images

রাজনীতি

আওয়ামী লীগের কোন্দল প্রকাশ্যে, নানামুখী আলোচনা

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

০১ আগস্ট ২০২৪, ০৩:৪৯ পিএম

  • নির্দেশনা থাকার পরও মাঠে ছিলেন না নেতাকর্মীরা
  • দলের বিপদে দেশ ছেড়ে যাওয়া নেতাদের তালিকা তৈরি করার উদ্যোগ
  • ক্ষুব্ধ দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ আকস্মিকভাবে এক প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। এবারের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বেশ বেকায়দায় পড়েছে দলটি। বিশেষ করে চলমান আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাতের সময় দলের পক্ষ থেকে নির্দেশনা থাকার পরও মাঠে ছিলেন না মূল দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এতে দলের ভেতরে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। খোদ দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এতে ক্ষুব্ধ। দলের ভেতরে-বাইরে সব পর্যায়ে সাংগঠনিক দুর্বলতা ফুটে উঠেছে।

এ নিয়ে নানামুখি আলোচনা শুরু হয়েছে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ওপর ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা। তরুণ ও সাবেক নেতারা বৈঠকে ওবায়দুল কাদেরকে উদ্দেশ্য করে ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। যা পরিস্থিতিকে জটিল করেছে। তরুণ নেতারা মনে করছেন, দল ও সরকারের সঙ্কটে সাধারণ সম্পাদকের দায় বেশি। প্রধানমন্ত্রী দলের সভাপতি। তিনিই শেষ অবলম্বন। কিন্তু সব বিষয়ে তাকে নজর দিতে হলে সাধারণ সম্পাদকের কাজটা কী? এছাড়া তার অতিকথন পরিস্থিতিকে জটিল করেছে বলে অভিযোগ তাদের। মাঠের এমন পরিস্থিতি হাইকমান্ডকে চিন্তায় ফেললেও কেউ যেন দায় নিতে রাজি নন। শুধু আওয়ামী লীগেই নয়, সহযোগী সংগঠনগুলোতেও দলের বিপদে পাশে থাকা না থাকা নিয়ে চলছে নানান আলোচনা।

এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের সব সংগঠনের সমন্বয়হীনতা দূর করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে সুবিধাবাদী-ফাঁকিবাজ ও দলের বিপদে দেশ ছেড়ে যাওয়া নেতাদের তালিকা তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গুঞ্জন আছে, গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে নেতৃত্বের পরিবর্তনও হতে পারে। ব্যর্থতার দায়ে এরইমধ্যে ঢাকা উত্তরের ২৭ ইউনিটের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে।

AL_Problem--OK

যদিও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বলছেন, দীর্ঘদিন কমিটি না হওয়া, যোগ্যদের মূল্যায়ন না করে টাকার বিনিময়ে পদ-পদবি দেওয়ায় দলের বিপদে কাউকে পাশে পাওয়া যাচ্ছে না। মূল্যায়ন না পাওয়া নিয়ে প্রকাশ্যে ক্ষোভ ঝাড়ছেন অনেকে। এরই ধারাবাহিকতায় সাবেক ছাত্র নেতাদের তোপের মুখে পড়তে হয়েছে খোদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে।

শুধু তাই নয়, দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী ১৪ দলের নেতারাও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের কড়া সমালোচনা করছেন। বৈরী পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে তাদের সক্ষমতা নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রীর সামনে তারা প্রশ্ন তুলেছেন।

মধ্য জুলাইয়ে পুরোদমে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শুরুর দিকে পরিস্থিতি বেশ অনুকূলেই ছিল সরকারের। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি চললেও হঠাৎ করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে জড়ানোর মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে। বিশেষ করে ছাত্রদের আন্দোলন ঘিরে ১৮ ও ১৯ জুলাই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। ১৮ জুলাই ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়েও হামলার চেষ্টা হয়। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে কারফিউ দেওয়া হয়। এ পরিস্থিতির দায় কার?

আওয়ামী লীগের ভেতরে-বাইরে আলোচনা চলছে— এমন পরিস্থিতি তৈরির আগেই দলের পক্ষ থেকে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত আসলে তা হয়তো এড়ানো যেত। এজন্য অনেকেই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলছেন।

রোববার (২৯ জুলাই) রাতে গণভবনে অনুষ্ঠিত ১৪ দলের বৈঠকে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, দলের (আওয়ামী লীগ) ব্যর্থতা, প্রশাসনিক ভুলত্রুটির কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। এগুলো চিহ্নিত করে সমাধান করতে হবে। ওবায়দুল কাদেরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সাবেক এই তথ্যমন্ত্রী বলেন, তার বক্তব্য-বিবৃতি পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করে তোলে।

ঘুরে দাঁড়াতে কি করছে আওয়ামী লীগ?

