মহিউদ্দিন রাব্বানি
১৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৫৯ পিএম
দীর্ঘদিন ধরেই দেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। একদিকে পুরনো কূপগুলোর গ্যাসের মজুদ ফুরিয়ে আসছে অন্যদিকে নতুন কূপ অনুসন্ধানে নেই দৃশ্যমান অগ্রগতি। ফলে দেশের জ্বালানির জোগান দিতে বাড়ছে বিদেশ-নির্ভরতা। এতে দেশের সামগ্রিক জ্বালানি খাত বিপাকে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিগত সময়ে অনুসন্ধানে মনোযোগ না দিয়ে আমদানির প্রতি ঝুঁকে পড়ার কারণেই এই সংকটের সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বৈশ্বিক বাজারে অস্থিতিশীলতা, দেশে ডলার সংকটসহ নানা জটিলতার মধ্যেও উচ্চমূল্যের জ্বালানির আমদানির ধকল সামলাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। আমদানিকৃত গ্যাসের দাম দেশীয় খাত থেকে উৎপাদিত গ্যাসের মূল্যের প্রায় ২০ গুণ দাম বেশি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশীয় উৎস থেকে পাওয়া গ্যাসের গড় মূল্য পড়েছে ৩.৩৯ টাকা। অথচ একই পরিমাণ গ্যাস আমদানিতে খরচ পড়েছে ৬৮.৭১ টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশীয় উৎস থেকে পাওয়া ৭২.২১ শতাংশ গ্যাসের দাম পড়েছে ৬ হাজার ৬২৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। একই সময়ে আমদানিকৃত ২৬.৮৯ শতাংশ গ্যাসের দাম পড়েছে ৪৩ হাজার ৫৯১ কোটি ১৬ লাখ টাকা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত সরকার একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে শতভাগ বিদ্যুতায়ন করে। জ্বালানির জোগান ঠিক না করে এই সিদ্ধান্তকে অদূরদর্শী বলছেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে তখন থেকেই দেশ জ্বালানি খাতে অনেক বেশি বিদেশ-নির্ভর হয়ে পড়ে। নিজস্ব কূপ থেকে ২০১৫ সালে সর্বোচ্চ ২৭৮৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। এরপর থেকে কমতে কমতে এখন ১৮০০ মিলিয়নের নিচে নেমে এসেছে। মজুদ কমে যাওয়ায় প্রতিদিনই কমছে গ্যাসের উৎপাদন। নতুন কূপ আবিষ্কার করতে না পারলে ২০৩১ সালের মধ্যে মজুদ ফুরিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, অন্তবর্তীকালীন সরকারের সময়ে সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের তৎপরতা অনেকটা দৃশ্যমান। এছাড়া ১৫০টি কূপ খননের কাজ চলছে। নতুন ১০০ কূপ খনন প্রকল্প ২০২৬ সালে শুরু করার কথা থাকলেও সেখান থেকে ১৯টি কূপ এগিয়ে আনা হয়েছে। ডিসেম্বরে একসঙ্গে ১০টি রিগ খনন কাজে নিয়োজিত থাকবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এলএনজি আমদানির এই ব্যয়বৃদ্ধি দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচকে অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি বেড়ে যাচ্ছে এবং সরকারকে অন্যান্য খাত থেকে অর্থ স্থানান্তর করতে হচ্ছে। বাংলাদেশের মোট গ্যাস সরবরাহের প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ এখন আসে আমদানি করা এলএনজি থেকে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ওঠানামা করায় আমদানি ব্যয় অনিশ্চিত থাকে। বিশেষ করে বৈশ্বিক সংকট, যুদ্ধ পরিস্থিতি ও সরবরাহ চেইনের ব্যাঘাতে এলএনজির দাম আরও বেড়েছে।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) সূত্রে জানা যায়, গত কয়েক বছরে এলএনজি আমদানির জন্য সরকারের ভর্তুকি কয়েক গুণ বেড়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শুধু গ্যাস আমদানিতেই প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে।
সব মিলিয়ে আমদানি-নির্ভর হয়ে পড়েছে দেশের জ্বালানি খাত। দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় সরকার এখন ব্যয়বহুল তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির ওপর নির্ভরশীল। এতে দেশীয় উৎপাদনের তুলনায় বহুগুণ বেশি দামে গ্যাস আমদানি করতে হচ্ছে- যার বোঝা পড়ছে জাতীয় অর্থনীতি ও সাধারণ জনগণের ওপর।
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, নিজস্ব উৎস থেকে পাওয়া যায় ১৯ হাজার ৫৬৩ দশমিক ৮২ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস। আর আমদানি করে যোগান দেওয়া হয়েছে ৭ হাজার ১৯৭ দশমিক ৮৪ মিলিয়ন ঘনমিটার। রাষ্ট্রীয় ৩টি কোম্পানির উৎপাদিত গ্যাস প্রতি ঘনমিটারের গড় মূল্য পড়েছে ১.৪৪ টাকা। বহুজাতিক কোম্পানির ৪ ফিল্ডের গ্যাসের দাম পড়েছে ৪.৬৮ টাকা দরে।
আরও পড়ুন
পেট্রোল পাম্পে জ্বালানি তেল পরিমাপে কারচুপি, ঠকছেন ক্রেতারা
জ্বালানি সংকট: ধুঁকছে রফতানিমুখী শিল্পখাত
