বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২৪, ঢাকা

১১ বছর ধরে সোহেলের অপেক্ষায় স্ত্রী, বাবার ছবি বুকে নিয়ে আরিয়ান

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
প্রকাশিত: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:১২ পিএম

শেয়ার করুন:

১১ বছর ধরে সোহেলের অপেক্ষায় স্ত্রী, বাবার ছবি বুকে নিয়ে আরিয়ান

২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর। পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে থেকে একই সাথে ছাত্রদলের পাঁচ নেতাকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়। এরমধ্যে তিনজনকে ১১ দিন পর ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু বাকি দুজনের খোঁজ আজও মেলেনি। তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা এখনও জানে না পরিবারের সদস্যরা। তারা কি বেঁচে আছে, নাকি তাদের পরিণতি বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর মতো হয়েছে— এ প্রশ্ন এখনও ঘুরপাক খাচ্ছে তাদের মনে। এর মাঝেও তারা স্বপ্ন দেখেন, গুম হওয়া স্বজন কোনো একদিন ভোররাতে ফিরে আসবে। দরজা কড়া নেড়ে বলবে, দরজাটা খোলো!

সেদিন ডিবি পরিচয়ে যাদের তুলে নেওয়া হয়েছিল তারা হলেন, সম্রাট মোল্লা, আনিস, বিপ্লব, মিঠু ও সোহেল। পাঁচজনেরই বাসা সূত্রাপুর এলাকায়। তারা ছাত্রদলের রাজনীতি করতেন।


বিজ্ঞাপন


এরমধ্যে তিনজন ফিরে আসলেও এখনও ফেরেননি ছাত্রদলের দুই নেতা খালেদ হাসান সোহেল (৩২) ও সম্রাট মোল্লা। সোহেল পুরান ঢাকার বাংলাবাজারের ফিরোজ উদ্দিনের ছেলে।

স্থানীয় ছাত্রদলের মিছিল-মিটিংয়ে সবসময় প্রথম সারিতেই থাকতেন সোহেল। আর এটাই তার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে সোহেল ছিলেন সবার চেয়ে বড়। সংসারেরও বেশিরভাগ দায়িত্বও ছিল তার কাঁধে।

কি ঘটেছিল সেদিন, তারপর কি করেছিলেন পরিবারের সদস্যরা— তা নিয়ে এই প্রতিবেদকের সাথে কথা বলেছেন ভুক্তভোগী সোহেলের স্ত্রী সৈয়দা শাম্মী সুলতানা নিপা। বিয়ের মাত্র ৭ বছর পরই স্বামী হন গুম। স্বামীর জন্য প্রায় ১১ বছর অপেক্ষা করছেন তিনি। এখনও তার অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়নি।

Missing---01--Inner--02


বিজ্ঞাপন


খালেদ হাসান সোহেলকে যেদিন ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তখন তার ছেলের বয়স ছিল পাঁচ বছর। সেই ছেলে ১৬ বছরের তরুণ মোহাম্মদ সাদমান শিহাব আরিয়ান এখন দশম শ্রেণির ছাত্র। দীর্ঘ এই সময়ে বাবার অনুপস্থিতিতে তাকে বড় হতে হয়েছে। ছোটবেলা থেকে তাকে মা এই বলে সান্ত্বনা দিয়েছেন, ‘তোমার বাবা বিদেশ গিয়েছে। সময় হলে চলে আসবে।’ কিন্তু এক সময় সত্যিটা জেনে যায় ছেলে আরিয়ান। সে এখন আর জিজ্ঞেস করে না, বাবা কবে ফিরে আসবে। তারপরও আরিয়ান স্বপ্ন দেখে— তার বাবা একদিন ফিরে আসবে, বুকে জড়িয়ে নেবে তাকে।

সেদিন কি ঘটেছিল পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় জেলগেটের সামনে

গুমের শিকার সোহেলের স্ত্রী নিপা জানাচ্ছিলেন, ২০১৩ সালে ২৮ নভেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে ছাত্রদলের কর্মী সনজিৎকে দেখতে যান তার স্বামী ছাড়াও আরও ৫ নেতাকর্মী। তাদের মধ্যে রুবেল নামে একজন জোহরের নামাজ পড়তে পাশের একটি মসজিদে যান। বাকি পাঁচজন জেলগেটে মোবাইল জমা দিয়ে ভেতরে ঢোকার প্রসেসিং করছিলেন। পাশাপাশি তারা অপেক্ষা করছিলেন রুবেলের ফিরে আসার জন্য। এরই ফাঁকে একটি সাদা রঙের মাইক্রোবাসে আসেন কয়েকজন ব্যক্তি। পিস্তল ঠেকিয়ে ওই পাঁচজনকে জিম্মি করে ফেলেন। এরপর হাতকড়া পরিয়ে একে একে কালো গ্লাসের মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়া হয়। কিছুক্ষণ পরে মসজিদে যাওয়া রুবেল ফিরে এসে জানতে পারেন পাঁচজনকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়া হয়েছে। এমনকি জেলগেটে ওই পাঁচজনের জমা দেওয়া ফোনগুলো নিয়ে গেছেন তারা।

