images

জাতীয়

দেশ চার প্রদেশে ভাগ হলে সুযোগ-সুবিধা কি বাড়বে?

আজিম বাপ্পি

১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৩৫ পিএম

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন দেশের প্রশাসনিক কাঠামোতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনার সুপারিশ করেছে। তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব হলো, দেশের চারটি পুরনো প্রশাসনিক বিভাগ—ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী এবং খুলনাকে চারটি আলাদা প্রদেশে ভাগ করা। কমিশনের মতে— এই বিকেন্দ্রীকরণ স্থানীয় শাসন ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে পারে। তবে, এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে দেশের সাধারণ জনগণ ও প্রশাসনিক স্তরে কতটা সুবিধা আসবে, তা নিয়ে নানা মতবিনিময় চলছে।

প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি: বর্তমানে দেশের প্রশাসনিক কাঠামো বেশ কেন্দ্রীভূত। চারটি প্রদেশ গঠন হলে, প্রতিটি প্রদেশের নিজস্ব প্রশাসনিক কাঠামো ও শক্তিশালী সরকার থাকবে। এতে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও স্থানীয় সমস্যাগুলোর সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে।

বিকেন্দ্রীকরণ: প্রদেশ গঠন হলে, সরকারের দায়িত্ব অনেকটা স্থানীয় পর্যায়ে চলে আসবে। ফলে, সরকারের কাজ আরও জনগণের কাছে পৌঁছাবে এবং কার্যক্রমের গতিও বাড়বে। নাগরিকদের কাছে সরকারের সেবা দ্রুত পৌঁছাবে, যা দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

সম্পদ বিতরণ: বর্তমানে কিছু অঞ্চলে সরকারি উন্নয়ন তেমনভাবে ছড়ায় না। প্রদেশ গঠন হলে, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের জন্য উন্নয়ন পরিকল্পনা, বাজেট ও সম্পদের বণ্টন আরও কার্যকরী হতে পারে। এর ফলে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

আরও পড়ুন
সংবিধান সংস্কার কমিশন যেসব প্রস্তাবনা দিতে যাচ্ছে

স্থানীয় প্রয়োজন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত: প্রতিটি প্রদেশের নিজস্ব সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ভূগোলগত বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এসব বৈশিষ্ট্যকে সামনে রেখে সরকার স্থানীয়ভাবে আরও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। যেমন, কৃষি, শিল্প, পরিবহন বা শিক্ষা—প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রদেশের নিজস্ব চাহিদা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।

যদিও প্রদেশ গঠন অনেক সুবিধা নিয়ে আসতে পারে, তবুও এর কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিশেষ করে, এটি একটি নতুন প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করবে, যার জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা ও কাঠামো প্রণয়ন করতে হবে। অনেকেই মনে করেন, প্রদেশ গঠন নতুন সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে, যেমন—প্রশাসনিক অস্থিরতা, অতিরিক্ত খরচ এবং সম্পদের সঠিক বণ্টন নিয়ে বিতর্ক।

তবে, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রথম নয়, এর আগে জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদও দেশের সাতটি প্রদেশে বিভক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তার মতে— সাতটি প্রদেশ করলে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ হবে এবং রাজধানীর ওপর চাপ কমবে।

প্রদেশে ভাগ করার সুযোগ-সুবিধা কী?
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নিগার সুলতানা ঢাকা মেইলকে বলেছেন, প্রদেশে বিভক্তির প্রক্রিয়া মূলত বিকেন্দ্রীকরণ। এর মাধ্যমে, কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু দায়িত্ব ও ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের কাছে চলে যাবে।

তিনি বলেন, প্রাদেশিক সরকার গঠন হলে নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়বে। ছোট প্রশাসনিক ইউনিটগুলো প্রাদেশিক সরকারকে আঞ্চলিক বিষয়গুলোতে আরও বেশি নিয়ন্ত্রণের সুযোগ দেবে, ফলে স্থানীয় সমস্যা দ্রুত সমাধান হবে। এর ফলে, প্রাদেশিক পর্যায়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হবে, যা উন্নয়ন ও সম্পদ বরাদ্দে আরও কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সাহায্য করবে।

তিনি আরও বলেন, প্রদেশে বিভক্ত হলে দেশের অর্থনীতি, অবকাঠামো এবং মানবসম্পদ আরও সমানভাবে বিতরণ করা যাবে, যা আঞ্চলিক বৈষম্য কমাতে সাহায্য করবে। প্রতিটি প্রদেশ তাদের নিজস্ব শক্তির ওপর মনোনিবেশ করে কৃষি, শিল্প বা পর্যটনসহ বিভিন্ন খাতের উন্নয়ন করতে পারবে, যা স্থানীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করবে।

ড. সুলতানা আরও বলেন, প্রদেশ গঠনে স্থানীয় শিল্পের উন্নয়নও বাড়বে। প্রদেশগুলো তাদের অঞ্চলের সম্পদ ও দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন খাত যেমন কৃষি, টেক্সটাইল, প্রযুক্তি ইত্যাদি উন্নত করতে পারবে। এর ফলে, প্রাদেশিক পর্যায়ে কর্মসংস্থান বাড়বে, যা স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক হবে।

আরও পড়ুন
সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়ন করা কি সহজসাধ্য হবে?

