images

জাতীয়

বদলে গেছে রান্নার ‘রুটিন’

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন

১৩ জানুয়ারি ২০২৩, ১১:২৫ এএম

রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের অধিকাংশ এলাকায় চলছে তীব্র গ্যাস সঙ্কট। শিল্প-কারখানা ও আবাসিক- উভয়ক্ষেত্রেই এই সঙ্কট চরম আকার ধারণ করেছে। বেশিরভাগ এলাকার বাসাবাড়িতে দিনের বেলায় জ্বলে না চুলা। রাতে চুলা জ্বললেও গ্যাসের চাপ কম থাকে। পূর্ণমাত্রায় গ্যাস আসে মধ্যরাতে। আবার ভোর হওয়ার আগেই গ্যাস চলে যায়। তাই এসব এলাকার মানুষদের রান্নার করতে হচ্ছে গভীর রাতে। এতে বদলে যাচ্ছে কোটি মানুষের দৈনন্দিন রান্নার রুটিন।

রাজধানীর মালিবাগ, বাসাবো, বনশ্রী, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, মুগদা, মান্ডা, মানিকনগর, জুরাইন, কামরাঙ্গীরচর, পুরান ঢাকা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, গাবতলী এলাকায় গ্যাসের এই সঙ্কট অনেকটা নিয়মিত সমস্যা। শীতকাল এলেই দিনের বেলা চুলা জ্বলে না এসব এলাকায়। তবে সম্প্রতি মগবাজার, ইস্কাটনসহ অনেক অভিজাত এলাকাতেও গ্যাসের তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সবমিলিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন নগরের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ।

ভুক্তভোগীরা জানান, ভোর ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত গ্যাস থাকে না। অবস্থা এমন যে রাতের বেলায় রান্না করে রাখারও উপায় নেই। কারণ রাতে রান্না করলেও দিনের বেলায় সেই খাবার গরম করার সুযোগ নেই। ফলে অনেকেই বাধ্য হয়ে সিলিন্ডার গ্যাস ও ইলেক্ট্রিক চুলা ব্যবহার করছেন।

gas-cook

পুরান ঢাকার বাসিন্দা মোমিন ঢাকা মেইলকে বলেন, সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত একদম গ্যাস থাকে না। রাত ৮-৯টার দিকে আসে, তাও ফুল প্রেসার থাকে না। অনেক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

আরও পড়ুন: গ্যাস সংকটে বছরজুড়ে ‘টালমাটাল’ শিল্প খাত

মিরপুর এলাকার তামান্না ইসলাম বলেন, সকাল থেকে চুলা জ্বলে না। ২০২১ সালের দিকে ভালোই ছিল। গত বছর (২০২২) থেকে গ্যাস থাকে না। ভোরে চলে যায়। আসে একবারে সন্ধ্যার দিকে। ছুটির দিনেও গ্যাস থাকে না। আমরা বড়রা তো তাও চলতে পারি। কিন্তু ছোট বাচ্চাদের নিয়ে কি করব? তাদের খাবার তো ঠিকমতো রান্নাও করতে পারছি না।

গ্যাসের এই সঙ্কটে বিপদে পড়েছেন বিভিন্ন মেসে থাকা শিক্ষার্থী ও ব্যাচেলররাও। অধিকাংশ সময় তাদেরকে বাইরে থেকে কিনে খেতে হচ্ছে।

gas-cook

মুগদা এলাকার মেসে থাকা এক শিক্ষার্থী বলেন, সকাল-সন্ধ্যা গ্যাস থাকে না। বুয়া এসে গ্যাস পায় না। চলে যায়। বাইরে থেকে কিনে খেতে হয়। এতে অনেক বেশি খরচ হয়। অনেক সময় চিড়া-মুড়ি খেয়ে থাকতে হয়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তীব্র ক্ষোভ ঝাড়ছেন অনেকে। রিয়াজউদ্দীন নামে একজন ফেসবুকে লিখেছেন, শীত আসলেই শোনা যায় বাসায় গ্যাস নাই, রান্না ঠিকভাবে হচ্ছে না। অথচ মাস শেষে গ্যাসের বিলে কোনো ছাড় নাই। অনেকটা বুফে স্টাইলেই চলে আমাদের তিতাস গ্যাস কোম্পানি। এটা এখনকার কথা না, যুগ যুগ ধরে চলছে এভাবেই। ছোট দেশ অথচ সারা দেশে একসাথে কোনো কিছুই এক্সিকিউট করতে পারে না এরা। না আছে কর্মদক্ষতা, না আছে সঠিক প্ল্যানিং। অথচ প্রতি মাসে উনারা কোটি কোটি টাকা খরচ করেন বিদেশ ভ্রমণে।

