images

রাজনীতি

খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর গুঞ্জন নিয়ে যা জানা যাচ্ছে

ঢাকা মেইল ডেস্ক

২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯:২০ পিএম

‘বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে 'বিদেশে নেওয়া হচ্ছে'- এমন একটি প্রচারণা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লেও তার দল ও পরিবারের সূত্রগুলো বলছে, তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার অনুমতি দেওয়ার কোনো ইঙ্গিত তারা সরকারের দিক থেকে এখনো পাননি। খালেদা জিয়ার জীবন রক্ষার্থে বিদেশে ‘এডভান্সড মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসা গ্রহণ অত্যাবশ্যক’ উল্লেখ করে বিদেশে নেওয়ার জন্য সরকারের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছেন তার ভাই। এর মধ্যেই শুক্রবার (২৯ সেপ্টেম্বর) আবারো হাসপাতালের কেবিন থেকে সিসিইউতে নেওয়া হয়েছে তাকে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক অবশ্য বৃহস্পতিবার সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, মিসেস জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশের নেওয়ার জন্য অনুমতি চেয়ে তার পরিবারের পক্ষ থেকে যে আবেদন করা হয়েছে সেটি যাচাই-বাছাই করে স্বল্প সময়ের মধ্যেই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হবে।

পরিবারের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়ার ভাই শামিম ইস্কান্দর সোমবার তাকে স্থায়ীভাবে মুক্তি দিয়ে বিদেশে চিকিৎসা দেওয়ার অনুমতি চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ওই আবেদন করেছেন। ওই আবেদনটির আইনগত দিক যাচাই বাছাইয়ের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে মন্ত্রী নিশ্চিত করেছেন।

আরও পড়ুন: তৃতীয়বারের মতো সিসিইউতে খালেদা জিয়া

যদিও এর আগে বিষয়টি নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য এসেছে সরকার ও বিএনপি দলীয় আইনজীবীদের পক্ষ থেকে। এক সপ্তাহে আগে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক নিজেই বলেছিলেন যে ‘আইনের বর্তমান অবস্থানে থেকে সরকারের আর কিছুই করার নেই’।

বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসনকে যে আইন অনুযায়ী শর্তযুক্ত মুক্তি ছয় মাস করে দিচ্ছে সরকার, সেই আইন বলেই তাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়ে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দেওয়ার সুযোগ আছে।’

প্রসঙ্গত, খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ দিতে কয়েক বছর ধরেই সরকারের কাছে আবেদন জানিয়ে আসছে তার পরিবার।

খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা কেমন

শামিম ইস্কান্দার সরকারের কাছে যে চিঠি দিয়েছেন সেখানে বলা হয়েছে, খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিস ও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন, যার আধুনিক চিকিৎসা বাংলাদেশে সম্ভব নয়।

চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘তিনি উঠে দাঁড়াতে পারেন না, এমনকি কারও সাহায্য ছাড়া ওয়াশ-রুম কিংবা শয়নকক্ষের বাইরেও যেতে পারেন না।’

আরও পড়ুন: খালেদার বিদেশ যেতে আইনি জটিলতা আছে কি?

ওদিকে বিএনপি নেতারা বারবারই বলছেন, ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এই সাবেক প্রধানমন্ত্রীর অবস্থা ‘সংকটাপন্ন’।

Khaleda2

গত ২৪ সেপ্টেম্বর নয়াপল্টনে বিএনপি অফিসের সামনে এক সমাবেশে খালেদা জিয়ার অসুস্থতার প্রসঙ্গ বলতে গিয়ে নেতাকর্মীদের সামনেই ‘কেঁদেছেন’ দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। খালেদা জিয়ার মুক্তি ও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবিতেই ওই সমাবেশের আয়োজন করেছিল বিএনপি।

মির্জা আলমগীর তখন বলেছিলেন, ‘হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বলেছেন আপনাদের কিছু করার থাকলে করেন। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। অবিলম্বে বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দিতে না পারলে বাঁচানো দুষ্কর হবে।’

