রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

‘হালাল ট্যুরিজমে’ কতটা সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ?

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
প্রকাশিত: ২৫ জুন ২০২৫, ০৫:৫১ পিএম

শেয়ার করুন:

tourism
সম্ভাবনা থাকলেও হালাল ট্যুরিজম কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ। ছবি: সংগৃহীত
  • ‘হালাল ট্যুরিজম’ সম্ভাবনায় চতুর্থ বাংলাদেশ
  • সব আয়োজন থাকলেও নেই প্রচার ও উদ্যোগ
  • অশ্লীলতামুক্ত পরিবেশ ও হালাল খাবার চিহ্নিতকরণ জরুরি
  • মধ্যপ্রাচ্যের পর্যটকদের টার্গেট করে নিতে হবে পরিকল্পনা

বিশ্বব্যাপী পর্যটন শিল্পের ব্যাপক বিকাশ ঘটছে। অনেক দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে গণ্য হচ্ছে পর্যটন শিল্প। যেসব দেশকে পর্যটকরা গন্তব্য হিসেবে বেছে নেন সেসব দেশ পর্যটকদের সুযোগ-সুবিধা কীভাবে বাড়ানো যায় সেই চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এর অংশ হিসেবে মুসলিম দেশের পর্যটকদের জন্য ‘হালাল ট্যুরিজম’ বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। মুসলিমদের জন্য হালাল খাবার ও আলাদা ব্যবস্থাপনাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে বিভিন্ন বিভিন্ন দেশ। যেসব দেশে এই ব্যবস্থাপনা রয়েছে সেসব দেশেই ভিড় করছেন মুসলিম পর্যটকরা।


বিজ্ঞাপন


‘হালাল ট্যুরিজমে’র জন্য সম্ভাবনাময় দেশগুলোর তালিকায় শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। অথচ বাংলাদেশ সেভাবে মুসলিম দেশগুলোর পর্যটকদের টানতে পারছে না। মধ্যপ্রাচ্যের পর্যটকদের একটি বড় অংশ ভারত-মালদ্বীপসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে বেছে নিচ্ছে। সে ক্ষেত্রে তাদের পছন্দের শীর্ষে বাংলাদেশ থাকার কথা থাকলেও নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর বড় কারণ হলো এখানে হালাল ট্যুরিজমের সব উপকরণ থাকার পরও পরিকল্পনা ও প্রচারের অভাবে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

হালাল ট্যুরিজম কী

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসলামের বিধি-নিষেধ মেনে ভ্রমণই হলো মূলত হালাল ট্যুরিজম। যেখানে নারী-পুরুষের জন্য থাকবে আলাদা সুইমিং পুল। হোটেল মোটেলে থাকবে অ্যালকোহলমুক্ত পরিবেশ। ইবাদতের জায়গা ও পরিবেশ হবে অশ্লীলতামুক্ত।

জানা গেছে, ‘হালাল ট্যুরিজম’-এর যাত্রা শুরু হয় ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরের পর থেকে। তুরস্ক, সৌদি আরব, মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া হালাল ট্যুরিজম নিয়ে প্রথমে উদ্যোগ নেয়। এখন হালাল ট্যুরিজমের পরিধি দিন দিন বাড়ছে। থাইল্যান্ড-ব্রাজিলের মতো অমুসলিম রাষ্ট্রও হালাল ট্যুরিজমের দিকে ঝুঁকছে।

বাংলাদেশে কি হালাল ট্যুরিজম সম্ভব?

পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশ হালাল ট্যুরিজমে এগিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে পৃথিবীর ১০টি দেশ হালাল ট্যুরিজমের অপার সম্ভাবনাময় বলে উঠে এসেছে একটি গবেষণায়। আর এই তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। যদিও বাংলাদেশে হালাল ট্যুরিজমকে প্রসারিত করতে নেই তেমন কোনো গবেষণা ও উদ্যোগ।

Halal
কক্সবাজারে ভিড় জমায় পর্যটকরা। ছবি: সংগৃহীত

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বাংলাদেশে হালাল ট্যুরিজমের সম্ভাবনা অনেক। এখানে ব্যাপক হালাল খাবারও রয়েছে। কিন্তু এরপরও বিদেশিরা হালাল খাবার রয়েছে কি না প্রশ্ন তোলেন। তাদের মতে, প্রতিটি রেস্টুরেন্টে ঢোকার আগে বা ভেতরে স্টিকারে ‘হালাল ফুড রয়েছে’ এমন শব্দ লিখে রাখা উচিত।

বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের এক কর্মকর্তা তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন ঢাকা মেইলের কাছে। তিনি জানান, একবার মালয়েশিয়া গিয়েছেন। সেখানে এক পর্যটকের সঙ্গে দেখা। তখন তার কাছে সেই পর্যটক জানতে চাইলেন, বাংলাদেশে হালাল প্রতিষ্ঠানটির একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে মালয়েশিয়ান ট্যুরিস্ট প্রশ্ন করেছিলেন, তোমাদের ওখানে কি হালাল খাবার নেই? তখন তিনি তার জবাবে বলেছিলেন- আমাদের ওখানে সব খাবারই হালাল। তখন সেই ট্যুরিস্টের পাল্টা প্রশ্ন ছিল- তাহলে কোথাও হালাল শব্দ লেখা থাকে না কেন?

