- বাহিনীর জনবল সংখ্যা মাত্র ১৩০০
- নেই প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্ট
- জমি নেই, ভাড়া অফিসে চলছে কার্যক্রম
- সদস্যদের সক্রিয়তা কম, ভরসা ৯৯৯
দেশের পর্যটন খাতের উন্নতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা। আর দেশি-বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য রয়েছে পুলিশের একটি বিশেষ ইউনিট ট্যুরিস্ট পুলিশ। কিন্তু এই ইউনিটটি চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। নানা সমস্যায় জর্জরিত। লাখ লাখ পর্যটকের নিরাপত্তার জন্য মাত্র ১৩০০ ট্যুরিস্ট পুলিশ রয়েছেন। দেশের বেশির ভাগ এলাকায় নেই তাদের অফিস। আবার যেসব অফিস রয়েছে সেগুলোরও সবকটি চলছে ভাড়ায়। নেই দক্ষ জনবল ও লজিস্টিক সাপোর্ট। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতে কতটা সক্ষম এই বাহিনী?
বিজ্ঞাপন
দেশের পর্যটন স্পটগুলোতে গিয়ে কোনো বিপদে পড়লে সাহায্যের জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশকে খোঁজেন পর্যটকরা। কিন্তু তারা ওই সময় কাউকে খুঁজে পান না। আবার পেলেও দেখা যায়, ট্যুরিস্ট পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে অনেক দূরে। সাহায্য চেয়েও সাড়া পাননি এমন অভিযোগ পর্যটকরা অহরহই করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে একটি ট্যুরিস্ট পুলিশ। যাদের কাজই হচ্ছে পর্যটকরা কোনো বিপদে পড়লে সাহায্য করা এবং পর্যটন এরিয়াগুলোতে ঘাঁপটি মেরে থাকা অপরাধীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা। কিন্তু জনবল ও লজিস্টিক সংকটের কারণে তাদের পক্ষে প্রায়ই তা সম্ভব হয়ে উঠে না। এছাড়াও তাদের নেই নিজস্ব অফিস, জমি ও অন্য জিনিসপত্র। ফলে পর্যটকদের কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে পারছে না বাহিনীটি। এতে ভোগান্তিতে পড়ছেন পর্যটকরা।
দেশের প্রধান পর্যটন স্পটগুলোর মধ্যে কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, সুন্দরবন, কুয়াকাটা, সিলেটের রাতারগুল, বিছনাকান্দি, লালাখাল, জাফলং, জুগিরকান্দি মায়াবন উল্লেখযোগ্য। এসব ছাড়াও বিভিন্ন পর্যটন স্পটে ট্যুরিস্ট পুলিশের উপস্থিতি থাকলেও তারা সংখ্যায় খুবই কম। ফলে পর্যটকরা প্রয়োজনের তাদের পাশে পান খুবই কম।

বিজ্ঞাপন
পর্যটকের তুলনায় ট্যুরিস্ট পুলিশের সংখ্যা সামান্য
দেশের পর্যটন স্পটগুলোর মধ্যে উপকূলীয় জেলা কক্সবাজারেই বেশি পর্যটক ঘুরতে যান। অথচ এই পর্যটন স্পটে বিভিন্ন সময়ে ঘটেছে নানা অঘটন। পর্যটকদের জিম্মি করে ধর্ষণ, অপহরণ, অর্থ লুট, ছিনতাই ও মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়।
২০২১ সালের ২২ ডিসেম্বর কক্সবাজারে স্বামী-সন্তানকে জিম্মি করে নারী পর্যটককে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এর আগে ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর রাতে কক্সবাজারের একটি রিসোর্টে অস্ট্রেলিয়ান নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। তারও আগে ২০০৫ সালে বিদেশি নারীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনা গণমাধ্যমে আসায় আলোচনার ঝড় ওঠে।
আলোচিত এসব ঘটনা ছাড়াও এ ধরনের ছোটখাটো ঘটনা প্রায়ই ঘটে। তবে পর্যটকরা পরিবার ও সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে তা প্রকাশ করেন না। ফলে সেগুলো আড়ালেই থেকে যায়। সেসব ঘটনা বিবেচনায় নিলে ট্যুরিস্ট পুলিশের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। এর পাশাপাশি রয়েছে সৈকতে মাদক বিক্রির মহড়া।
ট্যুরিস্ট পুলিশের সক্রিয়তা কম, ভরসা ৯৯৯
