মোস্তফা ইমরুল কায়েস
২৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:১৯ পিএম
দীর্ঘদিন সৌদি আরবে ছিলেন আমিনুর রহমান। তিন বছর আগে দেশে ফেরার পর পাশের মসজিদের ইমাম আব্দুস সামাদ আজাদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। আলাপচারিতার একপর্যায়ে আজাদ আমিনুরকে জানান, তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অফিস সহকারী পদে চাকরি দিতে পারবেন। এজন্য লাগবে ছয় লাখ টাকা। প্রথমে দুই লাখ, চাকরি হলে বাকি চার লাখ দিতে হবে।
চাকরির আশায় প্রলোভনে পড়েন আমিনুর। বিশ্বাস করে দুই লাখ টাকা দেন আজাদকে। কিন্তু চাকরি আর হয়নি। পরবর্তীতে চাপ দিলে এক লাখ টাকা ফেরত পান, বাকিটা আর মেলেনি। এরপর থেকে আজাদ এলাকা ছেড়ে গা ঢাকা দেন। এখন মাঝে মাঝে ফোনে যোগাযোগ হলেও টাকা চাওয়ায় উল্টো আমিনুরকে হত্যার হুমকি দেন তিনি।
জানা গেছে, প্রতারক আজাদ সাভারের গোকুলনগর মসজিদের ইমামতি করতেন। তার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ সদরের কাজুলিয়া গ্রামে। বাবার নাম আব্দুল আলী। নিজেকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরিচয় দিয়ে তিনি বহু মানুষকে ফাঁদে ফেলেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
আমিনুরের মতোই তার ভাই, দুলাভাই, আত্মীয়স্বজনসহ বিভিন্ন এলাকার প্রায় ৮০ জনের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন আজাদ। কিন্তু কারও চাকরি হয়নি। একপর্যায়ে রাতের আঁধারে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান তিনি।
বিদেশ যাওয়ার স্বপ্নভঙ্গ হয় আমিনুরের!
আমিনুর জানান, চাকরি হতে দেরি হওয়ায় বিদেশে যাওয়ার জন্য একটি এজেন্সিকে ৫ লাখ টাকা দেন আমিনুর। সেজন্য তার মেডিকেল ও ভিসাও সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি হবে এমন ‘গ্যারান্টি’ পাওয়ায় বিদেশ যাওয়া স্থগিত করেন প্রতারক আজাদ। এমন আশ্বাসে আজাদ আর বিদেশ যাননি। ফলে সেখানেও ৫ লাখ টাকা ক্ষতি হয় তার।
আরও পড়ুন: পুলিশের ‘নিষ্ক্রিয়তায়’ বেপরোয়া অপরাধীরা
আমিনুর বলেন, ‘আমার সব শেষ হয়ে গেল। আমি আজাদের কারণে বিদেশও যেতে পারলাম না। চাকরিও হলো না। এক লাখ টাকা এখনো দেয়নি। আমার মতো সে এই এলাকার অন্তত ৮০ জনের কাছ থেকে কোটি টাকার ওপরে নিয়েছে। কিন্তু কাউকে চাকরি দিতে পারে নাই। আমরা তাকে বিশ্বাস করে টাকাগুলা দিছিলাম।’
ভুক্তভোগীরা জানান, ‘প্রতারক আজাদ এখন অবস্থান করছেন গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায়। তাদের কাছে টাকাগুলো নেওয়ার সময় আজাদ জানিয়েছিলেন, তার বাড়ি সাবেক পলাতক প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির কাছে। ফলে তার পক্ষে জাবিতে অফিস সহকারীর চাকরি দেওয়া কোনো ব্যাপারই না। ভুক্তভোগীরাও তাকে সরল মনে বিশ্বাস করে লাখ লাখ টাকা দেন। কিন্তু টাকা নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন প্রতারক আজাদ।’
গরু-জমি বিক্রির টাকা দিয়ে এখন নিঃস্ব
ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার সাদদল গ্রামের রুহুল মৃধা তার ছেলে সিহাব মৃধার জন্য দুই লাখ টাকা দেন। বাকি টাকার জন্য রুহুল মৃধাকে চাপ দেন আজাদ। তাকে প্রলোভন দেখান যে, তার ছেলের চাকরি নিশ্চিত। আরও দুই লাখ টাকা দিলে আগামীকালই নিয়োগপত্র দেওয়া হবে। রুহুল মৃধা বিশ্বাস করে সেই ইমামকে টাকা দিতে গরু বিক্রি করেন। আজাদকে এই দুই লাখ টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে দেন। যার পুরো ডকুমেন্টস তার কাছে রয়েছে বলে জানান তিনি।
জমানো টাকা দিয়ে পথে বসেছেন কেউ
সেনাবাহিনীর সাবেক ওয়ারেন্ট অফিসার শাহজাহান হাওলাদার তার ছেলে রাজুকে জাবিতে চাকরি দেওয়াও কথা শুনে আজাদকে ৬ লাখ টাকা দেন। কিন্তু চাকরি হওয়া তো দূরের কথা, টাকাও আর ফেরত পাননি তিনি। এই পুরো টাকাটা ছিল তার চাকরির জমানো টাকা। শাহজাহান এখন মহাবিপদে পড়েছেন।
ডিপিএস ভেঙে টাকা দিয়েছিলেন সাবেক সার্জেন্ট সেলিম খাঁ
