রাজধানীর পুরান ঢাকার জেলগেট থেকে একই সাথে ছাত্রদলের ৫ নেতাকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর। এই ঘটনার ১১ দিনের মাথায় তিনজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু বাকি দুজন আজও ফিরে আসেননি। সেই দুজন হলেন— খালেদ হাসান সোহেল (৩২) ও সম্রাট মোল্লা (২৮)। তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে, তারা কোথায় আছেন— তা এখনও জানতে পারেনি পরিবার দুটি। এখনও হন্যে হয়ে তারা ডিবি, র্যাব কার্যালয় ছাড়াও কারাগারে ছুটে যান, যদি প্রিয়জনের খোঁজ মেলে!
সম্রাট মোল্লা (২৫) সূত্রাপুর থানার ৪৪নং ওয়ার্ড ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। তিনি সেই এলাকায় বিএনপির বিভিন্ন কেন্দ্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখতেন। আর এ কারণেই তাকে গুম করা হয়েছে বলে মনে করে তার পরিবার।
বিজ্ঞাপন
গুমের শিকার সম্রাটের বাবা চকবাজার এলাকায় একটা ছোট ব্যবসা করেন। বাবার আয়ে এখনও তাদের সংসার চলে। কিন্তু বড় ছেলেকে হারিয়ে বাবা এখন দিশেহারা। সম্রাটরা দুই ভাই, তিন বোন। ভাই নেই, তা তারা বিশ্বাস করতে চান না। তার বোনেরা মনে করেন, ভাই এখনও জীবিত আছেন। কোনো একদিন ফিরে আসবেন।
সম্প্রতি কথা হয় সম্রাটের বড় বোন কানিজ ফাতেমা রিতার সাথে। সম্রাটকে যখন তুলে নেওয়া হয় তখন রিতার বয়স ৩০ বছর। সেই ভাইয়ের খোঁজে ১১টি বছর কেটে গেছে। কিন্তু ভাই কোথায় জানেন না তিনি।
রিতা ঢাকা মেইলকে জানান, সম্রাট তার ৫ বন্ধুর সাথে কারাগারে থাকা ছাত্রদলের এক কর্মীকে দেখতে গিয়েছিলেন। তাদের ছয়জনের একজন ওই সময় নামাজ পড়তে যান। বাকিরা লাইনে দাঁড়িয়ে ভেতরে ঢোকার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছিলেন। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন সদস্য তাদের কাছে যান এবং পরিচয় জানতে চান। পরে তাদের সাদা রঙের একটি মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়া হয়। ১১ দিন পর তিনজনকে ছেড়ে দেওয়া হলেও সম্রাট ও সোহেল আজও ফিরে আসেননি। ফিরে আসা তিনজনের কাছে এসব তথ্য জেনেছেন সম্রাটের বড় বোন কানিজ ফাতেমা রিতা।
বিজ্ঞাপন
তুলে নেওয়ার পর কি ঘটেছিল
সম্রাটকে দুপুরে তুলে নেওয়া হলেও তার পরিবার খবর পান রাত ১১টায়। কোথায় যাবেন, কি করবেন— এই চিন্তাতেই রাত কেটে যায়। পরদিন ছুটে যান সূত্রাপুর থানায়। কিন্তু তারা জানায়, এ বিষয়ে তারা কিছু জানে না। এরপর যান চকবাজার থানায়। সেখানে গিয়ে তারা একটি সাধারণ ডায়েরি করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হন। পরে তারা মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয় ও টিকাটুলিতে র্যাব-১১ এর অফিসে যোগাযোগ করেন। কিন্তু অফিস দুটোতে গিয়ে কোনো লাভ হয়নি তাদের। তাদেরও একই কথা— সম্রাট নামে কাউকে আটক করেনি তারা।
