images

জাতীয়

তুলে নেওয়ার সময় পানিও খেতে দেওয়া হয়নি কাওসারকে

মোস্তফা ইমরুল কায়েস

০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:২৩ পিএম

২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর। সন্ধ্যা থেকে মধ্য রাতের মধ্যে তেজগাঁও এলাকার বিএনপির আট নেতাকর্মীকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় র‌্যাব পরিচয়ে। তারা হলেন— তেজগাঁও ৩৮নং ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমন, সুমনের খালাতো ভাই জাহিদুর করিম তানভীর, কাওসার হোসেন, আব্দুল কাদের ভুইয়া মাসুম, মাজহারুল ইসলাম রাসেদ, আসাদুজ্জামান রানা, আল আমিন ও এ এম আদনান চৌধুরী। সেদিনের পর থেকে আজও তাদের খোঁজ মেলেনি।

নিখোঁজ ৮ জনের একজন তেজগাঁও বিএনপির কর্মী ও প্রাইভেটকার চালক কাওসার হোসেন। তার নামে কোনো থানায় মামলা বা জিডি ছিল না। কাওসার ময়মনসিংহের মোহনগঞ্জ থানার বিল্লাল হোসেনের ছেলে। চাকরির সুবাদে তিনি ঢাকায় থাকতেন কাওসার।

সেদিন যা ঘটেছিল

কাওসার তার স্ত্রী ও সন্তানকে পাঠিয়েছিলেন শ্বশুর বাড়িতে। বাসা ফাঁকা থাকায় বন্ধু শফিক ও ফয়জুলকে ডেকে আনেন। রাতে তারা গল্প-গুজব করে ঘুমিয়ে পড়েন। রাত সোয়া ২টার দিকে হঠাৎ ঘরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। বিছানা থেকে উঠে যান কাওসার। দরজা খুলতেই ঘরে ঘুরে ঢুকে ‍যান ৮-১০ জন পোশাক পরিহিত ও সাদা পোশাকের ব্যক্তি। ঘরে ঢুকেই তারা জানতে চান, কাওসার আছে কিনা। কাওসার তার পরিচয় দিলে তাকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যান তারা। সেই যে তুলে নেওয়া হয়েছে, আর ফেরত দেওয়া হয়নি। কি তার অপরাধ, কেন তাকে তুলে নেওয়া হয়েছিল, সেদিন কিছুই জানানো হয়নি র‌্যাবের পক্ষ থেকে। দীর্ঘ ১১ বছর পার হয়ে ১২ বছর হতে চলেছে। আজও কাওসারের পরিবার জানে না কেন তাকে গুম করা হয়েছে।

তেজগাঁও শাহীনবাগের শিয়া মাজারের ঢালের ৭৪২ নম্বর বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল কাওসারকে।

এ ঘটনার সময় তার স্ত্রী মিনু তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে ছিলেন বাবার বাড়ি বরিশাল সদরে। পরদিন তিনি স্বজনদের মাধ্যমে জানতে পারেন তার স্বামীকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়েছে। খবর পাওয়ামাত্র পরদিন তিনি ঢাকায় ছুটে আসেন। এরপর শাশুড়িকে নিয়ে ছোটেন তেজগাঁও থানায়। বিষয়টি থানা পুলিশকে জানান। কিন্তু তারা সাফ জানিয়ে দেন, কাওসার নামে তারা কাউকে তুলে নিয়ে আনেননি। পরে তিনি থানায় জিডিও করতে চান কিন্তু তারা সেটি নেওয়া হয়নি। চারদিন পর থানার সংশ্লিষ্টরা কাওসারের স্ত্রীকে জানায়, যেহেতু অভিযোগ র‌্যাবের বিরুদ্ধে, তাই তারা জিডি নিতে পারবেন না। সেই থেকে কাওসারের স্ত্রী স্বামীকে তুলে নেওয়ার ঘটনায় জিডিও করতে পারেননি। এরপর বহুবার র‌্যাব-১ ও র‌্যাব সদর দফতরে গেলেও তাদের কাছ থেকে কোনো সদুত্তর পাননি তিনি।

