আইন করে নিষিদ্ধের পরও দেশে থেমে নেই জুয়া। আগে এই জুয়া সরাসরি চলত ‘হাউজি’ নামে। এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে অনলাইনে। ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ায় তা এখন মানুষের হাতের নাগালে। ফেসবুক-ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম খুললেই ভেসে আসছে জুয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বিজ্ঞাপন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই দিয়ে বিজ্ঞাপন তৈরি করে জুয়া খেলতে মানুষকে প্রলুব্ধ করা হচ্ছে। পুলিশের সাইবার বিভাগগুলোর নজরদারি ঠেকাতে পারছে না জুয়ার আসক্তি।
অনলাইনে জুয়ার গ্রাহক এখন সব স্তরের মানুষ। সেলুন থেকে হকার, দোকানি, মাছ বিক্রেতা, বাস ও লেগুনার চালক, গৃহকর্মী থেকে বাড়ির কেয়ারটেকার- সবাই এখন জুয়ার গ্রাহক।
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি মোহাম্মদপুরের নুরজাহান রোডে জুয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। পরিচয় প্রকাশ না করে তারা জানান, অনলাইনের পাশাপাশি তারা বাস্তবের জুয়ার সঙ্গেও জড়িত। নানাভাবে তারা জুয়া খেলা অব্যাহত রেখেছেন।
তাদের একজন উদাহরণ দিয়ে বলেন- মনে করেন, কোনো দেশের মধ্যে ক্রিকেট বা ফুটবল খেলা চলছে। সেই খেলায় কোন দেশ জিতবে তা নিয়ে আমরা বাজি ধরি। তিনি জানান, এ ধরনের জুয়া এখন রাজধানীর অলিতে-গলিতে চলছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতনরা বলছেন, তারা অনলাইন স্পেসে জুয়া খেলার বিষয়টি নিয়ে নজরদারি বাড়িয়েছেন। ইতোমধ্যে গত কয়েক মাসে জুয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত হাজারের বেশি মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট বন্ধ করেছে সরকার।
অনলাইন জুয়া বর্তমানে মোবাইল অ্যাপ, ওয়েববসাইট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে পরিচালিত হচ্ছে, যেখানে অংশগ্রহণকারীরা সহজে অর্থ উপার্জনের আশায় জুয়ার আসক্তিতে জড়িয়ে পড়ছে। এর ফলে অনেকেই আর্থিকভাবে দেউলিয়া ও নিঃস্ব হচ্ছে এবং বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড, পারিবারিক সহিংসতা, এমনকি আত্মহত্যার মতো মর্মান্তিক ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।

বিজ্ঞাপন
সাইবার আইন কী বলে?
জানা গেছে, নতুন সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের ২০ ধারা অনুসারে জুয়া খেলা এবং জুয়া খেলার সাথে জড়িত সকল কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ। সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর ধারা ২০ অনুযায়ী অনলাইন জুয়া খেলা, জুয়াসংক্রান্ত অ্যাপ বা পোর্টাল তৈরি ও প্রচারণা চালানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই অপরাধের জন্য ২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, ১ কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড প্রযোজ্য। এছাড়া, ২১ ও ২২ ধারায় জুয়া সংক্রান্ত লেনদেন, প্রতারণা বা জালিয়াতিকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
>> আরও পড়তে পারেন
গত মে মাসে মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জুয়া খেলা নিয়ে উৎসাহ প্রদান বা বিজ্ঞাপনে অংশ নেওয়াও অপরাধ। কোনো নাগরিক, সম্মানিত ব্যক্তি বা তারকা যদি মনে করেন তার অনুমতি ব্যতিরেকে জুয়া খেলার ওয়েবসাইট বা পোর্টালে তার ছবি বা ভিডিও ব্যবহৃত হচ্ছে, তখন তাকে আইনের আশ্রয় নিতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি এই আইন প্রণয়নের আগে যারা জুয়া খেলার সঙ্গে জড়িত বা জুয়া খেলার বিজ্ঞাপনে জড়িত ছিলেন, তাদের দ্রুত এই কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।
জুয়ার কারণে যারা আগে প্রতারণার শিকার এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের জন্য আইনের ৩০ ধারা অনুযায়ী অভিযুক্ত কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করা এবং ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে।
এখন পর্যন্ত এক হাজারেরও বেশি মোবাইল ব্যাংকিং (এমএফএস) এজেন্টকে অনলাইন জুয়ার লেনদেনে জড়িত থাকার প্রমাণসহ শনাক্ত করেছে সিআইডি। এসব এজেন্টের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। লাইসেন্স বাতিল ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করার লক্ষ্যে অপরাধে জড়িত এজেন্টদের তালিকা ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে।
অনলাইন জুয়ার বিরুদ্ধে সরকারের অভিযান অব্যাহত থাকবে উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, অনলাইন জুয়ায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের পাশাপাশি বিভিন্ন পেশাজীবী, বিজ্ঞাপনদাতা কোম্পানি, মিডিয়া বায়ার, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিজ্ঞাপনদাতা এবং বিজ্ঞাপনগ্রহীতা সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সন্দেহভাজন অ্যাপস, ওয়েবসাইট বা মোবাইল নম্বর সম্পর্কে তথ্য জানাতে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারে যোগাযোগের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। হটলাইন নম্বরগুলো হলো- ০১৩২০০১০১৪৬, ০১৩২০০১০১৪৭, ০১৩২০০১০১৪৮।
জানা গেছে, এখন পর্যন্ত এক হাজারেরও বেশি মোবাইল ব্যাংকিং (এমএফএস) এজেন্টকে অনলাইন জুয়ার লেনদেনে জড়িত থাকার প্রমাণসহ শনাক্ত করেছে সিআইডি। এসব এজেন্টের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। লাইসেন্স বাতিল ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করার লক্ষ্যে অপরাধে জড়িত এজেন্টদের তালিকা ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে।

এআই বিজ্ঞাপনে চলছে প্রলোভন
আগে অনলাইন জুয়া খেলার জন্য আকৃষ্ট করতে পেজ বানিয়ে সেই জুয়ার লাভ সম্বলিত একটি তালিকা যাবতীয় তথ্যসহ সামাজিক মাধ্যমে অনেকের কাছে পৌঁছাতে বুস্ট করা হতো। এখনো বুস্ট করা হয়। কিন্তু ভিন্নভাবে এসব খেলায় আকৃষ্ট করা হচ্ছে। এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই দিয়ে বিজ্ঞাপন বানাচ্ছে চক্রের সদস্যরা। এত টাকা বিনিয়োগ করলে এত টাকা লাভ আসবে-এই প্রলোভনে তারা আকৃষ্ট করছে।
জুয়ার টাকা সংগ্রহ করতে না পেরে আত্মহত্যা!