পরদিন কি ঘটেছিল তা তুলে ধরে সম্রাটের বোন বলেন, আমরা আবারও চকবাজার থানায় গিয়া বললাম, আমাগো জিডিটা অন্তত নেন। তখন তারা সেদিনের পেপার দেখাইয়া কইলো, দেখেন তিনজনকে জেলগেট থাইকা তুলে নেওয়ার সেই নিউজ তো পেপারে আসছে। এরপর কইলো, ‘এটা রাজনৈতিক বিষয়।’ জিডি নেওয়া যাবে না। তখন আমরা অন্ধকারে হাতড়াইতাছিলাম। কারণ কোন বাহিনী তাদের তুলে নিয়ে গেছে তা তো জানি না। পরে হতাশ হয়ে বাসায় ফিরে যাই।
তিন বছর পর থানায় জিডি
টানা তিন বছর শুধু থানা, ডিবি অফিস আর র্যাব অফিস করেই কেটেছে সম্রাটের পরিবারের। ডিবি অফিসের সামনে তার পরিবার দিনের পর দিন অপেক্ষা করতো। কিন্তু তাদের গেটের ভেতরে যেতে দেওয়া হয়নি। এমনকি অভিযোগও কেউ শোনেনি। এক পর্যায়ে তারা হাল ছেড়ে দেন। কিন্তু দীর্ঘ তিন বছর পর চকবাজার থানা সম্রাটের বিষয়ে জিডি নেওয়া হয়। তবে শর্ত ছিল, পাঁচজনকে তুলে নেওয়া হয়েছে উল্লেখ করা যাবে না। বাধ্য হয়ে সেদিন সোহেল ও সম্রাটের পরিবার সেই সময় পৃথক জিডি করেছিল।
পরিবার ভেবেছিল, হয়তো সম্রাটকে ছেড়ে দেবে
সম্রাটের বোন রিতা বলেন, থানা পুলিশ, ডিবি ও র্যাব অফিস সম্পর্কে আমরা কিছুই জানতাম না। তখন তাকে যে ধরে নিয়ে গিয়ে গুম করবে— এটা চিন্তার মধ্যেও ছিল না। আমরা শুধু ভাবতাম, হয়তো তাকে ধরে কোথায়ও আটকে রাখছে। একদিন ছেড়ে দেবে। সে বের হবে। কিন্তু নিখোঁজ হয়ে যাবে এবং এত দীর্ঘদিন ধরে— তা কল্পনারও বাইরে ছিল। এটা তখন মাথার মধ্যেই আসেনি আমাগো।
কারাগারে গিয়ে মাইকিং করান, যদি ভাইয়ের খোঁজ পান
রিতা জানান, তার ভাইকে কোথাও না পেয়ে তারা এবার ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে খুঁজতে থাকেন। এজন্য তারা সেখানে মাইকিং করারও ব্যবস্থা করেন। এরপর বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করে না পেয়ে ১৫ দিন পর দুই বোন গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারের উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু সেদিন জেলগেটে পৌঁছাতেই সন্ধ্যা। গেট বন্ধ। তখন রাস্তায় বের হলেই পেট্রোল বোমা মারছিল দুর্বৃত্তরা। বাধ্য হয়ে সেদিনের রাতটি দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাসায় থাকেন তারা। রিতা বলেন, পরদিন আবার কারাগার গিয়ে তাগোরে অনেক অনুরোধ করে টাকা দিয়া মাইকিং করালাম। কিন্তু পাইলাম না। এরপর থাইক্যা যে যেইখানে যাইতে কইছে সেইখানেই গেছি।
টানা ১১ বছর ভাইকে খুঁজে চলেছেন রিতা
ভাইকে খুঁজে পেতে রিতা টানা ১১ বছর বিভিন্ন স্থানে ছুটে চলেছেন। কোথাও কোনো প্রতিবাদ, মানববন্ধন হলেই ছুটে যান। রিতা বলেন, ভাইকে খোঁজার জন্য কোনো প্রোগ্রাম বাদ দেই নাই। অসুস্থ ছিলাম, জ্বর হইছিল, তবুও গেছি। যদি ভাইটারে কেউ খুঁজে দেয়! যখন তুলে নিয়া গেল মনে হইছে, এই বুঝি ৭ দিন, ১৫ দিন, এক মাস পর ছাইড়া দিবো। তখন কিন্তু গুমটা এত প্রচলন ছিল না। মানুষ গুম কইরা ফেলায়— এইটা ধারণাতেও আছিল না।
সামাজিকভাবে হেয় হতে হয়েছে পরিবারটিকে
সম্রাট যখন গুম হইয়া গেল, মানুষ তো বুঝতো না। রাস্তাঘাটে আলাপ করতো, সম্রাটরে কেন তুইলা নিলো। নিশ্চয় কোনো মামলা আছিলো। এমন কথা তারা আড়ালে বলতো, আমাগো সামনে কইতে পারতো না। এভাবে আমাগো সামাজিকভাবে হেয় হতে হইছে। তখন মানুষ বুঝতোই না যে রাজনীতি করলে গুম করে ফেলে। তাদের ধারণা ছিল, নিশ্চয়ই কোনো কিছু করছে। আমরা বললেও তারা বুঝতে চাইতো না।
ভাই গুম হওয়ায় বোনের বিয়ে ভেঙ্গেছে কয়েক দফা
রিতা জানান, তার ভাই সম্রাট গুম হওয়ার বিষয়টা তারা মানুষকে বলতে সাহস পেতেন না। কেউ জিজ্ঞাসা করলেই বলতেন, তার ভাই বিদেশে থাকেন। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে সবশেষ ছোট বোনের বিয়ের সময়। পাত্রপক্ষ আসলে তাদের ভাইয়ের বিদেশ থাকার বিষয়টি বলা হলেও কোনোভাবে তারা জেনে যেতেন সম্রাটকে গুম করা হয়েছে। এরপর আর সেই ঘরের লোকজন বোনের বিয়ের কথা নিয়ে আসতো না। এভাবে কয়েকটি বিয়ে ভেঙ্গে যায় ছোট বোনের। এই কষ্টের কথা আজও কাউকে মন খুলে বলতে পারিনি। তবে কপাল ভালো, ভাই গুমের শিকার জেনেও এক যুবক বোনকে বিয়ে করেছেন।
বছর ঘুরলেই পুলিশের তদন্ত ‘নাটক’
সম্রাট গুম হওয়ার পর প্রতি বছর তাদের বাসায় থানা পুলিশ সদস্যরা আসতেন। আর তার বোনকে জিজ্ঞেস করতেন, সম্রাট কি করতেন, কিভাবে নিখোঁজ হলো, কে তাকে তুলে নিলো— নানা প্রশ্ন। কিন্তু কাজের কাজ তারা কিছু করতেন না। বিষয়গুলো এক প্রকার পুলিশের অভিনয় ছিল মনে করেন সম্রাটের স্বজনরা। কারণ সম্রাটের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার মামলা বা জিডি ছিল না।
বাড়ি ভাড়া নিতে গিয়েও বিপত্তি
সম্রাটের পরিবার সূত্রাপুরের একটি বাসায় থাকাকালীন গুম হন তিনি। পরে তারা সেই বাসা ছেড়ে আরেকটি বাসায় ভাড়া ওঠেন। তবে মিথ্যা তথ্য দিয়ে। বাসার মালিক জানতেন তার ভাই বিদেশে থাকেন। প্রথম কয়েক বছর বিষয়টি কেউ না জানলেও বিএনপির পক্ষ থেকে কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা তাদের বাসায় খোঁজখবর নিতে গেলে বিপত্তি বাঁধে। বাসার মালিক সাফ জানিয়ে দেন, তাদের বাসা ছাড়তে হবে। সেদিন থেকে বাসায় কাউকে আর আসতে বলেন না তার বোন। ভাইয়ের গুমের বিষয়টি কাউকে বলতেনও না, যদি বাড়তি প্রশ্ন করে বসে কেউ। রিতা বলেন, এটাও তো হয়রানি। বিএনপির নেতারা সবার বাসায় যায় কিন্তু আমি তাদের ভয়ে ডাকতে পারি না।
সম্রাট এখনও বেঁচে আছেন, বিশ্বাস পরিবারের
গুমের শিকার সম্রাটের বোন রিতা ও তার পরিবারের সদস্যরা মনে করেন, সম্রাট এখনও বেঁচে আছেন। হয়তো কোনো একদিন সুস্থ শরীরে ফিরে বাসায় এসে নক করবেন। সেই দিনটির অপেক্ষায় এখনও নির্ঘুম রাত কাটছে পরিবারটির।
এমআইকে/জেএম