images

জাতীয়

দেশের পর্যটন খাতে সিন্ডিকেট-হয়রানি: সমস্যার চিত্র ও সমাধানের পথ

মোস্তফা ইমরুল কায়েস

২৬ জুন ২০২৫, ০৪:৫৫ পিএম

বাংলাদেশের পর্যটন খাতে রয়েছে অপার সম্ভাবনা। দেশে প্রতিদিন বাড়ছে অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যা। পাহাড়, নদী, সাগর ও বনভূমির মনোরম সৌন্দর্য উপভোগে মানুষ ছুটে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। কিন্তু এই ভ্রমণ যাত্রায় বারবার বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে স্থানীয় সিন্ডিকেট, অতিরিক্ত ভাড়া, এবং পর্যটকদের হয়রানি।

বাংলাদেশে প্রায় ১ হাজার ৫৩৮টি পর্যটন স্পট রয়েছে। তবে এর সবগুলোতে পর্যাপ্ত পর্যটক যান না। কিছু এলাকা যেমন কক্সবাজার, কুয়াকাটা, সেন্টমার্টিন, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও সিলেট সারা বছর সরগরম থাকে। এসব এলাকাতেই বেশি হয়রানি ও সিন্ডিকেট করার অভিযোগ আসে।

সিলেটে পর্যটন: সর্বত্র সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য

সিলেটের প্রায় প্রতিটি পর্যটন স্পটেই রয়েছে একটি অঘোষিত সিন্ডিকেট। নৌকা, অটোরিকশা, সিএনজি এমনকি খাবারের হোটেল পর্যন্ত সবখানে জিম্মি করে রাখা হয় পর্যটকদের।

জহুরুল ইসলাম নামে এক পর্যটক বলেন, “সিলেটে এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে সিন্ডিকেট নেই। রাতারগুলে গিয়ে বোট ভাড়াতেও জিম্মি করে ফেলা হয়।”

volagonj
সিলেটের ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর পর্যটন স্পট।

সিলেটে পর্যটকদের জিম্মি করার অভিযোগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে সিএনজি চালকদের সিন্ডিকেট আচরণ। এই শহরে পর্যটন ভ্রমণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সিএনজি চালকদের হয়রানির শিকার হওয়ার গল্প বহু। এমনই একটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন পর্যটক সোলায়মান।

তিনি জানান, কয়েক বছর আগে পাঁচজন বন্ধু মিলে বিছানাকান্দি ভ্রমণে ঢাকা থেকে রওনা দেন। সিলেট শহরে পৌঁছে তারা জিন্দাবাজার মোড়ে একটি সিএনজিতে ওঠেন। তখন চালক জানতে চান তারা একসঙ্গে যাবেন কিনা। তারা একসঙ্গে যাওয়ার কথা জানালে চালক জানান, ভাড়া লাগবে ৫০০ টাকা। কিন্তু সেই সিএনজি লোকাল রুটের জন্য ছিল, যেখানে প্রতি যাত্রীর নির্ধারিত ভাড়া ছিল। তাই তারা মোট ভাড়া দিতে চাইলেও চালক তাতে রাজি হননি।

bichanakandi_
বিছানাকান্দি পর্যটন স্পট।

এরপর তারা অন্য চালকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে গেলে, দেখা যায় কেউই তাদের নিতে রাজি নয়। কারণ প্রথম চালক অন্যদের বাধা দিচ্ছেন, যেন কেউ তাদের না তোলে। বাধ্য হয়ে তারা আবার সেই চালকের কাছেই ফিরে যান। কিন্তু এবার চালক ভাড়া বাড়িয়ে দাবি করেন ৮০০ টাকা। না দিলে যাবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন। এতে বিরক্ত হয়ে তারা সেই স্টেশন ছেড়ে দিয়ে রাস্তায় হাটা শুরু করেন।

আরও পড়ুন-

পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতে কতটা সক্ষম ট্যুরিস্ট পুলিশ?

পথে একটি সিএনজি পেয়ে তারা তাতে ওঠেন এবং যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। প্রথম চালক তাদের পিছু নেন। প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে গিয়েও তিনি পিছু ছাড়েননি। সেখানে গিয়ে তিনি তাদের বহনকারী সিএনজি চালককে বাধ্য করেন তাদের নামিয়ে দিতে। পরবর্তীতে তারা একটি ট্রাকে চড়ে গন্তব্যের দিকে রওনা দেন। তখনই সেই চালক তাদের পিছু ছাড়ে।

এই ঘটনা শুধু ভ্রমণের বিঘ্নই ঘটায়নি, বরং পর্যটকদের মধ্যে ভয় ও হতাশার জন্ম দেয়। সোলায়মান আরও জানান, সিলেট শহরের একটি হোটেলে খিচুড়ি খেতে গিয়ে তাকে স্বাভাবিক দামের চেয়ে দ্বিগুণ দাম পরিশোধ করতে হয়েছে। কোনো প্রতিবাদ করার সুযোগই ছিল না।

cng
সিলেট শহরে সিএনজি অটোরিকশা। ফাইল ছবি

এই অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায়, সিলেটে পর্যটকদের জন্য সাধারণ যানবাহনের ব্যবহার কতটা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। চালকদের এক ধরনের অসাধু একতা বা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পর্যটকদের জিম্মি করা হয়, যা শুধু ভ্রমণ ব্যয় বাড়ায় না, বরং বাংলাদেশের পর্যটনের ভাবমূর্তিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে।