রাষ্ট্রীয় একমাত্র অনুসন্ধান ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স) ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যোগান দিয়েছে ১ হাজার ১৪৮ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন ঘনমিটার, কোম্পানিটিকে ৪ টাকা হারে দাম পরিশোধ করে পেট্রোবাংলা। বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেড যোগান দিয়েছে ৫ হাজার ৩২৬ দশমিক ৯৯ মিলিয়ন ঘনমিটার, সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেড যোগান দিয়েছে ১ হাজার ৩৪৯ দশমিক ১১ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস। কোম্পানি দুটিকে ১ টাকা হারে বিল পরিশোধ করা হয়েছে।
অন্যদিকে একই সময়ে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি (আইওসি) শেভরন, টাল্লোর অধীনে থাকা বিবিয়ানা, মৌলভীবাজার, জালালাবাদ ও বাঙ্গুরা থেকে যোগান এসেছে ১১ হাজার ৭৩৯ দশমিক ৩২ মিলিয়ন ঘনমিটার। কোম্পানিগুলোকে চুক্তি অনুযায়ী পরিশোধিত গ্যাসের গড় মূল্য পড়েছে ৪.৬৮ টাকা।
একই সময়ে কাতার গ্যাস (রাশ গ্যাস) থেকে জি-টু-জি ভিত্তিতে আনা ৩ হাজার ৪০৩ দশমিক ৩৪ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাসের দাম পড়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার ৩৮৮ দশমিক ৫০ মিলিয়ন টাকা। এতে প্রতি ঘনমিটারের দাম পড়েছে ৪৭.৪২ টাকা। ওমান থেকে জি-টু-জি ভিত্তিতে আনা ১ হাজার ১৯১ দশমিক ১৭ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস ৪৪.৫৬ টাকা হারে পড়েছে ৫৩ হাজার ৮০ দশমিক ১৪ মিলিয়ন টাকা। আর স্পর্ট মার্কেট থেকে টেন্ডারের মাধ্যমে আমদানি করা এলএনজির দাম পড়েছে ৬৫.০৬ টাকা করে। স্পর্ট মার্কেট থেকে আনা ৩ হাজার ৪০৩ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাসের দাম পড়েছে ২ লাখ ২১ হাজার ৪৪৩ মিলিয়ন টাকা। এলএনজি মুসক (৭.২০ টাকা) রি-গ্যাসিফিকেশন (২.৬৩ টাকা) উৎসে কর (২.৪৭ টাকা), এআইটি (১.০৭ টাকা) যুক্ত হওয়ার পর আমদানিকৃত গ্যাসের দাম পড়েছে ৫ লাখ ৪৯ হাজার ৫৪১ দশমিক ৯৭ মিলিয়ন টাকা।
প্রতিনিয়ত বাড়ছে শিল্পকারখানা। ফলে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গ্যাসর চাহিদাও। এতে আমদানির ওপর সামনে বড় ধরনের চাপ পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের উন্নয়নের চাবিকাঠি হলো জ্বালানি সরবরাহ। জ্বালানি শুধু অর্থনীতির বিষয় নয়, এটি সামাজিক প্রসঙ্গও।
খাত সংশ্লিষ্টরা আরও বলেন, দেশীয় গ্যাসের মজুত ধীরে ধীরে কমছে এবং বিশ্বের নানা দেশের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী এটি দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাবে। তাই বিদ্যুৎ, গ্যাস ও অন্যান্য জ্বালানির বিকল্প উৎস খুঁজে বের করা এখনই প্রয়োজন। প্রাকৃতিক গ্যাসের সীমিত মজুতের কারণে এলএনজি বা এলপিজির দিকে আরও মনোযোগ দিতে হবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের উপাচার্য অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, বাংলাদেশের প্রাথমিক জ্বালানি প্রায় ৬৫ শতাংশ এখন আমদানি-নির্ভর। বিদ্যুৎ খাতে ব্যবহৃত জ্বালানির বড় অংশই আসে আমদানি করা কয়লা, তেল ও গ্যাস থেকে। অর্থাৎ আমাদের জ্বালানি ব্যবস্থায় আমদানি-নির্ভরতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে, আর স্থানীয় গ্যাস সরবরাহ দিনকে দিন কমছে।
বুয়েটের সাবেক এই অধ্যাপক আরও বলেন, গত ১০ বছরে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট করে গ্যাস উৎপাদন কমে গেছে। এখন সেই ঘাটতি আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুটে। বর্তমান সরকার বা পূর্ববর্তী বিভিন্ন সরকার গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর যে উদ্যোগগুলো নিয়েছে, সেগুলো এখনো কাঙ্ক্ষিত ফল দিচ্ছে না।
অপর জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েট অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন সম্প্রতি একটি সভায় বলেন, দেশীয় গ্যাস উৎপাদন ১৮০০ মিলিয়নের নিচে নেমে এসেছে। মজুদ কমে যাওয়ায় প্রতিদিনেই কমছে গ্যাসের উৎপাদন। আবিষ্কৃত গ্যাসফিল্ডে অবশিষ্ট মজুদ সাড়ে ৮ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন ঘনফুট) এর নিচে নেমে গেছে। যদি নতুন কূপ আবিষ্কার করতে না পারি, মজুদ ২০৩১ সালের মধ্যেই ফুরিয়ে যাবে। তখন দৈনিক ৪৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন হবে। এজন্য দরকার তেল-গ্যাসের অনুসন্ধান জোরদার করা। অনেক বেশি বেশি কূপ খনন ছাড়া এই সিদ্ধান্তে আসা কঠিন। এজন্য অনুসন্ধানে বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, একটি কূপ খনন করতে যদি ১০০ কোটি টাকা লাগে, ফিল্ডের উন্নয়ন, ২০ বছরের উৎপাদন খরচসহ আনুসাঙ্গিক ব্যয় ধরলাম ৫০০ কোটি টাকা। সেখানে যদি ৩ বিসিএফ গ্যাস পাওয়া যায় তাহলেও এলএনজি আমদানির চেয়ে বেশি লাভজনক।
এমআর/জেবি