ঝালকাঠির নলছিটির সাবেক সেনাসদস্য সার্জেন্ট সেলিম খাঁ চাকরি জীবনে ডিপিএস করে চার লাখ টাকা জমিয়েছিলেন। ছেলের নয়ন খাঁ’র চাকরি বাবদ তিনিও সেই প্রতারককে সরল বিশ্বাসে চার লাখ টাকা দেন। সেই সেলিম খান টাকা দিয়ে এখন পথে বসেছেন। টাকাও তুলতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে গত বছর সেলিম খাঁ আশুলিয়া থানায় একটি জিডি করেন। কিন্তু সেই জিডিতে আর কোনো কাজ হয়নি।
জানা গেছে, সাবেক সেনা সার্জেন্ট সেলিম খাঁ ও সাবেক ওয়ারেন্ট অফিসার শাহজাহান হাওলাদার তারা ভুক্তভোগী আমিনুরের দুলাভাই ও বিয়াই। তার সূত্র ধরে তাদের সঙ্গে কথা হলে তাদেরও প্রলোভনে ফেলে টাকা হাতিয়ে নেন তিনি।
ডিবি সদস্য, জাবি শিক্ষক ও ইমামও প্রতারণার শিকার
ভুক্তভোগী কয়েকজন জানান, প্রতারক আজাদ সাবেক একজন ডিবি সদস্যের কাছ থেকে আট লাখ, জাবি শিক্ষকের কাছ থেকে ৯ লাখ এবং একটি মসজিদের ইমামের কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। তাদেরও সন্তানদের চাকরি দেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন তিনি। তারাও বিশ্বাস করে আজাদকে টাকা দেন।
আরও পড়ুন: থেমে নেই অনলাইন জুয়ার রমরমা কারবার
প্রতারণার টাকায় জমি-দোকান-ফ্ল্যাট!
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আজাদ ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে জমি ছাড়াও কয়েকটি মার্কেটে দোকান ও প্লট কেনেন। ভুক্তভোগীরা টাকার জন্য চাপ দিলে সব কিছু কৌশলে বিক্রি করে এলাকা ছেড়ে চলে যান।
টাকা চাইলে উল্টো দেন হুমকি!
প্রবাসী আমিনুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা যারা তার কাছে টাকা পয়সা পাই তারা বিভিন্নভাবে তার ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তিনি টাকা না দিয়ে উল্টো গোপালগঞ্জে গেলে বেঁধে রেখে হত্যার হুমকি দেন। হুমকি পেয়ে তিনি আশুলিয়া থানায় সাধারণ ডায়েরি করবেন বলে জানিয়েছেন।
আমিনুর রহমান আরও বলেন, ‘আমরা যে তাকে টাকা পয়সা দিয়েছি তার সব ভিডিও ফুটেজ রেখেছি। ডকুমেন্টস ও স্ট্যাম্পও আছে। কিন্তু এখন আমরা টাকা তুলতে পারছি না।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আজাদ ওই এলাকায় অন্তত ৮০ জনের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। চাকরি দিতে না পারলেও কাউকেই টাকা ফেরত দেননি।
আরও পড়ুন: কাটছে না বিমানের শনির দশা!
জাবির জাল নিয়োগপত্র তৈরি করে প্রতারণা
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আজাদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাডের আদলে একটি চিঠি তৈরি করতেন। সেই চিঠি ধরিয়ে দিতেন ভুক্তভোগীদের হাতে। তেমনি একটি চিঠি এসেছে ঢাকা মেইলের হাতে। সেটিতে দেখা গেছে, চিঠিটি ২০২৩ সালের ২৮ নভেম্বরের। তাতে স্পষ্ট জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো, বিষয় হিসেবে প্রকৌশল অফিসে অফিস সহায়ক পদে নিয়োগের জন্য নির্বাচনী পরীক্ষা সংক্রান্ত। সবার নিচে লেখা এবিএম আজিজুল ইসলামের নাম ও তার স্বাক্ষর। তার পদবি হিসেবে লেখা ডিপুটি রেজিস্ট্রার (প্রশাসন-২)।
ভুক্তভোগী সেলিম খাঁ’র ছেলে নয়ন খাঁ-কে জাবিতে এই চিঠিতে পরীক্ষার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছিল। এরপর নয়ন খাঁকে আজাদ জানিয়েছিলেন, ২০২৪ সালের ১২ জুন তার পরীক্ষা এবং ২৫ জুন তার চাকরিতে যোগদান। কিন্তু পরে তারা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন এটা ভুয়া চিঠি।
এ ঘটনায় সেলিম খাঁ আশুলিয়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। জিডি নং-৩৪০। চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি তিনি অভিযোগ করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেই নামে তখন এমন ব্যক্তি থাকলেও তারা এ বিষয়ে কিছুই জানেন না।
প্রতারণার এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে আব্দুস সামাদ আজাদের মোবাইলে কয়েকবার কল দেওয়া হলেও ফোন না ধরায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এমআইকে/এমআর