প্রায় দেড় মাস ধরে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৭৮ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। হৃদরোগ, লিভারসিরোসিস, আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, দাঁত ও চোখের সমস্যাসহ নানা জটিলতায় ভুগছেন তিনি। এই অবস্থায় চিকিৎসকদের বরাতে প্রতিনিয়তই উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর দাবি জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। তবে নানা কারণ দেখিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কারাবন্দী খালেদা জিয়াকে বিদেশ যেতে অনুমতি মিলছে না।
আইনমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন- খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে যেতে হলে শর্তমুক্ত হতে হবে। যদিও সুপ্রিম কোর্টের আইনজ্ঞরা বলছেন, সরকার চাইলেই সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে দেশের বাইরে যেতে অনুমতি দিতে পারেন। এতে আইনের কোনো ব্যত্যয় হবে না।
বিজ্ঞাপন
আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের মতে, খালেদা জিয়াকে বিদেশ যেতে হলে নতুন করে আবেদন করতে হবে। এছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে আইনের অবস্থান থেকে সরকারের কিছুই করার নেই।
গতকাল সোমবার (২৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এমন কথা জানান তিনি। আইনমন্ত্রী বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়াকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ (১) এর ক্ষমতাবলে শর্তযুক্তভাবে সাজা স্থগিত রেখে মুক্তি দেওয়া হয়েছে এবং সেটা প্রধানমন্ত্রীর মহানুভবতায়। এখন আইনের যে পরিস্থিতি তাতে যদি কোনো পরিবর্তন আনতে হয়, বেগম খালেদা জিয়াকে আগে যে শর্তযুক্ত মুক্তি সেটাকে বাতিল করতে হবে। তারপর অন্য বিবেচনা করা যাবে।’
বিজ্ঞাপন
যদিও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা (অ্যাটর্নি জেনারেল) এ এম আমিন উদ্দিনের মতে, দুর্নীতির অভিযোগের মামলায় দণ্ডিত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হলে কারাগারে গিয়ে আবেদন করতে হবে। সোমবার বিকেলে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এমন কথা জানিয়ে তিনি বলেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার নিতে হলে তাদের নতুন করে আবেদন করতে হবে। তখন আগের আদেশ বাতিল হয়ে যাবে। আর আদেশ বাতিল হয়ে গেলে তিনি (খালেদা জিয়া) বাইরে থাকতে পারবেন না।
অন্যদিকে, ক্ষমা প্রদর্শনের অধিকার নিয়ে সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদে বলা আছে- কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত যেকোনো দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করিবার এবং যেকোনো দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করিবার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকিবে।
দণ্ড স্থগিত, মওকুফ ও রদবদল নিয়ে সিআরপিসিতে যা বলা আছে
দ্যা কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর, ১৮৯৮ এর ধারা ৪০১ এ দণ্ড স্থগিত বা মওকুফ করার ক্ষমতা (Power to suspend or remit sentences) কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা আছে। সেগুলো হলো-
(১) কোনো ব্যক্তি কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হইলে সরকার যেকোনো সময় বিনা শর্তে বা দণ্ডিত ব্যক্তি যাহা মানিয়া নেয়, সেই শর্তে তাহার দণ্ড কার্যকরীকরণ স্থগিত রাখিতে বা সম্পূর্ণ দণ্ড বা দণ্ডের অংশ বিশেষ মওকুফ করিতে পারিবেন।
(২) যখন কোনো দণ্ড স্থগিত রাখা বা মওকুফ করিবার জন্য সরকারের নিকট আবেদন করা হয়, তখন যে আদালত উক্ত দণ্ড দিয়াছিলেন বা অনুমোদন করিয়াছিলেন, সেই আদালতের প্রিজাইডিং জজকে সরকার উক্ত আবেদন মঞ্জুর করা উচিত কিংবা মঞ্জুর করিতে অস্বীকার করা উচিত কি-না সে সম্পর্কে তাহার মতামত ও মতামতের কারণ বিবৃত করিতে এবং এই বিবৃতির সহিত বিচারের নথির নকল অথবা যে নথি বর্তমানে আছে, সেই নথির নকল প্রেরণ করিবার নির্দেশ প্রদান করিতে পারিবেন।
(৩) যে সকল শর্তে কোনো দণ্ড স্থগিত রাখা বা মওকুফ করা হইয়াছে, তাহার কোনোটি পালন করা হয় নাই বলিয়া মনে করিলে, সরকার স্থগিত বা মওকুফের আদেশ বাতিল করিবেন এবং অতঃপর যে ব্যক্তির দণ্ড স্থগিত রাখা বা মওকুফ করা হইয়াছিল, সে মুক্ত থাকিলে যেকোনো পুলিশ অফিসার তাহাকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করিতে পারিবেন এবং তাহার দণ্ডের অনতিবাহিত অংশ ভোগ করিবার জন্য তাহাকে জেলে প্রেরণ করা যাইবে।
(৪) যেই শর্তে এই ধারার অধীন দণ্ড স্থগিত বা মওকুফ করা হয় যাহা, যে ব্যক্তির দণ্ড স্থগিত বা মওকুফ করা হয় সেই ব্যক্তি পূরণ করিবে অথবা শর্ত এমন হইবে যাহা পূরণে সে স্বাধীন থাকিবে।
