ঢাকা মেইল ডেস্ক
২৬ জুলাই ২০২৫, ০৪:৩৪ পিএম
সাংবাদিক শফিক রেহমান এবং ফজলে লোহানী বাংলাদেশের সোনালি যুগের উজ্জ্বল দুই মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। চৌকষ বাই লিঙ্গুয়াল স্মার্ট লোক, প্রাচ্য-প্রতীচ্যের সংস্কৃতির ওপর যাদের অগাধ দখল; যারা ‘যায়যায় দিন’ আর ‘যদি কিছু মনে না করেন’ এর মতো সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকের মিডিয়া উপকরণ পাঠক ও দর্শকের সামনে রেখেছিলেন।
কিন্তু দুজনেই বেঙ্গল রেনেসাঁর এঁকে দেওয়া সংস্কৃতির লক্ষ্মণরেখার মাঝে আটকে থাকেননি। বেঙ্গল রেনেসাঁর মানসপুত্র আওয়ামী লীগ ও বাম দলের মতো করে ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে বরণ করেননি; বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক নিজস্বতা চর্চা করেছেন; অমনি হাসিনা-মেনন-ইনুর শিষ্যরা তাদেরকে ডানপন্থী তকমা দিয়ে ফেলেছেন। ভাবতে পারেন প্রথম প্রজন্মে শার্ট প্যান্ট পরে দুটি রবীন্দ্র সংগীত শুনে আর দু'পাতা কার্ল মার্কস উলটে কী রকম আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়; যা দিয়ে বাংলাদেশের সে সময়ের সবচেয়ে স্মার্ট দু'জন মানুষকে ডানপন্থীর তকমা দেয় সহমত ভাই ও শিবব্রত দাদা।
শফিক রেহমান ও ফজলে লোহানী কলকাতার সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের পাশাপাশি পশ্চিমা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের পাঠক ও দর্শক ছিলেন। ফলে তারা ঢাকা টু কলকাতা কালচারাল সিটিং সার্ভিস নিজেদের আটকে না রেখে ঢাকা টু লন্ডন, প্যারিস কালচারাল উড়ালে বিশ্বনাগরিক হয়ে উঠেছিলেন।
ফলে ঢাকা শহরে যারা সংস্কৃতি মামা ও খালা হয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদার হয়ে ঘুরে; তাদের ভীষণ ঈর্ষা হতো শফিক রেহমান ও ফজলে লোহানীকে দেখে। দুপুর বেলা জোড়া সাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সদস্যদের মতো পোশাক পরে ললিতা দিদির বাসায় অষ্টব্যঞ্জনের আহারান্তে দুটি রবীন্দ্র সংগীত শুনতে শুনতে এক বোতল খুশীজল ষোলজন ভাগ করে পানের নেমন্তন্ন রক্ষা তারা করতেন না। বরং রবীন্দ্র-নজরুল সংগীত, হারানো দিনের গান, বেতোফেন, মোতযার্ট শুনতে শুনতে সামান্য খুশিজল গলা ভেজাতেন। ঐটেই কাল হয়েছে; আর তাই স্টাইলিশ ওয়েস্টার্ন আউটফিট পরা ক্লিন শেভড লোকদুটোকে আনারকলি আপা, ললিতাদি বড় গলা করে ডানপন্থী বলেছে।
আচ্ছা বলুন তো, সহমত ভাই, শিবব্রত দাদা, ললিতাদি, আনারকলি আপার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কী আলাপ করবেন! রবীন্দ্র দর্শনের গভীরে ডুব দিতে পারলে প্রথমেই যা শেখার কথা; তা হচ্ছে বিনয়-শিষ্টাচার আর নৈর্ব্যক্তিকতা। প্রাথমিক শর্তই তো পূরণ করতে পারেন না এসব রবীন্দ্র পূজারিনীরা।