আরও পড়ুন

বিদেশি পর্যটকরা বাংলাদেশে কম আসেন কেন, বাধা কোথায়?

তবে বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন পর্যটন সংশ্লিষ্টরা। তারা ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হোটেল ও রেস্টুরেন্টগুলোকে এই বার্তাটি পৌঁছাতে শুরু করেছেন। ফলে অনেক জায়গায় পরিবর্তনও আসতে শুরু করেছে।

সিলেটের কমলগঞ্জে মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোকজন সেই কাজটি শুরু করেছেন। সেখানে কেউ বেড়াতে গেলে তারা মুসলিম পর্যটকদের জন্য তাদের হোটেল বা রেস্টুরেন্টগুলোতে আলাদাভাবে গরুর মাংস বা বিফ বিক্রির ব্যবস্থা করেছেন। এজন্য তাদের রয়েছে আলাদা রান্নাঘর ও মুসলমান বাবুর্চি। এ বিষয়ে সরকারি কোনো নির্দেশনা না থাকলেও সেই এলাকার ব্যবসায়ীরা নিজেরাই কাজটি সম্প্রতি শুরু করেছেন।

নামাজের ব্যবস্থা ও কেবলা চিহ্নিত করা

দীর্ঘদিন ধরে পর্যটন নিয়ে কাজ করছেন শিবলুল আজম কোরেশি। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, হালাল ট্যুরিজমের জন্য আরেকটা অনুষঙ্গ থাকা দরকার, সেটা হচ্ছে হোটেল-মোটেলগুলোতে নামাজের ব্যবস্থা। প্রতিটি হোটেলে নামাজের জন্য আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু প্রতিটি কক্ষে কেবলা শনাক্ত করে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকা জরুরি। যেটা অনেক ঘাটতি রয়েছে। হোটেলগুলোতে জায়নামাজের ব্যবস্থা থাকে। তবে যে জায়গা বা হোটেলগুলোতে নেই সেগুলোতে এর ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। সে প্রতিষ্ঠানটি হালাল সার্টিফাই হলে সেখানে তো অবশ্যই রাখতে হবে। জায়নামাজের পাশাপাশি কোরআন শরিফ থাকতে পারে। এই ব্যবস্থাগুলো নিলে বাংলাদেশে হালাল ট্যুরিজম প্রতিষ্ঠিত হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

হালাল খাবারের হোটেল সার্টিফাইড ব্যবস্থা

বাংলাদেশের বেশির ভাগ খাবারই হালাল। এজন্য হোটেল ও রেস্টুরেন্টগুলোতে হালাল খাবার থাকার বিষয়টি আলাদা করে বলা হয় না। এতে বিপাকে পড়েন পর্যটকরা। বিষয়টি সহজ করার কাজ চলছে বলে জানিয়েছে ট্যুরিজম বোর্ড। ইতোমধ্যে কাজ শুরু ‍হয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও বিএসটআই একযোগে কাজ করছে। এ বিষয়ে দুই সংস্থার সঙ্গে পৃথক কর্মশালাও করেছে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড।

Bangladesh2
পর্যটনে বাংলাদেশের রয়েছে ব্যাপক সম্ভাবনা। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আবু তাহের মোহাম্মদ জাবের ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে হালাল সার্টিফিকেট নিয়ে। বিদেশিরা চায় আমাদের দেশের প্রতিটি রেস্টুরেন্টে হালাল খাবার রয়েছে সেটা স্টিকার বা সাইনবোর্ডে লেখা থাকুক।

উদ্যোগের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সঙ্গে একটি ওয়ার্কশপ করেছি। এরপর আমাদের দেশে যে ইসলামিক ব্যাংকগুলো রয়েছে তাদের ম্যানেজমেন্টদের নিয়ে একটি ওয়ার্কশপ করেছি। তারা এই জায়গাটিতে কীভাবে সাপোর্ট দিতে পারে সেটা জানার চেষ্টা করেছি।

আরও পড়ুন

পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতে কতটা সক্ষম ট্যুরিস্ট পুলিশ?

