# সম্পত্তি চাইতে গেলেই ভাইদের সঙ্গে মনোমালিন্য
# তিন যুগেও কেউ কেউ জমি দখলে নিতে পারেননি
# স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহাযোগিতা না করার অভিযোগ
# আইন থাকলেও বাস্তবে প্রয়োগ নেই
# অনেকে জমি পেলেও বাধ্য হন ভাইদের কাছেই বিক্রি করতে
মানিকগঞ্জের আয়েশা বেগম (ছদ্মনাম)। এক যুগ আগে বাবাকে হারান। বাবার মৃত্যুর পর গ্রাম্য সালিশে পাঁচ বিঘা জমির ভাগ পান। দলিল, পর্চা, খাজনা খারিজ-সব কাগজ হাতে থাকলেও এখনো জমি বুঝে পাননি তিনি। যতবারই জমি নিতে যান, ভাইয়েরা নানা অজুহাতে তাকে ফিরিয়ে দেন। এক যুগ ধরে ভাইদের সঙ্গে এমন মনোমালিন্য চলছে। আদালতের দ্বারস্থ হওয়া সত্ত্বেও এখনও জমির অধিকার পায়নি আয়েশা।
বিজ্ঞাপন
শুধু আয়েশা নন, তার মতো হাজারো নারী বাবার সম্পত্তি পেতে দীর্ঘ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। আইন ও ধর্ম তাদের অধিকার নিশ্চিত করলেও বাস্তবে চিত্র ভিন্ন। ভাইদের অনিচ্ছা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তা না পাওয়া এবং সামাজিক রীতিনীতির কারণে অনেক নারী জমি বুঝে নিতে পারছেন না।
ঢাকা মেইলের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে প্রায় এক মাস ধরে ২৫ জন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, বাবার মৃত্যুর পর গ্রাম্য সালিশে জমি পান তারা। পর্চা, খাজনা খারিজ ও দলিলও তারা বুঝে পেয়েছেন। তবু আপন ভাইয়েরা জমি বুঝে দিচ্ছেন না-যা তাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, জমি উদ্ধারে প্রশাসনের দ্বারস্থ হলেও অনেকে কোনো সহায়তা পাননি। বরং জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা উল্টো হয়রানির শিকার হয়েছেন। এতে ভাইদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আরও খারাপের দিকে গেছে।

বিজ্ঞাপন
সম্পত্তি চাইলে মনোমালিন্য বাধে
আয়েশা আক্তারের একমাত্র ছেলে রুবেল ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘মামারা আমাদের জমি দিতে চায় না। অথচ আমার মা পাঁচ বিঘা জমি পাবে। কিন্তু আইনে থাকলেও আমরা নিতে পারছি না। প্রতি বছর জমি চাইতে গেলেই মনোমালিন্য শুরু হয়।’
২৫ বছরেও জমির দখল পাননি নাজমা আক্তার
যশোরের কলারোয়া উপজেলার কেরালকাথা ৯ নং ইউনিয়নের নাজমা আক্তারের গল্পও একই রকম। ছয় বোন ও তিন ভাই তারা। বাবার মৃত্যুর পর বোনেরা তিন বিঘা জমি পান। যদিও তাদের বাড়ি ভিটা মিলে জমির পরিমাণ ছিল ১৮ বিঘা। কিন্তু তাদের ভাইয়েরা বাকি সম্পত্তি বিক্রি করে দেন। শুধুমাত্র ৯ বিঘা জমি ভাগ বণ্টন হয়। দলিল, পর্চা, খাজনা খারিজ-সবই আছে। তবু ২৫ বছর ধরে জমির দখল নিতে পারেননি। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা ভূমি কর্মকর্তার দ্বারস্থ হয়েও সমাধান হয়নি। শেষমেষ বণ্টননামার মামলা করার সিদ্ধান্ত নেন তারা। কিন্তু সেই মামলাতেও তারা জমির দখল বুঝে পাবেন কিনা তা নিয়েও সন্দেহে আছেন।
