images

জাতীয়

স্থায়ী পুনর্বাসন ও চোখের আলো ফিরে পেতে চান তারা

মাহফুজ উল্লাহ হিমু

২৫ অক্টোবর ২০২৪, ১০:০৩ পিএম

মাগুরার মোহম্মদপুরে বাসিন্দা রবিউল। মাত্র ২৭ বছর বয়সী এই তরুণ জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে অংশ নিয়ে গত ৪ আগস্ট নিজ এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। তার চোখে মোট তিনটি গুলি লাগে। জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে অপারেশনের মাধ্যমে দুটি গুলি অপসারণ করা হয়েছে। তবে বিপত্তি তৃতীয় গুলিটি নিয়ে। সেটি তার চোখের পেছনের অংশে রয়েছে। ফলে তীব্র যন্ত্রণার পাশাপাশি ওই চোখের দৃষ্টি শক্তি হারিয়েছেন তিনি। 

রবিউলের মতো আরও অসংখ্য ছাত্র-তরুণ ও নানা বয়সী মানুষ একই পরিস্থিতিতে আছেন। দেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতায় অনেক মানুষ চিরতরে শারীরিকভাবে অক্ষম হয়েছেন। চক্ষু হাসপাতালে ভর্তি অনেকেরই চোখের আলো হারিয়ে গেছে। ফলে এক অনিশ্চিত গন্তব্যে এগিয়ে চলেছেন চব্বিশের বীরেরা। টিকে থাকার লড়াই করছেন তারা।

এ অবস্থায় তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে রাষ্ট্র। তাদের চিকিৎসার সব দায়িত্ব নিয়েছে সরকার। বিদেশ থেকে চিকিৎসক আনা ছাড়াও প্রয়োজনে দেশের বাইরে পাঠিয়ে চিকিৎসার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি জুলাই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তাদের আর্থিক সহায়তা করছে সরকার।

তবে এককালীন আর্থিক সহায়তা নয়, চক্ষু হাসপাতালে ভর্তি অন্ধত্ব বরণকারীরা চোখের দৃষ্টি ফিরে পেতা চান। আহতদের মধ্যে অনেকেই পুনর্বাসনের জন্য সরকারের সহযোগিতা কামনা করছেন। তারা শুধু চিকিৎসা নয়, কর্মসংস্থানের স্থায়ী ব্যবস্থা চাচ্ছেন, যেন তারা নিজ পায়ে দাঁড়াতে পারেন এবং পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারেন।

প্রত্যেকের রয়েছে প্রতিরোধ ও বীরত্বের গল্প

চক্ষু হাসপাতালে ভর্তি প্রত্যেক আহত ব্যক্তির রয়েছে চোখ হারানোর ভিন্ন ভিন্ন গল্প। যাতে তাদের ত্যাগ, অন্যের প্রতি মমত্ববোধ ও বীরত্বে চিত্র ফুটে। তাদের কেউ ফ্যাসিস্ট দল ও বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে চোখ হারিয়েছেন। কেউ আবার অন্যের জীবন বাঁচাতে গিয়ে।

Himo33

তেমনই একজন সাভারের আশুলিয়ার বাসিন্দা মিজানুর। নিজের গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা জানিয়ে ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘আগস্টের ৫ তারিখ বেলা ১১টার দিকে আমার ডান চোখে গুলি লাগে। পুলিশ ও ছাত্রলীগ আমাদের লক্ষ্য করে গুলি করছিল। আমি এর আগেও আন্দোলনে অংশ নিয়েছি। ওইদিন আমি আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। আন্দোলন চলাকালে একটা ছেলে পায়ে গুলি খেয়ে রোড ডিভাইডারের পাশে পড়েছিল। আমিসহ কয়েকজন সড়কের পাশের কাজে ব্যবহৃত টিনের ব্যারিকেড তৈরি করে তাকে উদ্ধার করতে যাই। পুলিশ আমাদের থেকে অল্প দূরেই ছিল। তারা ছররা গুলি ও রাবার বুলেট ছুড়ছিল। আমরা যখন ছেলেটার একদম কাছে পৌঁছি ঠিক তখন একটা রাবার বুলেট আমার চোখে লাগে। এতে আমার কর্নিয়া-রেটিনা ডেমেজ হয়ে গেছে। চিকিৎসকরা দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার কথা বলছেন। এক চোখে আমি কিছুই দেখি না। এটা ঠিক হবে কি না তাও জানি না।’

আরও পড়ুন

আর্থিক সহায়তা নয়, দৃষ্টি ফিরে পেতে চান অভিভাবকহীন ইমরান

পায়ে বুলেট নিয়ে কাতরাচ্ছেন শাহাদাত

বাগেরহাটের বাসিন্দা লিটন, পেশায় একজন ড্রাইভার। এক চোখ হারানো এই শ্রমজীবী বলেন, ‘বাগেরহাটে গুলির থেকে লাঠিসোঠা ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সংঘাত বেশি হয়েছে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতাকে প্রতিহত করতে মোড়ে মোড়ে অবস্থান নিয়েছিল ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ওরা তো জনতে না, ওইদিন তাদের পতন হবে। রাজপথে যখন অনেক মানুষ নেমে গেছে, তখন আমিও তাদের নেমে গেছি। আওয়ামী লীগের অফিসের সামনে তাদের সাথে আমাদের সংঘর্ষ বাঁধে। তখন আমাকে আঘাত করা হয়। আওয়ামী সন্ত্রাসীরা আমাকে লাঠি নিয়ে বাড়ি দেয়, তা মাথায় ও চোখের পাশে লাগে। আমি অজ্ঞান হয়ে রাস্তায় পড়ে যাই। এতে আমার চোখের মনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমি একচোখ হারিয়েছি।’

স্থায়ী পুনর্বাসন ও উন্নত চিকিৎসার দাবি

চিকিৎসা ও প্রত্যাশা নিয়ে আশুলিয়ার মিজানুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, 'আগস্টে ৫ তারিখ আমি এই হাসপাতালে আসি। তখন আমাকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠায়। সেখান থেকে ভোরে আবার এই হাসপাতালে পাঠায়। এরপর থেকে একাধিক অপারেশন হয়েছে। প্রথম অপারেশনে গুলিটা বের করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ গত ৩০ সেপ্টেম্বর অপারেশন করে গুলি বের করা হয়। তবে তারা দৃষ্টি ফিরে পাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিয়তা দিতে পারেননি। বিদেশ থেকে যারা আসছে, তারা দেখে চলে যাচ্ছেন। তাদের আর এখানের ডাক্তারের মধ্যে মতগত কোনো পার্থক্য দেখি না।'

Himo2

তিনি আরও বলেন, 'এখানের প্রতিটা ডাক্তার অনেক ভালো। তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন বলে সবসময় আশ্বাস দিচ্ছেন। সরকার থেকে আমরা কিছু সহায়তা পেয়েছি। হাসপাতালের থেকে বিনামূল্যে সেবা দেওয়া হচ্ছে।'

পুনর্বাসনের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, 'সরকার থেকে সাহায্য করছে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবে এই আর্থিক সহায়তা দিয়ে আমাদের কিছুই হবে না। আমরা সরকারের কাছে এমন কিছু চাই যেন সারাজীবন কর্ম করে খেতে পারি। যেন কারো ওপর বোঝা না হতে হয়। আমাদের জন্য স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক।'

এক চোখ হারানো কুষ্টিয়ার ব্যবসায়ী হিল্লোল ঢাকা মেইলকে বলেন, 'আমরা মাসের পর মাস এখানে আছি। এখানে আমার একাধিক অপারেশন হয়েছে। সরকার আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে কিন্তু এটা তো স্থায়ী সমাধান নয়। আমরা নানা আর্থিক সমস্যায় আছি। আমি সারাদিনে ৮০০ টাকা খাবারের পেছনে খরচ হচ্ছে। এখানে খাবার অনেক সময় খাওয়ার যোগ্য না। কিছু খাবার বেশি দিচ্ছে কিন্তু মানের কোনো উন্নতি বলার সুযোগ নেই।’

আরও পড়ুন

দুই মাসেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা পাননি আন্দোলনে আহত সাজেদুল

কাছ থেকে গুলি, ঘাতক পুলিশের নাম বলে গেছে কিশোর সাগর

হিল্লোল বলেন, ‘আমাদের তো সংসার ও কর্ম আছে। আমার পরিবারে নয়জন মানুষ। আমার বড় ভাই আছে। কোনো না কোনোভাবে সংসার চলছে। অনেকের তো তাও নেই। তাদের সংসার কীভাবে চলছে কেউ জানে না। তাদের ভবিষ্যৎ কী তাও কেউ জানে না। আমাদের দাবি, আমরা যেন দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেতে পারি তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হোক। আর সকলের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে দিক।'

চক্ষু বিজ্ঞানের চিকিৎসায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও আরও উন্নত চিকিৎসার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, আমার ডান চোখ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত দুইটা অপারেশন হয়েছে। নতুন করে আরও একটা অপারেশন করা হবে। এখন পর্যন্ত কাউকেই বলছে না যে, আমাদের চোখটা ভালো হবে বা ভিশনের উন্নতি হবে। বিদেশি ডাক্তাররা, দেশের ডাক্তাররা যা বলছে সেটাই বলছে। তারা ঠিক করে আমাদের কিছু জানায়নি। 

বিদেশি চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে হিল্লোল বলেন, 'ফ্রান্সের ডাক্তার আমাকে বলেছেন, ওর যে চোখের অবস্থা তার থেকে বেটার হওয়া উচিত ছিল। নেপালের ডাক্তার বললেন, আমার যে চিকিৎসা চলছে এটাই শেষ। এখানের ডাক্তার গুলি আছে কি না তাই নিশ্চিতভাবে বলতে পারছে না। চায়না থেকে আসা ডাক্তার আমাকে দেখার পরপরই বললেন, আমার চোখের ভেতরে গুলি আছে। অর্থাৎ আরও অভিজ্ঞ ডাক্তার কোথাও না কোথাও অবশ্যই আছে। আমি তাদের বলেছি, আমাকে বাইরে রেফার করেন। তারা সেটাও করছে না।'

এমএইচ/জেবি