনী এলাকার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ আসন। বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত আসনটিতে ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বিএনপির টিকিটে চারবার সংসদ সদস্য হয়েছিলেন অবিভক্ত ঢাকার শেষ মেয়র প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকা। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে দলটির আর কোনো মুখ নেই আসনটিতে।
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত এক বছরে আসনটিতে মাঠ গোছাতে থাকে প্রায় দুই দশক ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা দল বিএনপি। দলটি থেকে প্রার্থী হতে ইচ্ছুক নেতারা পাড়া মহল্লায় গণসংযোগ, লিফলেট বিতরণসহ নানা কর্মসূচি করছেন।
বিজ্ঞাপন
কিন্তু ৩ নভেম্বর বিএনপি যে ২৩৭টি আসনের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে তাতে ঢাকার এই আসনটিসহ মোট সাতটি আসনে কোনো প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়নি।
চাউর হয়েছে, ঢাকার এসব আসনের মধ্যে বেশ কয়েকটি আসন ছাড়া হতে পারে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের। ঢাকা-৭ আসন বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা না করে গণফোরামের প্রার্থী সুব্রত চৌধুরীকে ছেড়ে দিতে পারে বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। এতে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। তবে নেতাকর্মীদের প্রত্যাশা শেষ পর্যন্ত বিএনপি নিজ দলের প্রার্থীকেই মনোনয়ন দেবে।
বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা না করলেও মাঠে সরব আছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির নেতাকর্মীরা মাঠে বেশ সক্রিয়। তারা পুরো নির্বাচনী এলাকা ঘুরে ভোটারদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলছেন এবং নানা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।
বিজ্ঞাপন
স্থানীয়রা জানান, শেষ পর্যন্ত বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করলে ঢাকা-৭ আসনে দুই দলের মধ্যে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। তাদের মতে, শেষ মুহূর্তের প্রচারণা, স্থানীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক এবং দলীয় সমন্বয়ই নির্ধারণ করবে বিজয়ী কে হবে।
এলাকাবাসী আরও জানায়, এখন পর্যন্ত জামায়াত ও বিএনপি ছাড়া আসনটিতে অন্য কোনো দলের প্রার্থীর তেমন প্রচারণা চোখে পড়েনি।
বিএনপি নেতাকর্মীরা জানান, ঢাকা-৭ আসনে বিএনপির সম্ভাব্য চার প্রার্থী-খালেদা আক্তার কল্পনা, মীর নেওয়াজ আলী, হামিদুর রহমান হামিদ ও রফিকুল ইসলাম রাসেলকে নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে আলোচনা চলছে।
পট পরিবর্তনের পর দলের মনোনয়ন পেতে তারা গণসংযোগে ব্যস্ত সময় কাটালেও ২৩৭ আসনে প্রার্থী ঘোষণার পর কিছুটা হলেও ভাটা পড়েছে। শরিকদের আসনটি ছেড়ে দেওয়া হয় কিনা সেটা ভেবে তারা প্রচারণা কমিয়েছেন বলে দলটির অনেক নেতাকর্মীর ধারণা। তারপরেও প্রচার চালিচ্ছেন মনোনয়ন প্রত্যাশীরা।
বিএনপির এমন ‘ছিন্নভিন্ন’ অবস্থা কাজে লাগাচ্ছে জামায়াত। জামায়াত-সমর্থিত প্রার্থী হাজি এনায়েত উল্লাহ্র পক্ষে চষে বেড়াচ্ছেন দলটির নেতাকর্মীরা।
দলীয় পরিচয় তেমন না থাকলেও অনেক ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃত্ব দেওয়ায় হাজি এনায়েতের এলাকায় একটা প্রভাব আছে। পুরান ঢাকা ব্যবসায়ী এলাকায় হওয়ায় এই সুযোগকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন জামায়াত মনোনীত এই ব্যবসায়ী নেতা।