দেড় যুগ আগে স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয় নাজমা আক্তারের। এখন সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় থাকেন। কাজ করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। চাকরি করেই সংসার চলে তার। স্বপ্ন ছিল বাবার সম্পত্তি পেলে হয়তো তার জীবনের কিছুটা গতি আসতো। মেয়েকে বড় করে বিয়ে দিতেন জমি বিক্রির টাকায়। কিন্তু সেই স্বপ্ন আলোর মুখ দেখবে কি না তা নিয়ে চিন্তিত নাজমা।
>> আরও পড়তে পারেন
ঢাকা মেইলকে নাজমা আক্তার বলেন, ‘২৫টা বছর ধরে ঘুরতেছি। গ্রাম্য সালিশ, বিচার, ইউএনও সবার কাছে গিয়েছি কিন্তু কেউ সমাধান দিতে পারেনি। ভাইয়েরা বসবে বলে তারিখ দেয়, কিন্তু দেখা যায়, ওই দিন তারা বাড়ি থেকে উধাও। ২০২২-২৩ সালে স্থানীয় ইউএনওকে ধরলাম। তিনি স্থানীয় চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব দিলেন। ছুটি নিয়ে ১২ দিন গ্রামে ছিলাম কিন্তু চেয়ারম্যান আমাকে দেখা দেয়নি। এমনকি বিষয়টি সমাধান করে দেবেন কিনা সে বিষয়েও কিছু বলেনি। আমি এখন হতাশ।’
নাজমা আরও বলেন, ‘আমার বাকি পাঁচ বোন তাদের শ্বশুরবাড়িতে থাকে। এক বোন মারা গেছেন। আমরা সবাই একসঙ্গে যেতেও পারি না। অনেকে পরামর্শ দিয়েছে বণ্টননামার কেস করার। কিন্তু সেটাও তো দীর্ঘ প্রসেস। কতটুকু হবে তাও সন্দেহ। আমাদের নামে রেকর্ড দলিল সব। কিন্তু ভাইয়েরা দখল দেয় না।’

আইন থাকলেও কার্যকর নয়
দিনাজপুরের রুবিনা আক্তারের তিন বোন ও চার ভাই। অন্য দুই বোনের আর্থিক অবস্থা ভালো হওয়ায় তারা জমির ভাগ চান না। কিন্তু রুবিনার সংসারিক অবস্থা ভালো না হওয়ার ভাইদের কাছে জমি চান। এ নিয়ে ভাইদের সঙ্গে তার তিন যুগ ধরে মনোমালিন্য চলছে।
রুবিনার ছোট ছেলে সামাদ বলেন, ‘মামাকে বলেছি জমির ভাগ না দিলে প্রয়োজনে আদালতের দারস্ত হব।’
এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে ১৯৭০ সালের আগে মারা যান দিনাজপুরের পার্বতীপুরের মমতাজ বেগম। সন্তানরা বড় হলেও মামারা তাদের জমি বুঝে দিচ্ছেন না। তার পাঁচ বিঘা জমি এখনও ভাইয়েরা দখলে রেখেছেন।
মমতাজের ছেলে জিয়াউর রহমান বলেন, “আইন থাকলেও মামারা আমাদের জমি দেয়নি। বলে তোরা তো আইনে পাবি না। আমরা এতিমের মতো মানুষ হয়েছি।”
জমি পেলেও কম দামে বিক্রির চাপ
শেরপুরের রহিমা বেগম দুই বিঘা জমি ভাগে পেলেও ভাইদের চাপে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন।
রহিমা বলেন, ‘এমন একটা অবস্থা তৈরি হয়েছিল ভাইদের কাছে জমি বিক্রি না করলে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। তারা মনঃক্ষুণ্ন হতো। উপায় না পেয়ে কম দামে ভাইদের কাছে জমি বিক্রি করতে বাধ্য হই।’
একই অবস্থা দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার উম্মে কুলসুমেরও (ছদ্মনাম)। ২০১২ সালে বাবার জমির প্রায় দুই বিঘা ভাগ পেলেও জমি নিতে পারেননি। জমি চাইতে গেলে ভাইয়েরা বলে, ‘তোকে তো আমরা অনেক কিছু দিয়েছি, আবার কেন জমির ভাগ।’
ভাইদের এমন কথা শুনে সম্পর্ক খারাপ হবে ভেবে আর জমি চাওয়ার সাহস পাননি তিনি। তবে ছোট ভাই তার জমির অর্ধেক অংশ নিয়ে তা বাবদ হাজার ৩০ টাকা দিয়েছিলেন।
>> আরও পড়তে পারেন
দুই মাসে পাঁচ শতাধিক গুজব ছড়িয়ে মব তৈরির চেষ্টা
পুলিশের ‘নিষ্ক্রিয়তায়’ বেপরোয়া অপরাধীরা