কক্সবাজারে ভাড়া নিয়ে প্রতিযোগিতা ও অনিয়ম

পর্যটকদের জন্য দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্য কক্সবাজার। তবে এখানেও রয়েছে নানাবিধ অভিযোগ। হোটেল, যানবাহন এবং খাবারের রেট ওঠানামা করে প্রতিনিয়ত, বিশেষ করে সপ্তাহান্ত ও ছুটির দিনে।

অনেক পর্যটক অভিযোগ করেছেন, সৈকতের ফটোগ্রাফাররা প্রথমে কম দামে ছবি তোলার প্রলোভন দেখিয়ে পরে বাড়তি টাকা আদায় করেন। কর্তৃপক্ষ বিষয়টি জানলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয় আংশিক, ফলে আচরণে পরিবর্তন আসে না।

coxbazar_photographer
কক্সবাজার সৈকতে পর্যটকদের ছবি তুলে দিচ্ছেন এক ফটোগ্রাফার। ফাইল ছবি

হাওর অঞ্চলেও নৌকা ভাড়া নিয়ে হয়রানি

হাওর অঞ্চলে পর্যটকদের প্রধান বাহন নৌকা। কিন্তু এসব নৌকার ভাড়া একেক সময় একেকরকম, প্রায়ই পর্যটকদের সঙ্গে বাড়তি টাকা নেওয়া হয়। অনেক সময় ভাড়া ঠিক করেও মাঝপথে তা বাড়িয়ে নেওয়া হয়, যা ভ্রমণ অভিজ্ঞতাকে বিষিয়ে তোলে।

tanguar_haor
সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটকবাহী বোট।

কেন এই পরিস্থিতি?

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে প্রায় ১,৫৩৮টি পর্যটন স্পট রয়েছে। কিন্তু এসব স্পট পরিচালনায় নেই সমন্বিত পরিকল্পনা। কোথাও পর্যাপ্ত নজরদারি নেই, কোথাও নেই পর্যটন সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ।

ট্যুরিস্ট পুলিশ থাকলেও তারা সব জায়গায় কার্যকর নয়। আর স্থানীয়দের মধ্যে পর্যটকদের প্রতি সদ্ব্যবহারের মানসিকতাও অনেক ক্ষেত্রে অনুপস্থিত।

আচরণ বদলের প্রয়োজন

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পর্যটন খাতে উন্নতির জন্য শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন নয়, মানুষের আচরণগত পরিবর্তনও জরুরি। সেবা প্রদানকারীদের কাউন্সেলিং ও প্রশিক্ষণ ছাড়া পর্যটকদের সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব নয়।

আরও পড়ুন-

‘হালাল ট্যুরিজমে’ কতটা সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ?

পর্যটন বিশ্লেষক জাকির হোসেন বলেন, “শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলো শুধুমাত্র পর্যটনের ওপর নির্ভর করে নিজেদের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রেখেছে। বাংলাদেশেও সেই সক্ষমতা রয়েছে, তবে দরকার সদিচ্ছা, পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ।”

সমাধানের পথ কী?

বিশেষজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্টরা যেসব বিষয় তুলে ধরেছেন তা হলো-

সেবা দানকারীদের প্রশিক্ষণ: গাইড, চালক, হোটেল-রেস্তোরাঁ কর্মীদের মানসিকতা ও আচরণ বদলাতে প্রশিক্ষণ ও কাউন্সেলিং।

নজরদারির ব্যবস্থা: হোটেল, নৌকা, যানবাহনের নির্ধারিত ভাড়া ও সেবার মান নিশ্চিত করতে নিয়মিত মনিটরিং।

পর্যটক অভিযোগ ব্যবস্থাপনা: দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণযোগ্য হেল্পলাইন ও মোবাইল অ্যাপ চালু করা।

স্থানীয় জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি: পর্যটন এলাকার লোকদের পর্যটনের গুরুত্ব ও উপকারিতা বোঝাতে সচেতনতামূলক কর্মসূচি।

ট্যুরিস্ট পুলিশকে আরও সক্রিয় করা: উপস্থিতি নিশ্চিত করে পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ।

ট্যুরিজম বোর্ডের বক্তব্য

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের সিইও আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের বলেন, “পর্যটকরা যাতে কোথাও হয়রানির শিকার না হন তা দেখার জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশ রয়েছে। তবে সবচেয়ে জরুরি হলো আচরণগত পরিবর্তন। আমরা শিগগিরই ট্রেনিং ও কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে সেক্টরের মানুষের মানসিকতা পরিবর্তনের কাজ শুরু করব।”

tourism_board_bangladesh

বাংলাদেশে পর্যটন খাতে উন্নয়নের জন্য শুধুমাত্র অবকাঠামো উন্নয়ন যথেষ্ট নয়। স্থানীয় জনগণ, পরিবহন সেবা প্রদানকারী এবং পর্যটন সংশ্লিষ্ট সবার আচরণগত পরিবর্তন আনাই এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব হলো পর্যটকদের অভিজ্ঞতাকে নিরাপদ, আনন্দদায়ক ও সাশ্রয়ী করে তোলা—তবেই সত্যিকারের ‘স্মার্ট বাংলাদেশে’ পর্যটন হয়ে উঠবে দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি।

এমআইকে/ইএ