কিছু দিন পরপর কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে পর্যটকদের সাগরে ভেসে যাওয়ার খবর প্রচারিত হয়। এর জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশের দায়িত্ব পালনে অবহেলাকে অনেক দায়ী করেন। ট্যুরিস্ট পুলিশ পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকলে পর্যটকদের সতর্ক করতে পারতেন। অথচ সৈকতে ট্যুরিস্ট পুলিশের উপস্থিতি খুব একটা দেখা যায় না।
জাকির নামে এক ট্যুরিস্ট গাইড অভিযোগ করে বলেন, ট্যুরিস্ট পুলিশ ঠিকমতো তাদের দায়িত্ব পালন করে না। তাছাড়া তারা ট্যুরিস্টদের জন্য কতটুকু কাজে আসছে সেটা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।

এদিকে অন্য স্থানগুলোতে ঘুরতে যান এমন কিছু পর্যটকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের দুর্গম ও পাহাড়ি জনপদগুলোতে ট্যুরিস্ট পুলিশকে খুঁজে পান না বেশির ভাগ পর্যটক। ফলে তারা কোনো বিপদে পড়লে ভরসা জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯। তখন ট্রিপল নাইন থেকে সেই এলাকার থানার পুলিশকে বিষয়টি অবগত করে বিপদে পড়া ব্যক্তিকে সাহায্যের জন্য যুক্ত করে দেওয়া হয়।
ইউনুস আলী দীর্ঘদিন ধরে পর্যটন এবং পর্যটক নিয়ে কাজ করছেন। তিনি একটি ট্যুর এজেন্সির সঙ্গেও যুক্ত আছেন। তার মতে, টুরিস্ট পুলিশে যারা কাজ করবেন তাদের বদলি হওয়ার প্রবণতা কমাতে হবে। টুরিস্টদের সেবার মন মানসিকতা নিয়ে পরিকল্পনা করে কাজ করতে হবে। তাহলেই টুরিস্ট পুলিশ নিয়ে মানুষের অভিযোগ আর থাকবে না।
জনবল ও লজিস্টিক সংকট
ট্যুরিস্ট পুলিশের সেবা পুরোপুরি না পাওয়ার অন্যতম কারণ জনবল সংকট। এই সংকটের কারণে সংস্থাটি ঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না। বর্তমানে ট্যুরিস্ট পুলিশে এক হাজার ৩০০ এর মতো জনবল রয়েছে। যা অত্যন্ত কম।
এ বিষয়ে ট্যুরিস্ট পুলিশের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, আমাদের জনবল ডাবল করার প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এছাড়াও লজিস্টিক সাপোর্ট বৃদ্ধি ও ট্রেনিং বাড়ানোর বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ট্যুরিস্ট পুলিশ বর্তমানে দেশের চারটি বিভাগ, ১১টি রিজিয়নের ৩২ জেলায় তাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। সব মিলে ৬৪টি অফিসের মাধ্যমে ১৩২টি পর্যটন স্পটে কাজ করছেন ট্যুরিস্ট পুলিশ সদস্যরা। ট্যুরিস্ট পুলিশকে এখন ঢাকা (ময়মনসিংহ সিলেট ও চট্টগ্রাম), খুলনা, বরিশাল ও রাজশাহী (রংপুর) এই চার বিভাগে ভাগ করা হয়েছে। আর চার বিভাগকে ভাগ করা হয়েছে ১১টি রিজিয়নে। এই ১১ রিজিয়নের মধ্যে ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দারবান, রাজশাহী, রংপুর, খুলনা ও কুয়াকাটা রিজিয়ন রয়েছে।
জনবল সংকটের পাশাপাশি নেই লজিস্টিক সাপোর্টও। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ট্যুরিস্ট পুলিশের অনেক এলাকায় বসার মতো অফিস বা ছাউনিও নেই। সেই এলাকাগুলোতে তারা দিনের বেলায় ডিউটি করলেও রাতের বেলায় আর থাকতে পারেন না। বেশির ভাগ সময়ই তারা দিনের বেলায় ডিউটি করলেও সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়। বসার মতো জায়গাও নেই তাদের।
এভাবে ডিউটি করতে গিয়ে বেশি বিপাকে পড়েন ট্যুরিস্ট পুলিশের নারী সদস্যরা। তাদের জন্য নেই কোনো টয়লেটের ব্যবস্থা। বিষয়টি তাদের জন্য চরম অস্বস্তিকর বলে জানান এক কর্মকর্তা। তিনি জানান, সিলেট, রাঙামাটি ও চট্টগ্রামের এমন কিছু এলাকায় তারা ডিউটি করেন, সেখানে দিনের বেলা থাকা যায়, কিন্তু সন্ধ্যার পর তারাই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। কোনো সদস্য হঠাৎ অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতালে নেওয়ার মতো নেই অ্যাম্বুলেন্সও।