ঢাকা মেইলকে উম্মে কুলসুম বলেন, ‘ভাইয়েরা হলো বাবার সন্তান। তারা রক্ত। তাদের তো জোর করা যায় না। জমি পাইছিলাম কিন্তু ভাইদের কথায় আর নেইনি।’
সম্প্রতি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার ফেসবুক পেজে একটি ভিডিও শেয়ার করা হয়। সেখানে বাবার সম্পদ পেলেও ভাইয়েরা সম্পদ দিচ্ছেন না বলে এক নারী অভিযোগ করেন। ভাইয়েরা তাদের কাছে জমি বিক্রি করতে বলছে। বাজার দর অনুযায়ী ওই জমির দাম ৩০ লাখ টাকা হলেও ভাইয়েরা তাকে দিতে চায় মাত্র ৬ লাখ টাকা।
জমি পেতে স্থানীয় মেম্বার ও জনপ্রতিনিধিদের বহুবার ডাকলেও কাজ হয়নি। পরে বাধ্য হয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে যান।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে কটিয়াদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মায়েদুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সম্প্রতি এমন এক নারী এসেছিলেন। তার ভাইয়েরা তাকে জমি দিতে চায় না। ভাইয়েরা জমি কিনে নিতে চাইলেও বাজারদর দিতে চাচ্ছেন না। বিষয়টির সমাধান চেয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। প্রতি বুধবার এ বিষয়ে শুনানি হয়। শুনানিতে উভয় পক্ষ থেকে বিষয়টি শোনা হয় তারপর আমরা সমাধান দেই। সেখানে উভয়পক্ষকে আগামী বুধবার ডাকা হয়েছে।’
ইউএনও মায়েদুল ইসলাম আরও বলেন, ‘এমন অভিযোগ প্রায়ই আসে। এমন অভিযোগের সংখ্যা অনেক। তবে আমরা এসব বিষয়ে আগে অভিযোগ নেই। পরে শুনানিতে আমরা সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করি।’

জাতীয় জরুরি নাম্বার ৯৯৯ এ অসংখ্যা কল আসে
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে প্রায়ই জমি সংক্রান্ত মারামারি বা জমি দখলে নিতে না পারার সাহায্য চেয়ে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এ কল আসে। যদিও এসব কলকে তারা মারামারি অপশনে সরাসরি যুক্ত করে। আদালাভাবে পুলিশ এগুলোকে হিসেবে ধরে না।
জাতীয় জরুরি সেবা-৯৯৯ এর পরিদর্শক আনোয়ার সাত্তার ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের কাছে প্রতিদিনই জমি সংক্রান্ত মারামারির ঘটনাগুলোতে পুলিশি সাহায্য চেয়ে কল আসে। তবে কোনটিতে বোনেরা ভাইদের কাছ থেকে জমি পাচ্ছে না বা দখলে নিতে পারছে না এমন কল এলেও সেগুলো সেই বিষয় উল্লেখ করে নথিভুক্ত হয় না, সেগুলোকে মারামারির কল হিসেবেই আমরা হিসেবে রাখি।’
মুসলিম আইন কী বলে?
মুসলিম আইনে বাবা মারা গেলে ছেলেমেয়ে উভয় থাকলে, ছেলেরা যত সম্পত্তি পাবে, মেয়েরা তার অর্ধেক পাবে। অর্থাৎ ভাইয়েরা চাইলে বোনদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে পারবে না। আর যদি মৃত ব্যক্তির ছেলে না থাকে এবং এক বা একাধিক মেয়ে থাকে, তবে তারা মোট সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ পাবে।
>> আরও পড়তে পারেন
গাড়িচালকের ছেলে যেভাবে আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী
কনস্টেবল হত্যায় দুই লাখে খুনিদের ভাড়া, অংশ নেন স্ত্রীও
মেয়েরা বাবার সম্পত্তি পেতে আইনি জটিলতাটি কোথায়?