এছাড়া, প্রাদেশিক সরকারগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ—যেমন বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়—এতে আরও দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে পারবে, কারণ তাদের কাছে স্থানীয় ভূগোল ও অবকাঠামো সম্পর্কে যথাযথ ধারণা থাকবে। এর ফলে, দুর্যোগের পর ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা ও সম্পদ সংগ্রহ করা সহজ হবে।

ড. সুলতানা বলেন, প্রদেশে বিভক্ত করার ক্ষেত্রে অনেক রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ থাকতে পারে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রদেশগুলোর মধ্যে সমন্বয় এবং স্থিতিশীলতা রক্ষা করা। একাধিক প্রদেশের নিজস্ব প্রশাসন থাকলে, নীতিগুলোর সমন্বয় করা এবং সারাদেশে অভিন্নতা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে উঠবে। এর জন্য সাংবিধানিক ও আইনগত বড় ধরনের পরিবর্তন প্রয়োজন হবে, যা সময়সাপেক্ষ হবে।

আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো উন্নয়ন প্রচেষ্টায় ভারসাম্যহীনতা। কিছু প্রদেশ আরও উন্নত হতে পারে, কিন্তু অন্যান্য প্রদেশ যদি উন্নয়নে পিছিয়ে পড়ে, তাহলে এটি ওই অঞ্চলগুলোকে আরও অনগ্রসর করে তুলতে পারে। এর ফলে অভ্যন্তরীণ অভিবাসন বাড়তে পারে, যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।

তিনি আরও জানান, আঞ্চলিক পরিচয়ের (যেমন সাংস্কৃতিক, ভাষাগত এবং জাতিগত পার্থক্য) তীব্রতা বাড়তে পারে, যার ফলে জাতিগত বিভেদ, আঞ্চলিক রাজনৈতিক আন্দোলন এবং প্রদেশগুলোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি হতে পারে। এটি জাতীয় ঐক্যের অনুভূতিকে দুর্বল করে দিতে পারে এবং রাজনৈতিক বিভক্তির সৃষ্টি করতে পারে। যদি আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়ে বা স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন বৃদ্ধি পায়, তাহলে কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য জাতীয় নিরাপত্তা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়তে পারে।

অধ্যাপক ড. নিগার সুলতানার মতে—প্রাদেশিক সরকার কিসের ভিত্তিতে গঠন হবে, তা নির্ধারণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি, কেন্দ্রীয় সরকার এবং প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতার সঠিক পরিস্কার কাঠামো এবং ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। প্রদেশগুলোকে স্থানীয় চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট স্বায়ত্তশাসন দেওয়া উচিৎ, তবে তাদের কর্তৃত্ব নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব এড়াতে তা জাতীয় নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকতে হবে। জাতিগত, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক উত্তেজনা প্রশমিত করার জন্য সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া গ্রহণ করা প্রয়োজন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, প্রাদেশিক সরকারের সক্ষমতা নিশ্চিত করা, কার্যকর ও স্বচ্ছ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা আবশ্যক।

আরও পড়ুন 

সীমান্তে হট্টগোল: পায়ের চাপে ফসল নষ্ট

এছাড়া, অনগ্রসর প্রদেশগুলোর জন্য সম্পদের সুষম বণ্টন, অর্থনৈতিক প্রণোদনা এবং নির্দিষ্ট উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা জরুরি। এসব ক্ষেত্রে প্রদেশভিত্তিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যেতে পারে, যেমন চীনের হুকো সিস্টেমের (Hukou System) মতো ব্যবস্থা।

মোটকথা, বিকেন্দ্রীকরণের সুবিধা এবং ঝুঁকি সম্পর্কে একটি উন্মুক্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সংলাপ প্রয়োজন, যাতে রাজনৈতিক নেতা, সুশীল সমাজ এবং জনগণের মতামত নেওয়া যায়। বিভাজন যেন বৃহত্তর রাজনৈতিক বিভাজন বা আঞ্চলিকতার দিকে না চলে যায়, তা নিশ্চিত করতে একটি জাতীয় ঐক্যমত্য অপরিহার্য বলে মনে করছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক।

তবে দেশকে প্রদেশে বিভক্ত করলে বৈষম্য সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক অধ্যাপক নঈম সুলতান। ঢাকা মেইলকে তিনি জানিয়েছেন, আমাদের দেশের আয়তনের জন্য এটি যুক্তিযুক্ত নয়। এতে করে বৈষম্য আরও বাড়বে। এছাড়া আমলাতন্ত্র আমাদের উপর চেপে বসবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন এই অধ্যাপক। 

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক মিজানুর রহমান ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক শাহাদাত হোসেন অনু]

এইউ