পলাশী এলাকার প্রবীণ ভোটার আসাদুজ্জামান বলেন, ‘বিএনপি প্রার্থী দিলে জামায়াতের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। কারও জেতা সহজ হবে না।’
হাজারীবাগ এলাকার শিক্ষক রফিকুল ইসলাম জানান, ‘জামায়াত-সমর্থিত প্রার্থীকে অনেক বছর ধরেই এলাকায় দেখা যায়। এনায়েত উল্লাহর সমর্থন আছে অনেক। বিএনপি যদি ভেতরে ভেতরে বিভক্ত থাকে, তাহলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কঠিন হবে।’
নাজিরাবাজার এলাকায় কয়েকজন তরুণ জানান, কয়েকদিন আগে বিএনপি নেতা হামিদের নেতৃত্বে একটি বড় মিছিল হয়। যেখানে মানুষের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
একইসঙ্গে তারা এও বলেন যে শুধু মিছিলে মানুষের ভিড় দিয়ে নির্বাচন আগাম বোঝা যায় না; দলীয় কাঠামো, ভোটারদের ঘরে ঘরে পৌঁছানো এবং শেষ মুহূর্তের পরিবেশ—সবই গুরুত্বপূর্ণ।
বিএনপি নেত্রী খালেদা আক্তার কল্পনার একটি মিছিলেও নারীদের ভিড় নজর কেড়েছে।
ঢাকা-৭ আসনটিতে তরুণ ভোটারের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। শনিরআখড়া, দনিয়া, রায়েরবাগ ও কদমতলী এলাকার তরুণ ভোটাররা রাজনৈতিকভাবে সচেতন, তবে তাদের অনেকের ভোট এখনো স্থির হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক ছাত্র বলেন, ‘দুই পক্ষই শক্ত। শেষ পর্যন্ত কে মাঠে বেশি কাজ করবে, সেটাই মূল নির্ধারক।’
ঢাকা-৭ আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী রফিকুল ইসলাম রাসেল ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকায় কাজ করছি। সাধ্যের মধ্যে সর্বোচ্চটা দিয়ে দলের জন্য, নেতাকর্মীদের পাশে ছিলাম। যে কারণে এবার মনোনয়নের বিষয়ে আশাবাদী। আশা করি দল মূল্যায়ন করবে। মনোনয়ন পেলে আসনটি দলকে উপহার দিতে চাই।
জামায়াত মনোনীত প্রার্থী হাজী এনায়েত উল্লাহ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি ভালোই মনে হচ্ছে। পরিবেশ ভালো। কোনো ধরণের ঝামেলা নেই। আশা করি পরিবেশ শেষ পর্যন্ত ভালো থাকলে ফলাফলও ভালো হবে।’
ব্যবসায়ী নেতা থেকে রাজনীতির মাঠে- চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা আমার জন্য ভালো হয়েছে। কারণ দীর্ঘদিন যাদের সঙ্গে কাজ করেছি, তারাই তো আমার আসনের সবখানে ছড়িয়ে আছেন। ফলে তারা আমার জন্য কাজ করছেন, ভোট চাইতে পারছেন।’
ঢাকা-৭ আসনে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন যারা
স্বাধীনতার পর থেকে ঢাকা-৭ আসনটিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা নেতৃত্ব দেন।
# ১৯৭৩ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আবদুল করিম বেপারী প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
# ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে আসনে জয়ী হন বিএনপির সিদ্দিকুর রহমান।
# ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে আসনটি দখল করেন জাতীয় পার্টির জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল।
# ১৯৯১, ১৯৯৬ (ফেব্রুয়ারি) এবং ১৯৯৬ (জুন) সালের নির্বাচনে বিএনপির সাদেক হোসেন খোকা নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি পুনরায় জয়ী হন।
# ২০০৮ সালে আসনে জয়ী হন আওয়ামী লীগের মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন।
# ২০১৪ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হাজী সেলিম এবং ২০১৮ সালে তিনি আবারও সংসদ সদস্য হন।
# সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মোহাম্মদ সোলায়মান সেলিম আসনটি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
এম/এমআর