দিনাজপুরের পার্বতীপুরের মমতাজ বেগম। সত্তরের দশকের আগে মারা যান। পাঁচ বছরের কন্যা ও দেড় বছরের ছেলেকে রেখে বিরল রোগে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর সেই ছেলে মেয়েরা সাবালক হলে মামাদের কাছে মায়ের জমির ভাগ চাইতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই মামারা কোন ভাগ দেয়নি। মানবিক সহানুভূতিতেও নয়। উল্টো তাদের মায়ের পাঁচ বিঘা জমি তিন ভাই মিলে ভোগ দখল করে খাচ্ছেন।
তার একমাত্র ছেলে জিয়াউর রহমান বলেন, মা তার বাবার সম্পত্তি পাবেন কিন্তু তিনি ১৯৭০ এর আগে মারা যাওয়ায় আমরা কোন ভাগ পাইনি। দুই ভাই বোন এতিমের মতো মানুষ হয়েছি। মামারা আজো কোন ভাগ দেয়নি। বলে তোরা তো আইনে পাবি না।
শুধু মমতাজ নয়, তার মতো অনেক নারীর সন্তানরা আজও বঞ্চিত। মেয়েরা যাবে বাবার সম্পত্তির ভাগ পান সেজন্য বাংলাদেশের প্রচলিত আইনও রয়েছে। কিন্তু সেই আইন থাকলেও বাস্তবে মেয়েরা ও তাদের অবর্তমানে সন্তানরা মামাদের কাছ থেকে কোনো সম্পত্তি পাননি। বিষয়টি যেনো সমাজে পান্তাভাত।
শেরপুরের রহিমা বেগম তার বাবার সম্পত্তি থেকে দুই বিঘা জমি ভাগে পেয়েছিলেন। কিন্তু ভাইদের আপত্তির মুখে সেই জমি তাদের কাছে কম দরে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন তিনি। তার মতে, এমন একটা অবস্থা দাঁড়িয়েছিল যদি তাদের কাছে জমি বিক্রি না করতাম তাহলে ভাইদের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। তারা মনোক্ষুন্ন হয়ে বসে থাকতো।
তিন যুগ আদালতের বারান্দায় কেটেছে উম্মে নাহারের তারপর...
তিন যুগ আগে বাবার সম্পত্তি ভাগ বন্টন হলে তা থেকে কয়েক বিঘা জমি পান উম্মে নাহার (ছদ্মনাম)। ঢাকার একটি জেলায় বাড়ী হলেও ঢাকাতেই থাকেন তার পরিবার। সম্পত্তি পেলেও নাহার সেই জমি নিতে পারেননি। তিন যুগ আদালতের বারান্দায় ঘুরেছেন। কিন্তু তার জমি কেমন তা দেখার আগেই মারা যান তিনি। বছর খানেক আগে মৃত্যু হলে এখন লড়ছেন ছেলেরা। তারা সম্পত্তি পাবেন আশা রাখেন তাদের আইনজীবী তানভীর আহমেদ। তিনি ঢাকা মেইলকে বলছিলেন, তিনি তিন যুগ লড়েছেন এখন তার সন্তানরা লড়ছে। সম্পত্তি তিনি পাবেন এতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু সমস্যা হলো এসব মামলায় দীর্ঘ সময় লাগে রায় পেতে। অনেকে পাচ্ছেন কিন্তু ততোদিন অনেকে বেঁচেই থাকেন না। পরে তাদের সন্তানরা লড়েন।
অনেক ভাই বোনকে সম্পত্তি দেন এমন নজিরও কম নয়
বিষয়টি নিয়ে যতোজনের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে তাদের অধিকাংশ জানিয়েছেন, এখন কোনো ভাইয়েরা আর সম্পত্তি নিতে চায় না। কিন্তু এমন নজির মিলেছে ভাইয়েরা তাদের বোনের সম্পত্তি দিয়েছেন।
এমনই ছয় বোনের সন্ধান মিলেছে নাটোর জেলায়। তারা ১৭ ভাই বোন। বাবা-মারা যাওয়ার আগে সম্পত্তি ভাগ বন্টন করে দিতে পারেননি। কিন্তু বিষয়টি তার মৃত্যুতে জটিল হয়নি। বাবার মৃত্যুর পর ১১ ভাই ৬ বোনকে ডেকে ইসলামী শরীয়া ও দেশের আইন অনুযায়ী জমি ভাগ করে তাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন। যা এক অনন্য নজির।
বাবার জমির ভাগ পাওয়া সেই ছয় নারীর ভাতিজা রিয়াদ ঢাকা মেইলকে বলেন, আমার ফুপুদের বাবা নিজে ডেকে সম্পত্তি বুঝে দেন। যদিও দাদা ভাগ করে দিয়ে যেতে পারেননি। ফুপুরা জমি পেয়ে মহাখুশি। তারা বেশির ভাগ জমি অন্যের কাছে বিক্রিও করেছেন। এতে বাবা চাচারা কোন বাধা বা আপত্তি তোলেনি। আর এমন ঘটনা ঘটে নব্বইয়ের দশকে।
তবে বিপরীত গল্পও শোনা গেল তার মুখে এই সময়ে এসে। তিনি আরও জানালেন, তার মামারা আজও তার মা ও খালাদের বাবার জমির ভাগ দেননি। আবার কিছু জমি দেওয়া হয়েছে দাবি করলে সেই জমি কোন দাগে তা বুঝে দেয়নি। ফলে তারা জমি দখলে নিতে পারছেন না।
যা বলছেন আইনজীবী ও আলেমরা
