images

জাতীয়

আয়ের সিংহভাগ ‘গিলে নিচ্ছে’ বাড়িভাড়া

আব্দুল হাকিম

০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:৪৬ এএম

  • ২৫ বছরে বাড়িভাড়া বেড়েছে ৪০০%
  • শহরে ১৭.৯৯%, সিটিতে ৭২% ভাড়াটিয়া
  • নিজ বাড়িতে বসবাস করেন মাত্র ২৫%
  • আয়ের বড় অংশ চলে যাচ্ছে ভাড়ায়

ঢাকার মতো বড় শহরগুলোতে ভাড়া বাড়ির চাপ ক্রমেই বাড়ছে। পরিসংখ্যান বলছে, গত ২৫ বছরে দেশের বাড়িভাড়া গড়ে ৪০০ শতাংশ বেড়েছে। ভাড়া বাড়ার সঙ্গে আয়ের অনুপাত মিলিয়ে দেখা যায়, রাজধানীর বেশির ভাগ ভাড়াটিয়া তাদের আয়ের বড় অংশ খরচ করছেন বাসা ভাড়ায়। দুই সিটি করপোরেশনের ২৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের ৩০ শতাংশ, ৫৭ শতাংশ আয়ের ৫০ শতাংশ আর ১২ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের ৭৫ শতাংশ ভাড়ার পেছনে খরচ করছেন।

হাইকোর্টের নির্দেশনায় বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন কার্যকরের দাবি দীর্ঘদিন ধরে উঠছে। ভাড়াটিয়া ঐক্য পরিষদসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এ বিষয়ে আন্দোলন চালাচ্ছে। তারা কমিশন গঠনের মাধ্যমে আইন বাস্তবায়ন, সমস্ত ভাড়াটিয়াকে লিখিত চুক্তিপত্র প্রদানের বাধ্যবাধকতা, এলাকাভিত্তিক সরকারি নির্ধারিত ভাড়া কার্যকর করা এবং ভাড়া টাকার রশিদ ও ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ নিশ্চিতের দাবি জানাচ্ছে। সংগঠনগুলো বলছে, এসব পদক্ষেপের অভাবে ভাড়াটিয়ারা অযৌক্তিক ভাড়া বৃদ্ধির শিকার হচ্ছেন এবং নিজের আয়ের বড় অংশ ভাড়া দিয়ে অতিরিক্ত চাপের মধ্যে থাকছেন। দেশের নগরায়ণ ও বেড়ে চলা বাসা ভাড়া পরিস্থিতিতে ভাড়াটিয়াদের অধিকার সুরক্ষায় আইন প্রয়োগ ও সরকারি তদারকি এখন সময়ের দাবি। সামাজিক সংগঠনগুলো বিশ্বাস করে, লিখিত চুক্তি, স্বচ্ছ ভাড়া নীতি ও রশিদনির্ভর ব্যবস্থা নিশ্চিত হলে ভাড়াটিয়া ও বাড়িওয়ালার মধ্যে আস্থা বাড়বে এবং বাসাভাড়া একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আসবে।

ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২৫ বছরে রাজধানীতে বাসা ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪০০ শতাংশ। একই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম যতটা বেড়েছে, সেই তুলনায় বাসা ভাড়া বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।

সংগঠনটির অন্য এক পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকার ২৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ, ৫৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া প্রায় ৫০ শতাংশ, ১২ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ ব্যয় করেন বাসা ভাড়া পরিশোধে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খাদ্যনিরাপত্তা পরিসংখ্যান-২০২৩ এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সিটি করপোরেশনগুলোতে বসবাসকারীদের মধ্যে ৭২ শতাংশই ভাড়া বাসায় থাকেন। এসব এলাকায় নিজের বাসায় থাকেন মাত্র ২৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ মানুষ। সিটি করপোরেশনের বাইরে অন্য শহরে বসবাসকারীদের মধ্যে ভাড়ায় থাকেন ১৮ শতাংশ।

বিবিএসের তথ্যও বলছে, দেশে বাসা ভাড়া বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর সময়ে শহরে বাসা ভাড়া বেড়েছে ৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ। দেশের মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাসায় থাকেন। যার মধ্যে গ্রামে ৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ, শহরে ১৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ আর সিটি করপোরেশনে ৭২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। আর দেশে ভাড়া ছাড়াই থাকেন ১ দশমিক ৯৬ শতাংশ মানুষ।

বিভিন্ন পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঢাকায় বর্তমানে আড়াই কোটিরও বেশি মানুষের বসবাস। প্রতি বছর রাজধানীতে ছয় লাখ ১২ হাজার মানুষ নতুন করে যুক্ত হচ্ছে। এক দিনের হিসাবে এক হাজার ৭০০ জন। পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহরগুলোর তালিকায় ঢাকা অন্যতম। কিন্তু আয়তন ও জনসংখ্যার হিসাবে ঢাকা সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরের একটি। এ শহরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৪৩ হাজার ৫০০ মানুষ।

