images

জাতীয়

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ছিল জয়ের অর্থ পাচারের প্রকল্প: শ্বেতপত্র

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৪:২৩ এএম

প্রযুক্তির উন্নয়নের কথা বলে ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ প্রকল্পের নামে যে ডাকঢোল পিটিয়েছে ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার, সেটি ছিল মূলত তার ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয়ের অর্থ পাচারের প্রকল্প। 

হাসিনা সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে আইসিটি ও টেলিকম খাতের অনিয়ম, দুর্নীতির ঘটনা অনুসন্ধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠিত টাস্কফোর্সের তৈরি করা শ্বেতপত্রে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে তিন হাজারের বেশি পৃষ্ঠার এই শ্বেতপত্র হস্তান্তর করা হয়েছে।  

 

 

শ্বেতপত্রে বলা হয়, এই প্রকল্প ছিল ‘রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব’। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ (বর্তমান নাম বাংলাদেশ স্যাটেলাইট-১) প্রকল্প অনুমোদনেই দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। অতিরিক্ত ব্যয়, অস্পষ্ট ব্যবসায়িক পরিকল্পনা এবং আয়-ব্যয়ের হিসাব নিয়ে বহু প্রশ্ন থাকলেও সেগুলো উপেক্ষা করা হয়। অডিট আপত্তিও নিষ্পত্তি করা হয়নি।  

image
বাংলাদেশ স্যাটেলাইট

আওয়ামী সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশের দুর্নীতি ও অনিয়মের তথ্য অনুসন্ধানে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে সাত মাস আগে গঠন করা হয় উচ্চপর্যায়ের পৃথক দুটি টাস্কফোর্স। টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে আইসিটি খাতে প্রকল্পের নামে পরিকল্পিত অপচয়, একই কোম্পানিকে বারবার কাজ দেওয়া, প্রশিক্ষণের নামে রাষ্ট্রের অর্থ লোপাট ও এ-টু আই প্রকল্পে ভ্যালু ফর মানি পর্যালোচনা না করে আইসিটি খাতকে প্রকল্পভিত্তিক অর্থ বিতরণে একটি রাজনৈতিক ইকো সিস্টেমে পরিণত করা হয়। 

অন্যদিকে, টেলিকম খাতে এসওএফ (সোশ্যাল অবলিগেশন ফান্ড) থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা লোপাট, টেলিকম লাইসেন্সের নীতিতে সাধারণ মানুষের জন্য এক নিয়ম এবং আওয়ামী ঘনিষ্ঠদের জন্য ছিল আরেক (ভিআইপি) নিয়ম, পছন্দের প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে দেওয়া হয় হাজার কোটি টাকার জাতীয় ফাইবার নেটওয়ার্ক। একইসঙ্গে বিটিসিএল ও টেলিটককে করা হয় ভঙ্গুর। 

 

 

এভাবে টেলিকম খাতের ৪২ প্রকল্প ছিল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের নেটওয়ার্ক। যার প্রায় প্রতিটির পেছনে ছিলেন সজীব ওয়াজেদ জয়। তাকে সহায়তা করেন দায়িত্বরত মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা। সর্বশেষ টেলিযোগাযোগ খাতের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন জুনায়েদ আহমেদ পলক। তাকে দিয়ে জয় ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীরা তাদের সুবিধা হাসিল করে নেন।  

Bangabandhu_Satellite-1
বাংলাদেশ স্যাটেলাইট

এই শ্বেতপত্রে উঠে এসেছে, ‘ডিজিটালাইজেশনের নামে কীভাবে ধ্বংস করা হয়েছে নীতি, শাসনব্যবস্থা ও জনস্বার্থ।’ শুধু তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) খাতের ৬৫০ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্রে অনিয়ম, পরিকল্পিত পদ্ধতিগত অপচয় আর দুর্নীতির প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে। এতে ডিজিটাল কানেকটিভিটি, হাইটেক পার্ক, এ-টু আই, প্রশিক্ষণ প্রকল্প সব খানেই কেস স্টাডিভিত্তিক দুর্নীতির চিত্র উঠে আসে। এ খাতে টাস্কফোর্সের নেতৃত্ব দিয়েছেন আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ ড. এম. নিয়াজ আসাদুল্লাহ। সহযোগী ছিলেন অধ্যাপক রেজওয়ান খান, অধ্যাপক চৌধুরী মফিজুর রহমান ও অধ্যাপক রিফাত শাহরিয়ার।

আইসিটি শ্বেতপত্রে দেখানো হয়েছে, আইসিটি খাতের প্রায় সব প্রকল্পেই আওয়ামী সরকার ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে উপস্থাপন করা হতো। একই কোম্পানি বারবার ভিন্ন নামে টেন্ডার পেত। প্রশিক্ষণের নামে কোটি কোটি টাকা গেছে নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে। হাইটেক পার্কে জমি বরাদ্দ ও নির্মাণ ব্যয়ে ক্ষমতাসীনদের দৌরাত্ম্য ছিল লাগামহীন। এ-টু আই প্রকল্পে ভ্যালু ফর মানি পর্যালোচনা করা হয়নি কখনোই।