এসব কারণেই জনমনে কৌতূহল তৈরি হয়েছে যে, খালেদা জিয়ার অবস্থা আসলে কেমন কিংবা তার স্বাস্থ্যের কী ধরনের অবনতি হয়েছে।

গত ১৩ জুন হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নেওয়ার পর তিনি পাঁচ দিন চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরেছিলেন। এরপর কয়েকবার অসুস্থতা বোধ করলে বাসাতেই তার চিকিৎসা দিয়েছেন তার চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ড।

অসুস্থতা বেড়ে গেলে গত ৯ আগস্ট রাতে মিসেস জিয়াকে যখন হাসপাতালে নেওয়া হয় তখন বলা হয়েছিল তিনি ‘শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন’। এরপর থেকে তিনি হাসপাতালেই আছেন এবং দু দফা তাকে সিসিইউতেও নিতে হয়েছে।

আরও পড়ুন: খালেদাকে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে সরকার, আশা ফখরুলের

এর মধ্যে গত ১৮ সেপ্টেম্বর দেশি-বিদেশি চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ডের বৈঠকের পর লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত খালেদা জিয়ার পরিপাকতন্ত্রে রক্তক্ষরণ ও কিডনি জটিলতার বিষয়টি জানান বিএনপি নেতারা।

বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, ঢাকার তার মেডিকেল বোর্ডের সাথে বিদেশি কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ছাড়াও সম্পৃক্ত হয়েছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমান।

বিদেশে নেওয়ার যুক্তি কী দেখাচ্ছে বিএনপি

দলের স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, দুই বছর আগেই মেডিকেল বোর্ড বিদেশে মাল্টি ডিসিপ্লিনারি সেন্টারে নিয়ে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার সুপারিশ করেছিলেন।

‘এখানে আসলে এখন তিনি শুধু সাপোর্টিভ ট্রিটমেন্ট পাচ্ছেন। যেমন জ্বর এলে জ্বরের চিকিৎসা। গত জুনে হার্টের রিং পরানো হয়েছে। কিন্তু এভাবে তো হবে না। তার মূল সমস্যার তো আর কোনো চিকিৎসা বাংলাদেশে নেই। এ কারণেই তাকে বিদেশে নেওয়া দরকার,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

রফিকুল ইসলাম বলছেন, মেডিকেল বোর্ডের নিবিড় পর্যবেক্ষণে তিনি আছেন, কিন্তু বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা না হওয়াতে মূল সমস্যাগুলো আরও জটিল আকার ধারণ করেছে।

কিন্তু জটিল আকার বলতে কী বোঝানো হচ্ছে এটি ‘রোগীর স্বাস্থ্য গোপনীয়তা’র কথা উল্লেখ করে আনুষ্ঠানিকভাবে দল বা মেডিকেল বোর্ডের কেউই বলতে রাজি হননি।

যদিও দলীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, মিসেস জিয়ার মূল সমস্যা এখন লিভার সিরোসিস এবং এ থেকে তার কিডনি ও ফুসফুস আক্রান্ত হয়েছে। ফলে কিছুদিন পর পর তার পেটে পানি জমছে এবং সেগুলো অপসারণ করতে হচ্ছে।

এর আগে থেকেই তিনি আথ্রাইটিস, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তবে এখন পরিপাকতন্ত্রের রক্তক্ষরণ ও কিডনি জটিলতা নিয়ে বেশি উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে দল ও পরিবারের মধ্যে।

আরও পড়ুন: খালেদা জিয়াকে বিদেশ নেওয়ার আবেদন পর্যবেক্ষণে আছে: আইনমন্ত্রী

বিদেশে নেওয়ার অনুমতি চেয়ে সরকারের কাছে তার ভাই সোমবার যে আবেদন করেছেন তাতে ‘লিভার সিরোসিস ও হৃদরোগ এবং ক্রনিক কিডনি ডিজিজ’ এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