Missing--03--03

এরপর যা যা ঘটেছে

কাওসারের স্ত্রী মিনু আক্তার সেদিনের কথা তুলে ধরে বলেন, সেদিন আমি বাসায় ছিলাম না। অসুস্থ থাকায় মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়িতে ছিলাম। পরদিন কাওসারের বোন আমাকে ফোন করে যে, ভাইকে র‌্যাব তুলে নিয়ে গেছে। তুমি তাড়াতাড়ি আসো। এরপর ঢাকায় আইসা পড়ি। আইসা জানতে পারি, তারা কাওসাররে তুইলা নেওয়ার সময় তারে অনেক মারধর করছে। তার আগে তারা ঘরে ঢুইকাই তারে নাকি কইতাছিল এই ব্যাটা মাল কই রাখছস বল। তখন তার কাছে কি আছে সেটা তারা বলেনি। ‍শুধু বলছে, কিছু একটা আছে। পুরো ঘর তারা তছনছ করছে। আমার ঘরে থাকা চাল, ডাল সব ছড়াইয়া-ছিটাইয়া আছিল। ওরে তুইলা নেওয়ার সময় র‌্যাবের গাড়িগুলো রাখা হইছিল সুলতানা ক্লিনিকের সামনে। র‌্যাবের একটি গাড়িতে তেজগাঁও বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমন ভাইও বসা আছিল। যা এলাকার লোকজন দেখছে। র‌্যাবের দুটি পিকআপ ও একটি প্রাইভেট গাড়ি এসেছিল কাওসারকে তুলে নেওয়ার সময়। ওই রাতে আটজনকে তুলে নেয় র‌্যাব।

মাত্র প্রায় ৫ বছরের সংসারে কি করবেন, কোথায় যাবেন, স্বামীকে কোথায় খুঁজবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না মিনু আক্তার। ঘটনার একদিন স্বামীকে নিয়ে খুঁজতে শুরু করেন।

তিনি আরও বলেন, কই যামু, কি করুম বুঝে উঠবার পারছিলাম না। তবুও শাশুড়িরে নিয়া থানা গেলাম। সারাদিন থাইকাও তারা আমাগো জিডি নিল না। এরপর গেলাম র‌্যাব-১ এ। তারা কইলো, তাগোর কোনো টিম কাওসার নামে কাউরে তুলে নেওয়া আসে নাই। পরে থানায় অনেকদিন গেছি জিডি করবার। তারা কইলো, র‌্যাবের বিরুদ্ধে আমরা নিতে পারব না। আর জিডি করবার পারি নাই। আজও পারি নাই। এছাড়াও র‌্যাব হেড কোয়ার্টারেও গেছি গা। তারা একটা কথাই কইতো, র‌্যাবের কোনো টিম নিয়া আসে নাই।

মিনু বলেন, আমার স্বামী বিএনপির রাজনীতি করতো জানি। কিন্তু তার নামে থানায় কোন মামলা বা জিডিও আছিল না। কেন আমার স্বামীকে ধইরা নিয়া গেল আজও জানতে পারলাম না। তবে সে বিএনপি করার কারণেই তাকে ধরে নিয়েছে বলে মনে করেন তার স্ত্রী।

পুলিশ আসতো আর জিজ্ঞেস করতো কাওসার কোথায়

কাওসার গুমের শিকার হয়েছেন তখনও তার পরিবার বুঝে উঠতে পারেনি। তারা আশায় ছিল, কাওসার ফিরে আসবে। কারণ তখন সামনে জাতীয় নির্বাচন। তারা ধরে নিয়েছিল, নির্বাচন শেষ হলেই তাকে হয়তো ছেড়ে দেবে র‌্যাব। কিন্তু আর ছাড়েনি।

Missing--03--02

কাওসারের স্ত্রী জানাচ্ছিলেন, থানা-র‌্যাব-থানা এভাবে কিছুদিন কেটে যাওয়ার পর থানা থেকে পুলিশ যায় তাদের বাসায়। গিয়েই তার স্ত্রী মিনুকে জিজ্ঞাসা শুরু করে— কাওসার কোথায়, কে তাকে তুলে নিয়ে গেল— নানা প্রশ্ন। এরপর তারা তার কাছে কাওসারের নাম, ঠিকানা ও জাতীয় পরিচয়পত্র চাইতো। শুধু তাই নয়, তার কাছে লিখিতভাবে কাওসারের ও তাদের নাম ঠিকানা লিখে দিতে বলতো। তখন মিনুর একটাই জবাব ছিল, আমার স্বামীকে আইনা দেন আগে, আমি সব নাম-ঠিকানা লিখে দেব। আর এসব প্রশ্ন করতেন, তৎকালীন তেজগাঁও থানার পুলিশের কর্মকর্তা শাহ আলম। যাকে এই ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছিল থানা। থানা সেই সময় কিন্তু মিনুর জিডি নেয়নি। তবে ঠিকই প্রতি মাসে পুলিশ আসতো তার বাসায়। এসে একই প্রশ্ন করতেন তারা। পুলিশের এসব জ্বালাতন সইতে না পেরে এক সময় তিনি সেই বাসা বদল করেন।