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, কোটা আন্দোলন ঘিরে উত্তপ্ত পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হওয়ার পর গত ২৩ জুলাই বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঢাকা মহানগরী আওয়ামী লীগ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের শীর্ষ নেতা, ঢাকার দলীয় এমপিদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন ওবায়দুল কাদের। যেখানে নেতাকর্মীদের মাঠে না থাকার বিষয় নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতির ক্ষুব্ধ মনোভাবের কথা জানানো হয়। পাশাপাশি ভেদাভেদ ভুলে নিজেদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা কাটানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। একইসঙ্গে গা ঢাকা দেওয়া নেতাদের তালিকা তৈরি করতে দলীয় প্রধানের নির্দেশনার কথাও জানিয়ে দেন ওবায়দুল কাদের।

ওই বৈঠকে কোটা আন্দোলনের সময় সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি হওয়া এলাকার কাউন্সিলরদের ব্যর্থতার বিষয়ও তুলে ধরা হয় বলে জানা গেছে।

AL_Problem--Quota

প্রকাশ্যে আসছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল

এদিকে গত ২৬ জুলাই দল গোছাতে সমন্বয় সভা ডাকা হলে সেখানেও মাঠে থাকা না থাকার ইস্যু নিয়ে শীর্ষ নেতাদের সামনে ঢাকার নেতারা বাদানুবাদে জড়ান। একজন মাঠে ছিলেন দাবি করে বক্তব্য দিলে অন্যজন তা খণ্ডন করে প্রতিবাদ জানান। এক পর্যায়ে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ঢাকা-১৪ আসনের সংসদ সদস্য মাইনুল হোসেন খান নিখিল মাঠে কোনো নেতাকে পাশে পাননি বলে জানালে বিষয়টির প্রতিবাদ জানান ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক মান্নান কচি। এরপর বাদানুবাদে জড়ান এই দুই নেতা। পরে পরিস্থিতি কেন্দ্রীয় নেতারা সামাল দেন।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ছাত্রলীগের সাবেক নারী নেত্রীদের মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) রাতের এক বৈঠকে কারা মাঠে ছিলেন আর কারা ছিলেন না তা নিয়ে নিজেরাই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। যেখানে একজন যুব মহিলা লীগ মাঠে ছিল না এমন বক্তব্য দিলে অন্যরা প্রতিবাদ করেন।

এদিকে সবশেষ দলের অভ্যন্তরের সমস্যা সামনে আসে বুধবার (৩১ জুলাই)। দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা ডেকেছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। কিন্তু মতবিনিময় সভা ডেকে কাউকে কথা বলার সুযোগ না দেওয়ায় চটে যান সাবেক নেতারা। এমন আচরণকে ‘স্বেচ্ছাচারিতা’ বলেছেন তারা।

আমন্ত্রণ পেয়ে আসা ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা ওবায়দুল কাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ডেকে এনে আপনি একাই কথা বলা শুরু করলেন, আমাদেরও তো বহু কথা আছে।

তখন অনেকে ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দিতে থাকেন। একপর্যায়ে অনুষ্ঠান শেষ না করেই সভাস্থল ত্যাগ করেন ওবায়দুল কাদের।

আরও পড়ুন

কী বলছেন নেতারা?

সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির ঢাকা মেইলকে বলেন, সাংগঠনিক দুর্বলতা ওভাবে নেই। এবার কিছুটা সমন্বয়হীনতা ছিল। বিশেষ করে ডেমরা, উত্তরায় বেশি সমস্যা হয়েছে। ডেমরায় লোকাল সংসদ সদস্য দেশের বাইরে ছিলেন। আরেকটা বিষয় হলো পরিস্থিতি এমন হবে এটা ভাবনাতেও ছিল না অনেকের।

তিনি বলেন, যেহেতু ছাত্রদের আন্দোলন, তাই ফ্রন্ট লাইনে থেকে ছাত্রলীগ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারবে— এমনটাই আশা করা হয়েছিল। কিন্তু ঢাবি থেকে ওরা যখন বের হয়ে গেল তখন অন্যদের মাঝেও এর প্রভাব পড়েছে। এরা ক্যাম্পাসে থাকতে পারলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতো। এরসঙ্গে বিএনপি-জামায়াত তো সুযোগ নিয়েছে।

সামনের পরিকল্পনা নিয়ে তিনি বলেন, আমাদের শোকের মাসে প্রচুর অনুষ্ঠান থাকবে। ফলে নেতাকর্মীদের সক্রিয়তা থাকবে। আশা করি এই সময়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতা কেটে যাবে।

নিজেদের কষ্টের কথা তুলে ধরে সাবেক ছাত্রনেতাদের মতবিনিময়ে অংশ নেয়া ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল বলেন, আমাদের ডাকা হয়েছিল কথা বলতে। আমাদেরও তো কিছু কথা আছে। কিন্তু সেসব না শুনে সাধারণ সম্পাদক নিজে বক্তব্য রেখে চলে গেছেন। ছাত্রলীগ নেতাদেরকে সব সময় মাঠে খাটানো হয়, সব ধরনের রিস্ক নেয় ছাত্রনেতারা, কিন্তু নেতাদের কাছে কথা বলা যায় না।

বিইউ