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানভীর আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বাংলাদেশে যে আইন আছে তাতেই নারীরা তাদের সম্পত্তির ভাগ পেতে পারে। কিন্তু মামলার করলে দীর্ঘদিন ধরে চলে সেই মামলা। রায় হতে হতে অনেকে মারা যান। একসময় ছেলেমেয়েরা আশা ছেড়ে দেন। বাটোয়ারা মামলা করলে একজন ভুক্তভোগী আইনি বিচার পেতে পারেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘মামলার সংখ্যা বাড়তে থাকায় জটের কারণে দীর্ঘসূত্রিতা তৈরি হওয়ায় ভুক্তভোগীদের বিচার পেতেও দীর্ঘ সময় লাগছে। বিষয়টি সমাধানে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল করে মামলাগুলো দ্রুত শেষ করা যেতে পারে।’
অনেক আইনজীবীর মতে, শুধু ভাগবাটোয়ারার মামলা দিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। প্রকৃত সমাধান আসে সমাজের মানুষের সচেতনতা ও ন্যায্য বোধ জাগ্রত হলে। বিশেষ করে ভাইদের দায়িত্ব প্রথমে সচেতন হওয়া, যাতে বোনরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়। যতক্ষণ ভাইদের মধ্যে এই বোধশক্তি তৈরি হবে না, ততক্ষণ আইনও একা সমস্যা সমাধান করতে পারবে না। এছাড়া, দীর্ঘসূত্রিক মামলার কারণে ভুক্তভোগীরা প্রায়ই হয়রানি ভোগ করেন এবং সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন।
মোহাম্মদপুর জামিয়া রহমানিয়া মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা কামরুল হাসান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এ বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী খুবই পরিষ্কার। এখানে নারীকে তার ভাগ দিতেই হবে এটি স্পষ্ট করেই বলে হয়েছে। ইসলাম বলেছে, নারী যা অংশ পাবে তার দ্বিগুণ পাবে ভাই। নারী পাওয়াটাই এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নারীর এই ভাগ বা অংশ যদি কেউ না দেন, তবে তিনি খেয়ানতকারী হিসেবে গণ্য হবেন। অন্যের সম্পদ আত্মসাৎকারী হিসেবেই গণ্য হবে। হাশরের ময়দানে যে বোন বা যাকে তার সম্পদ দিলো না সেই পাওনাদারকে তার আমলনামা তাকে দিয়ে তারপর পরিত্রাণ পেতে হবে। এছাড়া তার পরিত্রাণ পাওয়ার আর কোন রাস্তা নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘কারও কাছে ১০ হাজার টাকা ধার নিয়ে তা পরিশোধ করা যেমন জরুরি, বোন বা মেয়েদের সম্পত্তির ভাগ তাকে ফিরিয়ে দেওয়াও তেমনি জরুরি। এটা তার হক। তা থেকে কোনোভাবে বঞ্চিত করার সুযোগ নেই। যদি কেউ আত্মাসাৎ করে তবে তিনি নিজে সরাসরি জাহান্নামের আগুন ভক্ষণ করলেন এবং এর জন্য অবশ্যই কেয়ামতের মাঠে তাকে শাস্তিভোগ করতে হবে। এই ধারণাটা যদি সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া যায় এবং মানুষ যদি এটাকে ব্যাপক চর্চার মধ্যে নিয়ে আসে তবে প্রবণতা অনেকাংশে কমে আসবে। এজন্য ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপক প্রচার হওয়া দরকার।’
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এবং নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের অন্যতম সদস্য ফৌজিয়া করিম ফিরোজ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সমাজ ব্যবস্থার জন্য আমরা অবহেলিত হচ্ছি। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। নারীদের অধিকারের বিষয়ে পুরুষরা ভাবেন, আমরা তো আছি তোমাদের আর কি দরকার। এই চিন্তাভাবনাই মেয়েদের অবহেলিত রেখেছে৷ আর এখন দেশের যা অবস্থা, তাতে মেয়েদের কিছুই দিতে চাচ্ছে না। এখনো বিষয়টি আরো প্রকট হচ্ছে। এখন তো আমরা দেখছি, মেয়েদের অধিকার নিয়ে কথা বললে আমাদের নানাভাবে ভুক্তভোগী করা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ নিয়ে আমরা কাজ করছি। উদ্যোগ তো নেওয়া হবে। আইন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আর আইন তো নিজে নিজে হয় না। এজন্য জনগণের সমর্থন থাকতে হবে। সমর্থনটা জোগাড় করার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
এমআইকে/এমআর