কিন্তু ঢাকা শহরের বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে রবীন্দ্র মন্দিরের পুরোহিত ও পূজারিনীরা রবীন্দ্রনাথের একটা লাইন আত্মস্থ না করে রবীন্দ্র বিলাপ করে।
হাসিনা ও মেননের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা পৃথিবীর যেকোনো বিষয় নিয়ে রাজনীতি করলে তা জনসাধারণের কাছে অপছন্দের বিষয় হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ ও শেখ মুজিবের ছবি ঝুলিয়ে দেড় দশক স্বৈরাচারী শাসনে সহস্র মানবতাবিরোধী অপরাধ করতে করতে যেমন ছবি দুটোতে ফিনকি দেওয়া রক্ত এসে লেগেছে।
আপনি ভাবতে পারেন, ফেসবুকের কাভারে বঙ্গবন্ধুর ছবি ঝুলিয়ে প্রতিদিন সকালে রবীন্দ্র সংগীত শেয়ার করা সংস্কৃতি মামা ও খালা গত বছর জুলাইয়ে যখন শিশু-কিশোর-তরুণ হত্যায় অন্ধ সমর্থন করে অনুশোচনাহীন থেকেছেন; তখন নতুন প্রজন্মের মানসচক্ষে রবীন্দ্রনাথ ও মুজিবের কী রকম চিত্রকল্প তৈরি হয়েছে। হিন্দুত্ববাদী নরেন্দ্র মোদির প্রশাসন ও মিডিয়া গত বছর জুলাইয়ের ১৬ তারিখ থেকে যখন এই নিহত শিশু-কিশোর-তরুণকে ডানপন্থী তকমা দিয়ে চলেছে; তখন মোদি প্রগতিশীলতার কী ক্যানিবাল চেহারা জনমানসে জায়গা করে নেয়।
মিথ্যাবাদী রাখালের ‘বাঘ এসেছে, বাঘ এসেছে’ ডানজুজুর গপ্পোটা সেই আশির দশক থেকে শুরু হয়েছে; ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া স্মার্ট সুদর্শন ক্লিনশেভড রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, যার মা সোনালি যুগে রেডিওতে গান গাইতেন; তিনি ভারত-আওয়ামী লীগ-বামের চোখে একজন ডান ছিলেন। ভারতের আকাশে যখন কট্টর হিন্দুত্ববাদী সূর্যের আভাস মিলেছে, তখন তাদেরই মানসপুত্র হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আওয়ামী লীগ ও বামের চোখে ডান হয়ে যান। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে এদের সহযোগী জামায়াতও তখন এরশাদের চেয়ে একটু কম ডান হয়ে যায়। এরপর আধুনিকা সুদর্শিনী খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এলে; তিনি আপন সৌন্দর্য্যে বৈরী হন। ফলে হাসিনা, ললিতাদি ও আনারকলি আপারা তাকে ডান তকমা দেয়। খালেদার বিরুদ্ধে আন্দোলনে জামায়াত আওয়ামী লীগের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হলে; তখন খালেদার চেয়ে জামায়াত একটু কম ডান হয়।
২০০১ সালে বিএনপি যখন জামায়াতের সঙ্গে কোয়ালিশন করে ভোটে জিতে ক্ষমতায় যায়; তখন বিএনপি হয়ে যায় জামায়াতের প্রতিশব্দ। কিন্তু ২০০৯ সালের পর ক্ষমতায় এসে এক কাঁধে হিন্দুত্ববাদ আরেক কাঁধে মদিনা সনদ নিয়ে ফ্যাসিজমের শুভ সূচনা করলেও হাসিনা তাহাজ্জুদের নামাজ পড়া ধরলে, কালক্রমে হেফাজতের ‘কওমি জননী’ হয়ে উঠলে, এমনকি মেনন হজ করে এলেও; যেহেতু ভারতের রাম মন্দিরের আশীর্বাদ রয়েছে তাদের ওপরে; ভারতের হিন্দুত্ববাদী মিডিয়ার চোখে তারা প্রগতিশীলতার একমাত্র নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হয়ে রয়ে যায়। ওই যে আওয়ামী লীগ করলে, গুষ্টির কারো মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের, শহীদ হবার ইতিহাস না থাকলেও তারা যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রচারক ও মালিক হয়ে যায় ব্যাপারটা তেমনি।