আরও পড়ুন: এক দিনে পাঁচ হাজার অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন

রহিমা বেগম নামে রাজধানীর বনশ্রীর এক বাসিন্দা বলেন, আগে তো সকাল ৮টা সাড়ে ৮টা পর্যন্ত এবং দুপুর দুইটার পর থেকে কিছুটা গ্যাস থাকত। রাতে তরকারিটা রান্না করে রাখলে সকালের নাস্তা আর দুপুরের ভাত দিনেই করতাম কোনোরকমে। তিন-চারদিন ধরে তাও পারছি না। ঠান্ডা কাশির ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়েছিলাম, সকালে উঠতে একটু দেরি হলো বলে কিছুই করতে পারলাম না। যেই আগুন, তাতে না গরম হলো রুটি সেকার তাওয়া, না ডিম ভাজার তেল। তরকারি গরম করব সেই গ্যাসও নাই। সারাদিন চুলায় ভাতের পানি বসিয়ে রেখেছি। এই শীতে একটু পানি গরম করে বাচ্চাদের গোসল করতে দেব- সেটা তো বিলাসী চিন্তাভাবনা।

gas-cook

এমন অবস্থায় বিকল্প হিসেবে নানা উপায় খুঁজতে শুরু করেছে মানুষ। অনেকেই লাইনের গ্যাসের পাশাপাশি সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করছেন। অনেকেই ইলেক্ট্রিক চুলা ব্যবহার করছেন। এতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে বহু গুণ।

কিন্তু যাদের সামর্থ নাই তারা ভিন্ন উপায় অবলম্বন করছেন। যেমন- ব্যাচেলর বাসায় ভাড়া থাকেন মনির। তিনি জানান, ভাত রান্নার পর মাড় ফেলতে যে স্ট্যান্ড ব্যবহার করা হয় সেটাকেই তিনি চুলা হিসেবে ব্যবহার করে কাগজ, প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন পরিত্যক্ত জিনিস দিয়ে রান্না সেরে নিচ্ছেন। মনির ঢাকা মেইলকে বলেন, উপায় নাই। বাইরে থেকে খাবার কিনতে গেলে অনেক খরচ। তাই বাধ্য হয়েই এই পন্থা বেছে নিয়েছি।

আরও পড়ুন: একই এলাকায় তিন ধরনের গ্যাস বিল!

চলমান এই গ্যাস সঙ্কট কবে দূর হবে তা বলতে পারছে না বিতরণ প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। সংস্থাটি বলছে, বর্তমানে তিতাসের আবাসিক গ্রাহক সংখ্যা ২৮ লাখ ৫৭ হাজার ৯৪৮। বাণিজ্যিক সংযোগ রয়েছে ১২ হাজার ৭৮টি। বর্তমানে সারা দেশে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট, এর বিপরীতে সরবরাহ ২৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট। দৈনিক প্রায় এক হাজার ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ কম হচ্ছে। দৈনিক সরবরাহের মধ্যে গড়ে ৪২১ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা হচ্ছে। আর বাদবাকি অংশ দেশীয় খনির গ্যাস। চাহিদার চেয়ে অনেক কম সরবরাহ থাকায় শুধু ঢাকা নয়, আশপাশের সাভার, গাজীপুর, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের চাপ থাকছে না। ফলে উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে এসব এলাকার শিল্প-কারখানায়।

gas-cook

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তিতাসের গ্যাস নিয়ন্ত্রণ শাখার এক প্রকৌশলী ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের পাইপ লাইনেই গ্যাস কম। গ্রাহকরা অভিযোগ দিলেও আমরা কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছি না। কবে নাগাদ এই সমস্যা সমাধান হতে পারে তা আমরা বলতে পারছি না। কারণ এলএনজি কেনা বন্ধ আছে। আমদানি না করা পর্যন্ত বা পর্যাপ্ত সরবরাহ না করা পর্যন্ত এই সমস্যা থাকবে। শীতে কিছুটা গ্যাস জমে যায়। তবে তা হিসাবের মধ্যে পড়ে না। মূলত পাইপ লাইনেই গ্যাস সরবরাহ কম।

বিষয়টি নিয়ে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী হারুন অর রশিদ মোল্লা বলেন, এনার্জির প্রাইস এত বেড়ে গেছে যে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা সম্ভব হচ্ছে না। সাড়ে তিনশ থেকে চারশ মিলিয়ন গ্যাসের ঘাটতি। এর প্রভাব সব জায়গায় পড়ছে।

টিএই/জেএম