কাওসারের কেনা বিছানার চাদর এখনো অক্ষত

গুমের শিকার কাওসারকে তুলে নেওয়ার আগে তার কেনা একটি চাদর ছিল বাসায়। সেই চাদর এখনো অক্ষত রেখেছেন তার স্ত্রী মিনু আক্তার। এই প্রতিবেদক যখন তার বাসা থেকে ফিরছিলেন তখন চাদরটি দেখিয়ে সেই স্মৃতির কথা বলছিলেন তিনি। এখনো সেই চাদরের রঙ ও সুতো অক্ষত থাকায় নতুনই রয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী ফয়জুল যা জানালেন

সেদিনের স্মৃতি তুলে ধরে কাওসারের সাথে ওই কক্ষে থাকা ফয়জুল বলেন, তারা ৮-১০ জন আসছিল। তাদের গায়ে র‌্যাবের পোশাক ও কটি (জ্যাকেট) ছিল। যাতে বড় করে র‌্যাব লেখা ছিল। তারা এসে প্রথমে জানতে চাইলো, কাওসার কে? এরপর কাওসার বললো, আমি কাওসার। একথা বলামাত্রই তাকে মারধর শুরু করলো। আর বলছিল, এই মালটা কই, বের করে দে। কাওসার কোনো নেশা-পানিও করতো না। সে বিএনপি করার কারণেই তাকে তুলে নিয়ে গেছে। কারণ পরদিন বিএনপির সমাবেশ ছিল।

মারধরের পর কাওসার পানি খেতে চাইলেও দেওয়া হয়নি

কাওসারকে তুলে নেওয়ার আগে তাকে তার কক্ষেই বেধড়ক মারধর করেন র‌্যাব সদস্যরা। পরে যখন তাকে তুলে নেওয়া হচ্ছিল কাওসার তাদের কাছে পানি চান। কিন্তু পানি নিয়ে আসা হলেও র‌্যাব সদস্যরা তাকে পানি খেতে দেয়নি। তাদের আশঙ্কা ছিল, কাওসার পানি খেলে ঘটনাস্থলেই মারা ‍যাবেন। পরে তাকে গাড়িতে তোলা হয় বলে অভিযোগ তার পরিবারের। তার স্ত্রীও বলেন, ওরা আমার স্বামীকে পানিও খেতে দেয়নি।

Missing--03--01

মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে আরেক বিপদ

তখন কাওসারের সাথে মিনুর বিয়ের বয়স হয়েছিল ৪ বছর ৮ মাস ১৭ দিন। সঙ্গে ছিল তিন বছরের একমাত্র কন্যা লামিয়া আক্তার মিম। সেই মিমের বয়স এখন ১৪ বছর। মিম এখন সপ্তম শ্রেশিতে পড়ছে। কিন্তু বাবা কেমন, কোথায় আছেন— তা মিমের জানা নেই। তবুও মাকে প্রশ্ন করে— মা, রাস্তাঘাটে আব্বুর সাথে দেখা হলে আব্বু আমাকে চিনতে পারবে? সম্প্রতি গুমের শিকার হয়ে কয়েকজন ফিরে আসায় আশার আলো দেখছে কাওসারের পরিবার। সেই আশা নিয়ে কাওসারের মেয়ে মিম মাকে নানা প্রশ্ন করে।

কাওসারের মেয়ে মিমকে পরিচয় গোপন রেখে স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন মিনু। সবাই জানতো তার বাবা বিদেশ থাকে। কিন্তু অনেকে এখন জানে তার বাবা গুমের শিকার হয়েছে। আজও তাকে ফেরত দেওয়া হয়নি। সেই সময় তিন বছরের মেয়ে মিম বাবার বেশি ভক্ত ছিল। বাবা কি জানে না এই হতাভাগী মেয়ে।

স্বামী ফিরবে, প্রত্যাশা স্ত্রীর

কাওসারের স্ত্রী মিনু আজও বিশ্বাস করেন তার স্বামী বেঁচে আছেন। হয়তো কোনো একদিন ফিরে আসবেন কাওসার। র‌্যাব-১ এর টিমের সদস্যরাই কাওসারকে তুলে নিয়ে গেছে। স্বামী কাওসার বেঁচে নেই— এটা স্ত্রী বিশ্বাস করতে চান না।

এমআইকে/জেএম