ট্যুরিস্ট পুলিশের ঢাকা রিজিয়নের এসপি মোকলেছুর রহমান ঢাকা মেইলকে জানান, এই মুহূর্তে তাদের গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও সাভারে অফিস রয়েছে। সেই অফিসগুলো থেকেই তারা ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন বিনোদন স্পটে পর্যটকদের নিরাপত্তাসহ যাবতীয় কাজ করে থাকেন। তবে গাজীপুরে যে ২০-২৫টি রিসোর্ট রয়েছে সেগুলোতে বিদেশি পর্যটক গেলে চাহিদা অনুযায়ী নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ থেকে নরসিংদী এলাকায় তারা কাজ করেন।
ঢাকা বিভাগের বিনোদন স্পটগুলোতে পর্যাপ্ত জনবল নেই জানিয়ে তিনি বলেন, মাত্র ১০০ জনবল নিয়ে ঢাকা বিভাগের অফিস চলছে। আর সেটাও রিসোর্টগুলো থেকে পাওয়া অভিযোগ ও চাহিদার ভিত্তিতে।
সংকট কাটিয়ে ওঠার আশ্বাস বাণী
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আবু তাহের মোহাম্মদ জাবের ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের মাস্টারপ্ল্যানের মধ্যে রেখেছি ট্যুরিস্ট পুলিশকে সম্প্রসারণ, তাদের ট্রেনিং দেওয়া এবং লজিস্টিক সাপোর্ট বাড়ানোর বিষয়টি।’
এ বিষয়ে ট্যুরিস্ট পুলিশের মিডিয়া বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, জনবল সীমিত হওয়া সত্ত্বেও ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রতিটি সদস্য পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সার্বক্ষণিক নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। জনবল বাড়ানোর বিষয়টি বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন।
বাহিনীটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ট্যুরিস্ট পুলিশে নতুন লজিস্টিক সহায়তা সংযুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে রেসকিউ ড্রোন ও পার্বত্য অঞ্চলে চলাচল উপযোগী যানবাহন সংগ্রহের জন্য এবং প্রশিক্ষিত জনবল তৈরির জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া আরও আধুনিক ও যুগোপযোগী কার্যকর সেবা প্রদানের উদ্দেশে ট্যুরিস্ট পুলিশে অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।

ট্যুরিস্ট পুলিশের একটি সূত্র জানায়, তারা আগামীতে সাগরবেষ্টিত যেসব এলাকার পর্যটন গড়ে উঠেছে সেখানে লাইভ গার্ড ইউনিট গড়ে তুলতে প্রস্তাবনা সরকারের কাছে পাঠিয়েছেন। এখন সেই প্রস্তাবনা পাস হলে সেটি সম্ভব হবে। প্রায় সময় সাগরবেষ্টিত জেলাগুলোতে বেড়াতে গিয়ে সাগরে ডুবে পর্যটক মারা যাওয়ার খবর আসে। সেই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে তারা এমন উদ্যোগ নিতে যাচ্ছেন। এজন্য নতুন জনবলও চায় বাহিনীটি। দেশের কক্সবাজার, ইনানী, সীতাকুণ্ডের শাকিরচর ও কুয়াকাটায় এই লাইভ গার্ড ইউনিট গড়ে তোলা হবে। প্রস্তাবনা পাস হলেই জনবল নিয়োগ দিয়ে তাদের প্রশিক্ষণ শুরু হবে।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের তথ্যমতে, দেশে এখন এক হাজার ৪৯৮টি পর্যটন স্পট রয়েছে। ২১ জেলার ৮২৩টি স্পটে এখন মাত্র এক হাজার তিনশর কিছু বেশি জনবল নিয়ে ট্যুরিস্ট পুলিশ তাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর মাঝে অন্তত প্রতিদিন শতাধিক জনবল ছুটিতে থাকেন। সব মিলে অর্ধেকের একটু বেশি জনবল মাঠে কাজ করেন। যা দেশের ট্যুরিস্টের তুলনায় অপ্রতুল। এজন্য টুরিস্ট পুলিশের পক্ষ থেকে তা বাড়িয়ে দুই হাজার ৫২৬ জন করার প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাস করলেই সেটি বাস্তবায়ন হবে।
এমআইকে/জেবি