এসব গাজোয়ারি সংস্কৃতিটাই বাংলাদেশের নিয়তি। ২০২৪-এর ৫ আগস্টে এই গা জোয়ারি রাক্ষস সংস্কৃতিকে ভারতে পাঠিয়ে দেবার পর থেকে ভারত উতলা। তিল তিল করে সাজিয়ে তোলা অখণ্ড ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ কী করে অজেয় রয়ে গেল; ভারতের চিন্তক বীণা সিক্রি, হর্ষবর্ধন শ্রিংলা, অনুরাধা দত্ত, চন্দন নন্দী পঁই পঁই করে খুঁজতে থাকেন। আর ভারতীয় সংস্কৃতির স্থানীয় অনুসারী সহমত ভাই, শিবব্রত দাদা, ললিতাদি, আনারকলি আপা তোতাপাখির মতো ‘ডানপন্থী’ ‘ডানপন্থী’ রব তোলে। আবার যদি ৫ আগস্টকে ৭ নভেম্বরের সঙ্গে ইকুয়ালাইজ করে; মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাঁচাও, বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাঁচাও, রবীন্দ্রনাথ ও মুজিবের মূর্তি ফিরিয়ে দাও, তুমি কে আমি কে মোদি মোদি রব তুলে রিফাইন্ড আওয়ামী লীগের তাল তুলে জোহরা তাজউদ্দিন টু পয়েন্ট ও'কে দিয়ে পাটাতন তৈরি করে ভারতনন্দিনী হাসিনাকে ফেরত আনা যায়; বিজেপি ও আওয়ামী লীগ একসঙ্গে কাজ করে যদি আবার অখণ্ড ভারত প্রকল্প দাঁড় করানো যায়; মানুষের তো কতরকমই কষ্টকল্পনা থাকে। হোক না ইউটোপিয়া।
সুতরাং পথের বাধা সরিয়ে নাও, আমরা যারা আধুনিক ও লিবেরেল জীবন যাপন করি, ছায়ানটে গান শিখি, রবীন্দ্র সংগীত শুনি; তাদের জন্য বড্ড দুঃসময় চলছে। বঙ্গভঙ্গে আতঙ্কিত জমিদার পুত্রের মতো এক্ষুণি বঙ্গভঙ্গরোধ প্রকল্পে নেমে পড়তে ইচ্ছা করছে। সাম্যের কথা মুখে বলতে বড্ড আরাম; কিন্তু আমার চলার পথে আনস্মার্ট, অলিবেরেল, ছায়ানটে গান না শেখা, রবীন্দ্র সংগীত না শোনা লোকেদের দেখতে ইচ্ছা করে না। কারণ আমরা রাস্তার বাম দিক দিয়ে হাঁটি আর ওরা হাঁটে ডান দিন দিয়ে।
রবীন্দ্র সংগীত শোনা শফিক রেহমান আর ফজলে লোহানীকেই আমরা ডান তকমা দিয়েছিলাম; আর তোমরা কোন ছাড়; তোমাদের বাড়িতে কী টেরেস আছে, পোর্টিকোতে দাঁড়িয়ে থাকে গাড়ি, তোমরা কি আর্ট গ্যালারিতে গিয়ে কীভাবে চিত্রকর্মের দিকে তাকাতে হয় তা জানো, ব্যাটলশিপ পটেমকিন ছবির প্যারাম্বুলেটরের দৃশ্যটি নিয়ে পুরো একটি দিন কাটিয়ে দিতে পারো মোহাচ্ছন্নতায়। চারুলতার দোলনা কি তোমাদের প্রাণে দোলা দেয়!
‘Fascism is not defined by the number of its victims, but by the way it kills them.’
— Jean-Paul Sartre, What is Fascism?, 1944
লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক