কাজী রফিক
০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:০৮ পিএম
রাজধানীর গাবতলী থেকে সদরঘাট পর্যন্ত দীর্ঘ বেড়িবাঁধ সড়ক। এরমধ্যে গাবতলী থেকে রায়ের বাজার পর্যন্ত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত। দীর্ঘ এই সড়ককে আলোকিত রাখতে বসানো হয়েছে সড়ক বাতি। তবে এই বাতি কেবলই নামকাওয়াস্তে৷ এক বছরের বেশি সময় ধরে সিটি করপোরেশনের এই সেবা থেকে বঞ্চিত বেড়িবাঁধ পাড়ের কয়েক লাখ মানুষ।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সড়ক বাতি বসানো হয়েছে কয়েক বছর আগেই। শুরুতে কয়েক বছর আলোকিত ছিল বেড়িবাঁধ। তবে এক বছরের বেশি সময় ধরে বেশির ভাগ লাইটই বন্ধ। এই সুযোগে বাড়ছে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড।
জানা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় এলইডি সড়ক বাতি সরবরাহ ও স্থাপন প্রকল্পটি ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি একনেকে অনুমোদিত হয়। মোট ৪৬ হাজার ৪১৯টি ছোট-বড় সাইজের সড়ক বাতি লাগানোর সিদ্ধান্ত হয় তখন। প্রতিটি বাতির আয়ুষ্কাল ২২ বছর হওয়ার কথা। তবে ঠিকভাবে পাঁচ বছরও জ্বলেনি এই বাতি। নানা কারণে অন্ধকারেই রয়ে গেছে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক।
গাবতলী গরুর হাট থেকে বেড়িবাঁধ চার রাস্তার মোড় পর্যন্ত সড়কের দৈর্ঘ্য তিন দশমিক সাত কিলোমিটার। গাবতলী হাট থেকে স্লুইস গেট পর্যন্ত সড়কের দৈর্ঘ্য প্রায় দেড় কিলোমিটার। যেখানে সড়কের পশ্চিম পাশে বৈদ্যুতিক খুঁটি বসানো আছে। তবে কোনো খুঁটিতেই বাতি নেই।
স্থানীয়দের ভাষ্য, সড়কের এই অংশে বাতিই লাগায়নি নগর কর্তৃপক্ষ। জায়গাটির উত্তর সিটির অঞ্চল-৪ এর অধীনস্থ।
তবে অঞ্চল-৪ এর সীমানা শেষ হতেই দ্বীপনগর স্লুইস গেইট এলাকা থেকে শুরু হয় অঞ্চল-৫। স্লুইস গেট থেকে বেড়িবাঁধ চার রাস্তার মোড় পর্যন্ত সড়কের দৈর্ঘ্য প্রায় সোয়া দুই কিলোমিটার। যেখানে সড়ক বাতি আছে ৬২টি। যার মধ্যে ৬১টিই বন্ধ। সব মিলিয়ে প্রায় পৌনে চার কিলোমিটারে সড়ক বাতি লাগানো হয়েছে ৬২টি। এর মধ্যে মাত্র একটি জ্বলতে দেখা গেছে।
স্লুইজ গেট থেকে ঢাকা উদ্যান পর্যন্ত বেড়িবাঁধ সড়কে সড়ক বাতি আছে ৩০টি। যার সব কটিই অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে।
ঢাকা উদ্যান থেকে চার রাস্তার মোড় পর্যন্ত বাতি আছে ৩২টি। এরমধ্যে জ্বলছে মাত্র একটি। বেড়িবাঁধ মোহাম্মদীয়া হাউজিং লিমিটেড ৩নং সড়কের বিপরীতের একটি মাত্র বাতি সন্ধ্যার পর জ্বলে উঠছে। এছাড়া বাকি ৩১টি বাতিই আলোহীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী ঢাকা মেইলকে বলেন, 'আগে তো তাও লাইট জ্বলত। এক বছর ধইরা নাটক শুরু হইছে। জ্বলে, জ্বলে না। এখন তো লাইটই জ্বলে একটা।'
আক্তার হোসেন নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, 'আওয়ামী লীগ পতনের পর যখন ডাকাতি শুরু হইল, তখন তো আমরা নিজেরা এলাকা পাহারা দিছি। তখনও লাইট ছিল না। ভাঙা মসজিদের সামনে পুরো অন্ধকার ছিল। এই জায়গাগুলোতে ছিনতাই হয়।'
অন্ধকারের সুযোগে বেড়িবাঁধে ছিনতাইয়ের ঘটনা নিয়মিত ঘটছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। বেড়িবাঁধ এলাকার চাঁদ উদ্যান গেট থেকে নবীনগর হাউজিং ৭ নম্বর সড়ক পর্যন্ত সড়কে ছিনতাই বেশি বলে স্থানীয়দের বক্তব্যে উঠে এসেছে। সড়ক অন্ধকার থাকায় ছিনতাইকারীদের শনাক্ত করাও কঠিন হয় বলে জানিয়েছেন তারা।
মো. হাসান নামে স্থানীয় একজন বাসিন্দা বলেন, 'অন্ধকারে লোকজন দাঁড়িয়ে গাঁজা খায়। অন্ধকারের মধ্যে কাউকে পেলেই ছিনতাইকারীরা আক্রমণ করে। লাইটগুলো জ্বললে তো এই সুযোগটা পেত না।'
সম্প্রতি মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী ইফতেখার হাসান মোহাম্মদপুরের ছাত্র-জনতার সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে বেড়িবাঁধের সড়ক বাতির বিষয়টি ওসি মোহাম্মদপুরকে জানানো হয়। এ সময় ওসি জানান, সড়ক বাতির বিষয়টি সিটি করপোরেশনের।
বেড়িবাঁধের ছিনতাইপ্রবণ এলাকা এবং বাতি বন্ধ থাকা এলাকাটি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৫ এর অধীনস্থ। এ অঞ্চলের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বে আছেন মো. মোতাকাব্বির আহমেদ। এ বিষয়ে জানতে তাকে ফোন করা হলে এই কর্মকর্তা ফোন ধরেননি।
অঞ্চল-৫ এর সহকারী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) সাইফুল ইসলামের কাছে বেড়িবাঁধ এলাকার সড়ক বাতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, 'আমরা এগুলো (বাতি) লাগিয়েছিলাম। এগুলো আসলে রাখাই যায় না। ট্রাকে তার ছিঁড়ে ফেলছে। রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে কাজ করছে, তখনও লাইনগুলো অনেকে কেটে গেছে।'
সিটি করপোরেশনের ওপর অর্পিত দায়িত্বকে ‘মানবিক কাজ’ আখ্যা দিয়ে অনেকটা দায় এড়ানোর চেষ্টা করলেন এই কর্মকর্তা।
সাইফুল ইসলাম বলেন, 'রাস্তা রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের। আমাদের ওইভাবে বুঝিয়েও দেওয়া হয়নি। তারপরও মানবিক কারণে আমরা দিছিলাম। আমরা করে (ঠিক করে) দেব।'
কতদিন যাবত সড়ক বাতি বন্ধ আছে? এবং আপনারা কতদিনে এটা মেরামত করতে পারবেন? -এমন প্রশ্নের জবাবে সুস্পট উত্তর আসেনি এই কর্মকর্তার পক্ষ থেকে। তিনি বলেন, 'আমরা এটা রিসেন্টলি করে দেব। এটা যখন বন্ধ হয়, আমরা ফিলিপসের মাধ্যমে কাজ করি তো, লাইটগুলো ফিলিপসে নেওয়া লাগে। নরমাল ওয়ারিংগুলো আমরা আমাদের ইয়ে থেকে ব্যবস্থা করি আরকি! এজন্য সমন্বয় করতে সময় লাগে। করে দেব।'
প্রায় এক বছর যাবত বেড়িবাঁধ সড়কের সড়ক বাতির এই অবস্থা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'যেটা বললাম আপনাকে, লাগানোর পর থেকে রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের রাস্তার কাজ, ট্রাক রাখে, গাড়ি রাখে। আমাদের পোল মেরে দেয়। রাখা খুব কঠিন।'
পরিস্থিতি জানিয়ে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মীর খাইরুল আলমের কাছে। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, 'এক বছর লাইট জ্বলে না, এটা তো কেউ ইনফর্ম করেনি আমাদের। বিষয়টা আপনি কি নিশ্চিত?'
এই কর্মকর্তা বলেন, 'এটা আমাদের নিয়মিত কাজ। আমি তো আশ্চর্য হলাম, এক বছর যাবত লাইট জ্বলে না। এটা তো কল্পনাই করা যায় না।' এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপের আশ্বাস দেন এই নগর কর্মকর্তা।
নগর পরিকল্পনাবিদ নজরুল ইসলামের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, 'আমি সার্বিকভাবে বলব, নগর ব্যবস্থাপনার প্রচণ্ড রকম ঘাটতি আছে। সেটা সড়ক ব্যবস্থাপনা হোক, বাজার হোক বা রাস্তার ট্রাফিক হোক। ব্যবস্থাপনা বা সুশাসনের প্রচণ্ড ঘাটতি আছে। সেজন্য কোনোটাই ঠিক মতো হয় না।'
কারই/জেবি