অনেকে এই অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ায় শেষমেষ টাকা সংগ্রহ করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। সম্প্রতি এমন একটি ঘটনা ঘটেছে সাভারের আশুলিয়া এলাকায়। জানা গেছে, গত ১০ আগস্ট সাভারের আশুলিয়ায় ক্যাসিনো এবং জুয়ার ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব হারিয়ে রাব্বি (২৮) নামে এক যুবক আত্মহত্যা করেছেন।
সাভারের নরসিংহপুর মানিকগঞ্জপাড়া কবরস্থান রোড এলাকার মিলন মৃধার বাড়ি থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিহত রাব্বি নীলফামারী জেলার ডিমলা থানার দক্ষিণ বালাপাড়া এলাকার মো. ছবির আলীর ছেলে। তিনি তার স্ত্রীর সাথে ওই বাড়িতে ভাড়া বাসায় থাকতেন বলে জানা যায়।
>> আরও পড়তে পারেন
নিহতের লাশের পাশ থেকে একটি ডায়েরি উদ্ধার করেছে পুলিশ। তাতে লেখা ছিল- অনেক চেষ্টা করেছি, ক্যাসিনো থেকে বাঁচতে পারলাম না। ক্যাসিনোতে জীবন শেষ, ক্যাসিনো ধ্বংস, ক্যাসিনো মৃত্যু, তাই যুব সমাজ সাবধান।’
পুলিশ জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, রাব্বি জুয়া ও মাদকের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এ কারণে কিছু ঋণ হয়েছিল। এজন্য হতাশাগ্রস্ত হয়ে তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
কী বলছে পুলিশ
এ বিষয়ে ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের মুহাম্মদ তালেবুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের সাইবার টিমগুলো কাজ করছে। কেউ যাতে অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে না পড়ে সে ব্যাপারে পুলিশ সতর্ক দৃষ্টি রাখছে। তবে কেউ প্রলোভনে আসক্ত হয়ে নীরবে তাতে জড়িয়ে গেলে তো অনেক সময় পুলিশেরও করার কিছু থাকে না।’
এ বিষয়ে পুলিশের সদর দফতরের মিডিয়া বিভাগের পক্ষ থেকে এআইজি এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন ঢাকা মেইলকে বলেন, অনলাইন জুয়া বর্তমানে শুধু একটি বেআইনি কার্যক্রম নয়, এটি আমাদের সমাজের পরিবার, তরুণ প্রজন্ম এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় হুমকি। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় মোবাইল ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার সুযোগ নিয়ে অনলাইন জুয়া ডিজিটাল আসক্তির রূপ যাতে না নেয় সেজন্য আমরা বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। এজন্য সাইবার মনিটরিং টিম সক্রিয় রয়েছে।
এই কর্মকর্তা বলেন, জুয়ার বিজ্ঞাপন বা প্রলোভন যেসব পেইজ বা অ্যাকাউন্ট থেকে প্রচার করা হয়, সেগুলোর বিরুদ্ধে রিপোর্টিং ও আইনি প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে। অনলাইন জুয়ায় অংশগ্রহণ, প্রচারণা অথবা এজেন্ট হওয়া—তিনটিই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (BTRC) সহযোগিতায় সন্দেহজনক ওয়েবসাইট/অ্যাপ বন্ধে অনুরোধ ও ব্লকিং প্রক্রিয়া চলমান। যদি আপনার এলাকার কেউ অনলাইন জুয়ার সাথে যুক্ত থাকে বা কেউ বিজ্ঞাপন প্রচার করে, দয়া করে নিকটস্থ থানায় অথবা ৯৯৯ নম্বরে যোগাযোগ করুন।
তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আপনাদের একটি তথ্যই অনেক তরুণকে জুয়া থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে।
এমআইকে/জেবি