অন্যদিকে টেলিকম খাত নিয়ে প্রস্তুতকৃত আড়াই হাজার পৃষ্ঠার শ্বেতপত্রটি আরও বিস্ফোরক। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর ৪২টি প্রকল্প পর্যালোচনা করে দেখানো হয়েছে, প্রায় অর্ধেক প্রকল্পেই গুরুতর অনিয়ম, অদক্ষতা ও স্বার্থসংঘাতের দৃষ্টান্ত পাওয়া গেছে। সবচেয়ে আলোচিত বিষয়, সোশ্যাল অবলিগেশন ফান্ড (এসওএফ)।  

 

দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সাশ্রয়ী ইন্টারনেট নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হলেও এর মধ্যে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ৭টি প্রকল্প অনুমোদনে চরম অনিয়ম পাওয়া গেছে। প্রকল্প অনুমোদনের মানদণ্ড না মানা, অযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া, প্রাথমিক সম্ভাব্যতা যাচাই না করা, এসব অভিযোগ শ্বেতপত্রে স্পষ্টভাবে লেখা রয়েছে। টেলিকম খাত পর্যালোচনাকারী কমিটির মন্তব্য, ‘এসওএফ ফান্ড কার্যত রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটের হাতে চলে গিয়েছিল।’ 

image
বাংলাদেশ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের আগমুহূর্তে

শ্বেতপত্রে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত লাইসেন্সিং প্রক্রিয়ার যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা পুরো খাতের নীতি ও শাসনব্যবস্থার ভয়াবহ ভাঙনকে স্পষ্ট করে। নথিতে বলা হয়েছে, ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠ কয়েকটি কোম্পানি লাইসেন্স পেয়েছে অস্বাভাবিক দ্রুত সময়ে। অথচ একই শর্তে থাকা অন্যান্য আবেদনকারীকে বছরের পর বছর অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে। একাধিক ক্ষেত্রে নীতিমালা উপেক্ষা করে নিয়মবহির্ভূতভাবে লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে। এমনকি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী উদ্যোক্তাদের সুবিধা দিতে বিশেষ শর্তও বাতিল করে দেওয়া হয়।

রাষ্ট্রের হাজার কোটি টাকার সম্পদ জাতীয় ফাইবার নেটওয়ার্ককে বেসরকারি কোম্পানির আধিপত্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জাতীয় নেটওয়ার্ক-নিরাপত্তাকেও ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। এই প্রেক্ষাপটে সামিট কমিউনিকেশনস ও ফাইবার অ্যাটহোম নামে দুটি প্রতিষ্ঠান কীভাবে বাজার দখলদারিত্ব, নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর প্রভাব এবং নীতিভিত্তিক অসমতা তৈরি করেছে সে তথ্যও উঠে এসেছে এতে।

শ্বেতপত্রে বিটিআরসির বিষয়ে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি বছরের পর বছর ধরে অনিয়মিত নিয়োগ, যোগ্যতা-অযোগ্যতার ইচ্ছাকৃত ব্যতিক্রম এবং নিয়ম পরিবর্তনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ সুবিধা তৈরির সংস্কৃতি গড়ে তুলে। প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ছাড়াই বিশেষ ব্যক্তিদের নিয়োগ, বয়সসীমা অতিক্রম করা প্রার্থীদের জন্য নিয়ম পরিবর্তন, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের পুনরায় নিয়োগের মাধ্যমে স্বার্থসংঘাত ও পক্ষপাত সৃষ্টি, এমনকি প্রকল্পভিত্তিক কর্মীদের আইনবহির্ভূতভাবে স্থায়ী করার মতো গুরুতর অনিয়মের অভিযোগও শ্বেতপত্রে উঠে এসেছে। এর পাশাপাশি বড় বড় বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে বিটিআরসির ‘অস্বাভাবিক ঘনিষ্ঠতা’ পুরো লাইসেন্সিং ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। কমিটির ভাষায়, ‘বিটিআরসি নিজেই নিয়ম ভাঙার সংস্কৃতি’ তৈরি করেছে।

রাষ্ট্রীয় দুই অপারেটর-বিটিসিএল ও টেলিটকসংক্রান্ত পর্যবেক্ষণে বলা হয়, রাজনৈতিক সুপারিশে অদক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, এমনকি ভুয়া সনদ ব্যবহার করে চাকরি পাওয়ার ঘটনাও উপেক্ষিত হয়েছে। চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের ‘বিশেষ সুবিধায়’ স্থায়ী করার মতো নীতিবহির্ভূত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অডিট ছাড়াই টেন্ডার সম্পন্ন হয়েছে, আর বহু প্রকল্প বিশেষ করে হটস্পট ও টাওয়ার অবকাঠামো দীর্ঘদিন ধরে অচল অবস্থায় পড়ে আছে।

ক.ম/