রাজধানীর বনশ্রীর ডি ব্লকের একটি ছোট ফ্ল্যাট। দুই কক্ষের কোণে বসে আছেন মো. সাদেকুল ইসলাম। তার সঙ্গে আছেন স্ত্রী, একমাত্র কন্যা নিশা এবং দুই ছোট ভাই। ডাইনিং স্পেস খুব ছোট, তবু পরিবারের সবাই কোনোমতে মানিয়ে নিয়েছেন। সাদেকুল জানান, পানি সরবরাহ নিয়মিত নেই। রান্নার সময় গ্যাস জ্বলে না ঠিকমতো। বিদ্যুৎ আছে, কিন্তু শান্তি নেই। মাসের ১০ তারিখ এলেই দিতে হয় মালিককে ভাড়া—১৭ হাজার টাকা। অফিস থেকে বেতন না এলে সমস্যা আরও জটিল হয়ে যায়। সাদেকুল বলেন, বেতন ৩০ হাজার, তার দুই-তৃতীয়াংশ ভাড়া। বেতন পাওয়ার আগেই হিসাব করতে হয়। বাচ্চার জন্য আলাদা কিছু রাখার কথা তো দূরের কথা, সংসারের খরচ চালাতেই হিমশিম খাই।

ঢাকার অন্য জায়গার বাসিন্দাদের কথাও একইরকম। পূর্ব রাজাবাজারে নাজমুল হোসেনের তিন বছরের মধ্যে বাসা ভাড়া বেড়ে গেছে ১২ থেকে ১৮ হাজারে। তবু বাসার অবস্থা আগের মতো। বারান্দা ভাঙা, পানির লাইন নষ্ট। মালিক? শুনছেন না। আমরা শুধু ভাড়া দিয়ে জীবন চালাই।

ভাটারায় টিনের ছাউনির রুমে থাকা গার্মেন্টসকর্মী সুমি আক্তার বলেন, গরমে নিঃশ্বাস নেওয়াও কষ্ট। তবু অন্য জায়গায় ভাড়া অনেক বেশি, তাই এখানে থাকতে বাধ্য হচ্ছি। অনেক সময় মনে হয়, এই শহরে থাকার মানেই লড়াই। ৮-১০ হাজার টাকায় ভালো বাসা পাওয়া সম্ভব নয়। আর যেখানে মেলে, সেখানে সার্ভিস ঠিক থাকে না। বাসা খুঁজে পাওয়া আর খরচ যোগাড় করা—দুটি কাজই তাদের জন্য যুদ্ধের মতো। এছাড়া ঢাকার বাড়ির মালিকরা এখন দুই মাসের অগ্রিম ভাড়া নেন। বাসা ছেড়ে দিতে হলে দুই মাস আগে জানাতে হয়। নতুন বাসায় স্থানান্তর করতে হলে অতিরিক্ত ৫-১০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়।

মুগদার বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম বলেন, আমরা যারা কম বেতনে চাকরি করি, মাসের প্রথম দশ দিন সবচেয়ে কঠিন। ভাড়া দিতে গিয়ে কষ্ট হয়। যেভাবেই হোক টাকা যোগাড় করি। অনেক সময় নোটিশ ছাড়াই ভাড়া বাড়িয়ে দেন মালিকরা। আমাদের কিছু করার থাকে না।

বাংলাদেশ মেস সংঘের মহাসচিব মো. আয়াতুল্লাহ আকতার ঢাকা মেইলকে বলেন, ঢাকার ভাড়াটিয়ারা প্রতি নতুন বছর বাসা ভাড়া নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েন। তাদের আয়ের সিংহভাগ বাসা ভাড়ায় চলে যায়। অযৌক্তিকভাবে কোনো অবস্থায়ই বাড়ি ভাড়া বাড়ানো যাবে না। বাড়ি ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে নির্দেশনা প্রতিপালন করতে হবে।

বাসা ভাড়া নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসির উদ্যোগ

বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১-এর আওতায় ভাড়া বৃদ্ধিতে স্বচ্ছ নীতি নিশ্চিত ও বাড়িওয়ালার পক্ষ থেকে আগাম লিখিত নোটিশ প্রদানের বাধ্যবাধকতা কার্যকরের উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। এতে ভাড়াটিয়া অযৌক্তিক চাপ থেকে সুরক্ষিত এবং বাড়িওয়ালা আইন অনুযায়ী ভাড়া বাড়াতে পারবেন বলে মনে করা হচ্ছে।

ডিএনসিসি সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি বাড়িওয়ালা, ভাড়াটিয়া ও অন্যান্য অংশীজনে নগর ভবনে একটি বৈঠক হয়; সেখানে বেশি কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে। বৈঠকে ভাড়া বৃদ্ধির স্বচ্ছতা, লিখিত চুক্তি, নোটিশ প্রদানের নিয়ম, উভয় পক্ষের অধিকার ও দায়িত্ব এবং ডিএনসিসির সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।