অন্যদিকে বাংলাদেশের যা আছে পুরোটাই হালাল ট্যুরিজম বলে মনে করেন ট্যুর অপারেটস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সাবেক প্রেসিডেন্ট শিবলুল আজম কোরেশি। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, শুধু হালাল সার্টিফিকেটের মাধ্যমে এটাকে প্রমোট করা গেলে হালাল পুরোটাই এসে যাবে। কারণ এখানকার শতভাগ খাবার হালাল।

টোয়াবের সাবেক প্রেসিডেন্ট বলেন, হালাল ট্যুরিজমের অন্যতম শর্ত হলো, হালাল টয়লেট। অর্থাৎ সেখানে যেন পানিরও ব্যবস্থা থাকে। পানি দিয়ে মানুষ পরিষ্কার হতে পারে। এ দুটি এলিমেন্ট বাংলাদেশের রয়েছে। হালাল ট্যুরিজমকে জনপ্রিয় করতে হলে এজন্য প্রমোট করতে হবে।

তিনি মনে করেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন কোনটি শরিয়তসম্মত সেই অংশটা তারা সার্টিফাই করবে। অন্যদিকে খাবারটি হালাল পদ্ধতিতে তৈরি করা হচ্ছে কি না সেটা দেখবে বিএসটিআই। পাশাপাশি তারা সার্টিফাই করবে।

শিবলুল আজম কোরেশি বলেন, এ বিষয়গুলো আমাদের দেশে রয়েছে, যা নিয়ে মুসলিম দেশগুলোকে আমাদের দেশে হালাল ট্যুরিজমের জন্য আকৃষ্ট করতে পারি। পাশাপাশি আমাদের দেশে যারা কনজারভেটিভ মুসলিম ট্যুরিস্ট, বিষয়গুলো জানলে তারাও আগ্রহী হবেন।

সাগর তীরে নারীদের আলাদা সুইমিং কর্নার

কেউ কেউ মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে পর্যটকরা আসতে চান। কিন্তু তারা বাংলাদেশের সাগরের তীরে নারীদের আলাদা গোসলের জোন বা জায়গা রয়েছে কি না তা নিয়ে প্রায়ই প্রশ্ন তোলেন। ফলে এই ব্যবস্থাটা থাকলে পর্যটক আসা বাড়বে বলে মনে করেন তারা।

Bangladeh
অনেক ধর্মীয় স্থাপনাও হতে পারে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের গন্তব্য। ছবি: সংগৃহীত

জানা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে প্রায়ই নারীরা এ দেশে আসেন। তারা কক্সবাজার, কুয়াকাটা ও সেন্টমার্টিনে ঘুরতেও যান। কিন্তু সাগর তীরে নামতে চাইলেও সেই পরিবেশ তারা পান না। ফলে হতাশ হয়ে ফিরে যান। এজন্য সাগর তীরগুলোতে বিশেষ করে নারীদের জন্য পর্দায় ঢাকা আলাদা সুইমিং জোন করতে পারলে মধ্যপ্রাচ্য থেকে পর্যটকের সংখ্যা বাড়বে বলে মনে করেন অনেকে।

আরও পড়ুন

দেশে ১৬০০ পর্যটন স্পটের জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশের সংখ্যা ১৪০০

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ সরকার ও ট্যুরিজম বোর্ডের পক্ষ থেকে তেমন পরিবেশ তৈরির জন্য তারা ভাবছেন। ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে সাগরবেষ্টিত জেলাগুলোর সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে বলে জানা গেছে।

আকর্ষণের বস্তু হতে পারে মুসলিম স্থাপনাগুলো

বাংলাদেশে কয়েকশ বছরের পুরনো অনেক মসজিদ ও মাদরাসা এমনকি বড় বড় আলেম-উলামা ও পীরদের মাজার রয়েছে। এসব স্থাপনাকে নানন্দিকভাবে উপস্থাপন, সেগুলোর ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রচারেও পর্যটক আকর্ষণ অনুভব করতে পারে। যেমন মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মিসর, কাতার, কুয়েত, থাইল্যান্ড, নেপাল, ভারত তাদের ধর্মীয় স্থাপনাগুলোকে হাইলাইটস করে পর্যটকদের আকর্ষণ করেন। বাংলাদেশেও ষাটগম্বুজ মসজিদ, সোনা সমজিদ, সিলেটের শাহজালাল ও শাহপরানের মাজার, চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামির মাজার, পদ্মা শাহী মসজিদ হতে পারে পর্যটক আকর্ষেণের অন্যতম স্থাপনা।

এমআইকে/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর