images

জাতীয়

কেন স্থাপনাগুলো গুঁড়িয়ে দিলো বিএনপি, নেপথ্যে কী?

কাজী রফিক

২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:৪৬ পিএম

images

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে রামচন্দ্রপুর খাল দখল করে গড়ে তোলা বসতবাড়িতে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীরা এই ভাঙচুর করেছেন বলে অভিযোগ ওঠেছে। এ ঘটনায় মালামাল ও টাকা-পয়সা লুটপাট হয়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। তবে ঘটনার সত্যতা ও নেপথ্যে কী, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা৷

শনিবার (২১ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মোহাম্মদপুরের সাত মসজিদ হাউজিং এলাকায় বিএনপির একটি মিছিল হয়। অভিযোগ উঠেছে, ওই মিছিল থেকে সাত মসজিদ হাউজিং ১নং সড়কের পাশে রামচন্দ্রপুর খালের জায়গায় নির্মিত স্থাপনায় ভাঙচুর চালানো হয়।

এ ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন সোনাভরি বেগম নামে এক নারী। সঙ্গে আরও সাতজনকে বিবাদী হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

অভিযোগে বলা হয়, ঢাকায় তাদের কোনো থাকার জায়গা না থাকায় ভাঙ্গা মসজিদ, রামচন্দ্রপুর খালেরপাড়ে সরকারি জায়গায় ঘর নির্মাণ করে বসবাস করছেন। শনিবার তাদের ঘরে অতর্কিতভাবে হামলা করে ভাঙচুর চালানো হয়। তারা অভিযোগ করেন, বিবাদীরা তখন আমাদের ঘরে থাকা বিভিন্ন দামি জিনিসপত্র নিয়ে যায় এবং ঘর ভাঙার পর হুমকি দিয়ে বলে যে, এখানে পরবর্তী সময়ে ঘর তোলার চেষ্টা করলে আমাদের প্রাণে মেরে ফেলবে। অভিযোগে তাদের মারধর করা হয় বলেও উল্লেখ করা হয়।

রোববার (২২ ডিসেম্বর) সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, রামচন্দ্রপুর খালের জায়গায় বাঁশ, টিন ব্যবহার করে বেশ কিছু স্থাপনা গড়া হয়েছিল, যা ভাঙচুর করা হয়েছে। ভেঙে চুরমার অবস্থায় পড়ে আছে স্থাপনাগুলো। যার মধ্যে আসবাবপত্র আর কয়েকজন মানুষ অবস্থান করছেন।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি বছরের ৩০ জুন এই স্থানে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। করপোরেশনের অঞ্চল-৫ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মোতাকাব্বির আহমেদের নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় সাদিক এগ্রোর খামার। এর পাশেই ছিল বেশ কিছু কাঁচা স্থাপনা। যা ওই সময় উচ্ছেদ করা হয়। কাঁচা স্থাপনায় বসবাসকারীরাই পুনরায় ফিরে এসেছেন এবং নগরের উদ্ধার করা জায়গায় আবারও অবৈধভাবে স্থাপনা নির্মাণ করেছেন।

Mohammadpur2

এর আগে সরকার পতনের পর খালের জায়গায় হঠাৎ করেই একটি কাঁচা রাজনৈতিক কার্যালয় নির্মাণ করা হয়। যাতে বিএনপির নামে ব্যানারও লাগানো হয়েছিল। স্থাপনা নির্মাণের কয়েক দিনের মাথায় বিএনপির পক্ষ থেকেই ওই স্থাপনা অপসারণ করা হয়৷ এরপর কয়েক মাস খালের জায়গাটি খালিই ছিল। হঠাৎ কয়েকজন খালের ওপর স্থাপনা নির্মাণ করেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থাপনা নির্মাণকারী খায়রুন নাহার ঢাকা মেইলকে জানান, এক মাস আগে তারা পুনরায় এই স্থাপনা নির্মাণ করেছেন। তিনি বলেন, 'একটা ঘর ভাড়া নিলে মাসে ৩/৪ হাজার টাকা ভাড়া দেওয়া লাগে। আমগো টাকা নাই। মানুষের বাসা-বাড়িতে কাজ করি। আমরা পাঁচটা ফ্যামিলি মিল্লা পাঁচটা ঘর করছি।' এই ঘর তৈরিতে ৮০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়েছে বলে জানান খায়রুন নাহার।

উচ্ছেদের পরেও খালের জায়গায় স্থাপনা কেন? - এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'সরকারি জায়গা, সরকার কইলে আমরা উইঠা যামু।'

সরকার তো কয়েক মাস আগেই আপনাদের উচ্ছেদ করেছে, তাহলে আবার কেন এলেন? - এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমগো থাকার জায়গা নাই। বাসা ভাড়া দেয়ার টাকা নাই।'

নির্মিত ঘর অপসারণে স্থানীয় বিএনপির নেতারা আগেই তাদের সতর্ক করেন বলে জানান বাসিন্দারা। সকিনা বিবি নামে একজন বাসিন্দা বলেন, 'শুক্রবার আমরা সেনা বাহিনীরে জানাইছিলাম। তারা আসছিলো। বিএনপির লোকজন আগেই আমগো হুমকি দিয়া গেছে, ঘর ভাঙতে বলছে।'

আরও পড়ুন

পৌনে চার কিলোমিটারে ৬২ বাতি, জ্বলছে একটি!

অপরাধপ্রবণ জেনেভা ক্যাম্পের ভবিষ্যৎ কী?

শনিবারের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, '৫-৬ জন মহিলা, আর একশোর বেশি পুরুষ আমগো উপরে হামলা করে৷ আমারে মারছে, আমার ওড়নায় এখনো রক্ত আছে। ঘরের মালামাল সব ভাঙচুর করছে।'

ভাঙচুরের পাশাপাশি লুটপাটের অভিযোগও করেন ভুক্তভোগীরা। খায়রুন নাহারের অভিযোগ, তার ঘরে থাকা ১২ হাজার ৬০০ টাকা লুট হয়েছে। আমেনা নামে একজন বাসিন্দার অভিযোগ করেন, তার ১৫ হাজার টাকা ও প্রায় ১২ হাজার টাকা মূল্যমানের স্বর্ণের গহনা লুটপাট হয়েছে। একই সময় কুলসুম বিবি নামে এক বাসিন্দা ৩০ হাজার টাকা ও তার ঘরে থাকা দামি কাপড় লুটপাটের অভিযোগ করেন।

লুটপাটের বিষয়ে থানায় করা অভিযোগে কিছু উল্লেখ নেই। আবার আপনারা বাসা ভাড়া করে থাকতে পারছেন না, তাহলে ঘরে এত টাকা কীভাবে এলো?- ঢাকা মেইলের এমন প্রশ্নের উত্তর মেলেনি ভুক্তভোগীদের থেকে।

তবে তাদের প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ, গ্যাস সিলিন্ডার এবং পাঁচটি ঘরে অন্তত ৬-৭ লাখ টাকার আসবাবপত্র দেখা গেছে৷ যদিও ভুক্তভোগীরা সবাই নিজেদের গৃহকর্মী হিসেবে দাবি করছেন।

সূত্র জানিয়েছে, অভিযোগকারী ব্যাটারিচালিত রিকশার মালিক ও সুদ ব্যবসায়ী৷ তারা নিজেদের অসহায় দাবি করলেও আসলে অসহায় না। বরং খালের পুরো জায়গাটা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতেই নারীনির্ভর এই পাঁচ পরিবারকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব পরিবারের পুরুষ সদস্যরাও মাদক, ছিনতাই ও কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।

Mohammadpur3

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাসখানেক আগে তারা ঘরগুলো নির্মাণ করেন। তারা সবাই দ্বীপজেলা ভোলার বাসিন্দা। রাজনৈতিকভাবেও তারা সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত৷ ক্ষমতাচ্যুত দলটির স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে তাদের সরাসরি সখ্য রয়েছে।

আওয়ামী লীগের ছায়াতলে থাকলেও জায়গাটি দখলে নিতে তারা বিএনপির নাম ব্যবহার করেছেন। এতে স্থানীয় বিএনপির নেতারাও চটেছেন।

সম্প্রতি অভিযোগ উঠে, বিএনপির স্থানীয় নেতারা খালের জায়গা স্থাপনা নির্মাণ করে চাঁদাবাজি করছেন। বিষয়টি গণমাধ্যমে উঠে আসে, গড়ায় বিএনপির কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত।

আরও পড়ুন

সরকার বদলের পর ব্যাটারিচালিত রিকশায় ‘মোটা অংকের বিনিয়োগ’

আতঙ্কের জনপদ মোহাম্মদপুর!

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক হাজী মো. ইউসূফ ঢাকা মেইলকে বলেন, 'খালের জায়গায় স্থাপনা করা হয়েছে, বিষয়টা আমরা শুনেছি। একটা পত্রিকায় বিএনপির নাম জড়িয়ে নিউজও হয়েছে। পরে আমাকে বিষয়টা দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়। আমি নিজে ঘটনাস্থলে যাই। দেখি, খালের জায়গায় কিছু ঘর বানানো হয়েছে৷ যেহেতু এখানে বিএনপির নাম এসেছে, আমরা ঘরগুলো ভেঙে ফেলতে বলি। তাদের এক সপ্তাহ সময়ও দেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে আমরা পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে কথাও বলি।'

এই নেতা বলেন, 'এখানে কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু এখন শুনছি, তারা থানায় অভিযোগ করেছে, তাদের টাকা-পয়সা লুটপাট হয়েছে, তাদের স্বর্ণ-গহনা লুটপাট হয়েছে৷ আসলে এ ধরনের কোনো ঘটনা নেই। আমি যখন ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম, তখন যারা ঘর বানিয়েছে, তারা আমাকে দেখে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিচ্ছিল। আমি সেখান থেকে চলে আসি। পরিবেশটা স্বাভাবিক ছিল না। ওই জায়গাটা মাদকের একটা আড্ডাখানা।'

কারই/জেবি