ডিএনসিসি বলছে, ভাড়াটিয়ার অধিকারসমূহের মধ্যে রয়েছে লিখিত চুক্তি, অযৌক্তিক ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে সুরক্ষা, মৌলিক সুযোগ-সুবিধা যেমন পানি, বিদ্যুৎ, স্যানিটেশন ও নিরাপত্তা বজায় রাখা এবং নিরাপদ জামানত নীতি অনুসরণের অধিকার। বাড়িওয়ালার অধিকার হলো নির্ধারিত সময়ে ভাড়া গ্রহণ, সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ, চুক্তি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া এবং চুক্তি মেয়াদ শেষে বাড়ি পুনর্নিরীক্ষণ ও অধিগ্রহণ। এগুলো যথাযথভাবে উভয় পক্ষকে পালন করতে হবে।

ডিএনসিসি প্রস্তাব করেছে, ভাড়া রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম চালু, স্ট্যান্ডার্ড চুক্তি ফরম প্রণয়ন, অভিযোগ সেল ও মধ্যস্থতা বোর্ড স্থাপন, বার্ষিক নির্দেশিকা প্রকাশ, আইনগত সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষা ও কর্মশালা পরিচালনা এবং স্থানীয় বিরোধ নিষ্পত্তি বোর্ড কার্যকর করতে হবে। এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হলে ভাড়াটিয়া ও বাড়িওয়ালার আস্থা বাড়বে এবং ঢাকার ভাড়াবাজার আরও স্বচ্ছ, ন্যায্য ও সুশৃঙ্খল হবে বলে আশা করছে ডিএনসিসি।

ডিএনসিসির আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা (উপ সচিব) জিয়াউর রহমান বলেন, দেশে বাড়ি ভাড়াসংক্রান্ত মূল আইন হলো ‘বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১’। আইন অনুযায়ী বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ার অধিকার, দায়িত্ব ও সীমাবদ্ধতা নির্ধারিত। ধারাগুলো সঠিকভাবে প্রয়োগ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে বিরোধ কমবে এবং অধিকার সুরক্ষিত থাকবে।

এই কর্মকর্তা বলেন, আইনের ধারা অনুযায়ী ভাড়া নিয়ন্ত্রণ ও চুক্তি বিষয়ক নিয়মাবলি রয়েছে। ধারা ২(ক), ৩ ও ১৫ অনুযায়ী নিয়ন্ত্রক বাড়ি-মালিক ও ভাড়াটিয়ার আবেদনের ভিত্তিতে মানসম্মত ভাড়া নির্ধারণ, অনুমতি ছাড়া ভাড়া বৃদ্ধি রোধ এবং অতিরিক্ত প্রিমিয়াম বা সালামি দাবির ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন। ধারা ৭ অনুযায়ী চুক্তি সম্পূর্ণ হওয়া বা নিয়ন্ত্রকের অনুমতি ছাড়া ভাড়া বৃদ্ধি করা যাবে না। ধারা ১৫ অনুযায়ী বাড়ির বাজার মূল্যের বার্ষিক সর্বোচ্চ ১৫% পর্যন্ত মানসম্মত ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। ধারা ১৮, ১৯ ও ২১ অনুযায়ী ভাড়াটিয়াকে অবৈধ উচ্ছেদ থেকে সুরক্ষা, মেরামত ও পরিষেবা নিশ্চিতকরণ এবং ভাড়া জমার ক্ষেত্রে আইনগত প্রক্রিয়া মেনে চলার সুযোগ রয়েছে।

দক্ষিণ সিটিতে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে কোনো উদ্যোগ নেই

ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) গঠিত ৭৫টি ওয়ার্ডে প্রায় এক কোটি ২৫ লাখ মানুষ বসবাস করছে। কিন্তু দক্ষিণ সিটির বাসিন্দাদের জন্য বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে কোনো স্বতন্ত্র কর্মসূচি বা নীতিমালা চালু করা হয়নি। ডিএনসিসির মতো ভাড়া নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বা পদক্ষেপ এখানে দেখা যায়নি।

ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ডিএসসিসি এই মুহূর্তে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তবে যদি বাড়ির মালিক বা ভাড়াটিয়া কোনো সমস্যা নিয়ে করপোরেশনে যান, তখন আমরা তাদের অভিযোগ শুনে সমাধানের চেষ্টা করি।

এই কর্মকর্তা বলেন, ভাড়াসংক্রান্ত বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে করপোরেশন সরাসরি নীতি প্রণয়ন না করলেও প্রয়োজনে প্রশাসনিক মাধ্যমে মধ্যস্থতা বা সহায়তা প্রদান করা হয়। তবে এই পদ্ধতি সীমিত এবং দীর্ঘমেয়াদে ভাড়াটিয়ার অধিকার রক্ষায় কার্যকর বলে মনে হয় না।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দক্ষিণ সিটির বাসিন্দাদের জন্য ডিএসসিসির কোনো নিয়মিত ভাড়া নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না থাকায় ভাড়ার বাজারে স্বচ্ছতা নেই। এর ফলে অল্প আয়ের পরিবারগুলো অতিরিক্ত চাপের মধ্যে থাকেন এবং বাড়ি পরিবর্তনের সময় তাদের বড় অর্থনৈতিক চাপের মুখে পড়তে হয়।

এএইচ/জেবি