(৪.ক.) এই বিধি বা অন্য কোনো আইনের কোনো ধারা অনুসারে কোনো ফৌজদারি আদালত কোনো আদেশ দান করিলে তাহা যদি কোনো ব্যক্তির স্বাধীনতা খর্ব করে অথবা তাহার বা তাহার সম্পত্তির উপর দায় আরোপ করে, তাহা হইলে উপরোক্ত উপধারা সমূহের বিধান এই আদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হইবে।
(৫) প্রেসিডেন্টের অনুকম্পা প্রদর্শন, দণ্ড স্থগিত রাখা বা কার্যকরীকরণে বিলম্ব ঘটানো বা মওকুফ করিবার অধিকারে এই ধারার কোনোকিছু হস্তক্ষেত্র করিবে বলিয়া মনে করা যাইবে না।
(৫.ক.) প্রেসিডেন্ট কোনো শর্ত সাপেক্ষ ক্ষমা মঞ্জুর করিলে উক্ত শর্ত যে প্রকৃতিরই হউক না কেন উহা এই আইন অনুসারে কোনো উপযুক্ত আদালতের দণ্ড দ্বারা আরোপিত শর্ত বলিয়া গণ্য হইবে এবং তদানুসারে বলবৎ যোগ্য হইবে।
(৬) সরকার সাধারণ বিধিমালা বা বিশেষ আদেশ দ্বারা দণ্ড স্থগিত রাখা এবং দরখাস্ত দাখিল ও বিবেচনার শর্তাবলী সম্পর্কে নির্দেশ দিতে পারিবেন।
এ ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার বিদেশ যেতে কোনো বাধা নেই বলে মনে করেন, সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, তাকে (খালেদা জিয়া) বিদেশ যেতে কেউ তো বাধা দেয়নি। কাজেই তিনি বিদেশ গেলে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না।
তবে বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে আদালতের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. অজি উল্লাহ। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, খালেদা জিয়া তার সাজার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করেছেন। সেটি শুনানির জন্য পেন্ডিং আছে। এমতাবস্থায় তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন কি-না, এমন সিদ্ধান্ত দেবেন আদালত। এটা সম্পূর্ণভাবে আদালতের এখতিয়ার। তার বিষয়ে আদালতের সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত। কবে বিদেশে যাবেন, কতদিন থাকবেন, কবে ফেরত আসবেন- এসব বিষয়ে আদালতের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে।
অন্যদিকে বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে সরকার সময়ক্ষেপণ করছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল। তিনি বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দিতে সরকারের কোনো বাধা নেই। তাদের কাছে আবেদনও করা হয়েছে। কিন্তু উন্নত চিকিৎসার জন্য আদালতে যেতে বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সময়ক্ষেপণ করছেন।
ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য আদালতে আসতে বলা সময়ক্ষেপণ এবং জাতিকে বিভ্রান্ত করার জন্য একটা কৌশল। কেননা গত ৫ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম ইস্কেন্দার একটি আবেদন করেছেন। বিদেশ যেতে খালেদা জিয়ার সেই আবেদন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গ্রহণও করেছেন। একটি সিলও দেওয়া আছে আবেদনে।
তবে দ্যা কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর, ১৮৯৮ এর ধারা ৪০১ ধারার বিধি অনুযায়ী খালেদা জিয়ার বিদেশ যেতে বাধা নেই বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী মোহাম্মা্দ শিশির মনির। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, সিআরপিসির ৪০১ ধারা অনুযায়ী খালেদা জিয়ার দেশের বাইরে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য যেতে আইনগত কোনো বাধা নেই। যেহেতু তিনি এখন সরকারের নির্বাহী আদেশে জামিনে আছেন। তার দণ্ড স্থগিত করা হয়েছে। তাই বিদেশ যেতে কোনো বাধা নেই।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বাসায় থেকে চিকিৎসা নেবেন এবং বিদেশে যেতে পারবেন না- এই দুই শর্তেই চলতি বছরের ২৬ মার্চ তার মুক্তির মেয়াদ সপ্তমবারের মতো আরও ছয় মাস বাড়ানো হয়, যা শেষ হয়েছে গত রোববার (২৪ সেপ্টেম্বর)। শর্তসাপেক্ষ মুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই খালেদা জিয়ার মুক্তি ও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি চেয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আবেদনও করা হয়েছে।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের সাজা হয়। সেদিন থেকেই কারাবন্দী হন তিনি। এরপর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার আরও সাত বছরের সাজা হয়। তবে ২০২০ সালের মার্চে নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়ার দণ্ড ছয় মাসের জন্য স্থগিত করা হয়। তখন থেকে তিনি গুলশানের বাড়িতে রয়েছেন। এরপর থেকে প্রতি ছয় মাস পরপর সরকার তাঁর সাজা স্থগিতের মেয়াদ বাড়াচ্ছে।
এআইএম/আইএইচ