বিদেশে নেওয়ার অনুমতি প্রসঙ্গ

সোমবার শামীম ইস্কান্দর নতুন করে আবেদনের পরেই আইনমন্ত্রী ‘যাচাই বাছাই করে স্বল্প সময়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার’ কথা বলার পর গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে যে, 'সরকার খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার অনুমতি দিতে যাচ্ছে।’

যদিও সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও আইন মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সূত্র দাবি করছে, এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হলে সেটি হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশে ফিরে আসার পর। সফরসূচি অনুযায়ী আগামী ৪ অক্টোবর তার ঢাকায় ফিরে আসার কথা রয়েছে।

তবে মিসেস জিয়ার শারীরিক পরিস্থিতি কেমন থাকে সেটির ওপরও সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে।

বিএনপির একটি অংশের নেতারা বলছেন, তাদের ধারণা সরকার খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার জন্য অনুমতি দিতে আরও সময় নিতে পারে। তবে এই সময়ের মধ্যে তার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

তবে এর ভিন্নমতও আছে। এক্ষেত্রে এক সপ্তাহের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের দু ধরনের বক্তব্যকে তারা সামনে নিয়ে আসছেন। প্রথমে তিনি বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার বিষয়ে সরকারের কিছু করার নেই। এরপর বৃহস্পতিবার তিনি বলেছেন বিদেশে নেওয়ার অনুমতি চেয়ে পরিবারের আবেদন ‘স্বল্প সময়ে’ যাচাই বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

Khaleda3

কায়সার কামাল বলছেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রীর শারীরিক অবস্থা সরকারের অজানা নয়। হাসপাতালে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আছে। সরকার সব কিছু জানে। আমরা আশা করি পরিবারের মানবিক আবেদনে সরকার দ্রুত সাড়া দেবে। আমরা শুধু বলতে পারি আইনগতভাবে এতে কোনো বাধা নেই।’

এখনকার পরিস্থিতি জটিল বলেই হয়তো আইনমন্ত্রী ‘স্বল্প সময়ে’র কথাটি বলেছেন বলে অনেকে মনে করছেন। সে কারণে এবার সরকারের কাছ থেকে ‘ইতিবাচক সিদ্ধান্ত’ আসবে বলে আশা করছেন দলটির অনেকে।

নতুন আবেদন নিয়ে জল্পনা

বিএনপি নেতারা বলছেন, ওয়ান ইলেভেনের সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নিজেও কারাগার থেকে বেরিয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে গিয়েছিলেন। তাছাড়া আওয়ামী লীগ নেতা হাজী সেলিম ও প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিমও কারাদণ্ড মাথায় নিয়েই বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি পেয়েছিলেন। খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি প্রসঙ্গে এই উদাহরণগুলোও তারা সামনে নিয়ে আসছেন।

আরও পড়ুন: 'ফাঁদে' পা দিতে বারণ করেছেন খালেদা জিয়া

গত ৫ সেপ্টেম্বর শামিম ইস্কান্দার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে খালেদা জিয়ার দণ্ডাদেশ স্থায়ীভাবে স্থগিতের জন্য যে আবেদন করেছেন সেখানে উল্লেখ করেছেন যে, ‘বেগম জিয়ার জীবন রক্ষার্থে ও শারীরিক সক্ষমতা ফিরিয়ে আনার জন্য জরুরি ভাবে উন্নতমানের ফিজিওথেরাপিসহ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে দেশের বাইরে ‘এডভান্সড মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসা গ্রহণ অত্যাবশ্যক।’

এ প্রেক্ষাপটে সব শর্ত শিথিল করে তাকে স্থায়ীভাবে মুক্তি ও বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার আবেদন করেছিলেন শামিম ইস্কান্দার।

ওই সূত্রটি দাবি করেছে যে, এরপর সরকারের দিক থেকেই শুধু মেডিকেল ইস্যু তুলে ধরে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ দেওয়ার আবেদন করার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলেই শামিম ইস্কান্দর নতুন করে আবার গত সোমবার বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছেন। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে এসব বিষয়ে কেউ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। -বিবিসি বাংলা

জেবি