Missing---01--Inner--01

সেই ঘটনার ১১ দিন পর ফিরে আসা তিনজন তাদের সাথে কি ঘটেছিল তা জানিয়েছিল পরিবারকে। মাইক্রোতে তুলেই বেধড়ক মারধর করা হয় তাদের। পরে প্রায় দেড় থেকে দুই ঘণ্টা পর অজ্ঞাত কোনো স্থানে নিয়ে ছোট ছোট কুঠুরি ঘরে আলাদাভাবে রাখা হয় তাদের।

সোহেলকে তুলে নেওয়ার পর স্ত্রী যা যা করেছেন

সোহেলসহ তাদের পাঁচজনকে তুলে নেওয়া হয় দুপুরে। কিন্তু সোহেলের পরিবার খবর পান সন্ধ্যায়। সেই রুবেল সোহেলর স্ত্রীকে শুধু বলেছিল, সোহেলকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না ভাবী। আমরা তাকে খোঁজার চেষ্টা করছি। তাকে যে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে গেছে তা তখন পরিবারকে জানানো হয়নি।

পরে গভীর রাতে রুবেলের কাছে কল করে বিষয়টি জানতে পারেন তার স্ত্রী নিপা। পরদিন পরিবারের সদস্যরা ছুটে যান পুরান ঢাকার চকবাজার থানায়। সোহেলের খোঁজ করতে থাকেন তারা। কিন্তু পুলিশ তাদের কোনো পাত্তা দেয়নি। এমনকি জিডি করতে চাইলে জিডিও নেয়নি পুলিশ। পরে জিডি নেওয়া হলেও সেটি দায়সারাভাবে নেওয়া হয়েছে বলে পরিবারের অভিযোগ। পরিবারের সদস্যরা এরপর ডিবি অফিসে ধর্ণা দিতে থাকে। কিন্তু সোহেলের কোনো খোঁজ মেলেনি। নিপা বলেন, তারা শুধু একটি কথাই বলতো, আপনারা নাম ঠিকানা দিয়ে যান। এমন কাউকে ধরা হলে আমরা জানাব। একই কথা জানাতো র‌্যাবও। এসব কথা যেন তাদের মুখস্থ ছিল।

গুমের কথা কল্পনাও করিনি

নিপা বলেন, তখন আমরা কল্পনাও করিনি গুম করা হবে। কারণ তখন এমন ঘটনা তেমন শুনিনি, শুধু বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী ছাড়া। রাজনীতি করে আন্দোলন করলে কাউকে গুম করে দেবে সরকার, তাকে বছরের পর বছর লুকিয়ে রাখবে— এটা তো ধারণার বাইরে ছিল। শুধুমাত্র রাজনৈতিক আন্দোলনের কারণে কাউকে তুলে নিয়ে যাবে— এটা আমাদের কল্পনাতেও ছিল না। আন্দোলন করলে জেল হবে, মামলা হবে। কিন্তু তুলে নিয়ে গুম করবে— এটা তখন মানুষ জানতোই না। খোঁজ করলে যে পাব না, তা আমাদের মাথায় কাজ করেনি। এত বছরেও যে পাব না— এটা তো কল্পনাতেও ছিল না।

Missing---01--Inner--03

তিনি বলেন, আমাদের ধারণা ছিল, তাদেরকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর কোর্টে হ্যান্ডওভার করবে। পরদিন আমরা থানায় গিয়ে জিডি করি, এরপর আবার দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়। ডিবি অফিস থেকে র‌্যাব, র‌্যাব থেকে বিভিন্ন কারাগারে। তখন আমাদের ডিবি, থানা পুলিশ সম্পর্কে আমরা পুরোপুরি অজ্ঞ। পরে আমরা আদালতে ধর্ণা দেওয়া শুরু করলাম। সকালে যেতাম, বিকেলে আসতাম। আদালত চত্বরে আসা প্রত্যেকটা গাড়ির জানালায় তাকিয়ে তাকাতাম। ভাবতাম হয়তো এর পরের গাড়িতে নিয়ে আসবে। এভাবে টানা কয়েকদিন থেকে কোনো লাভ হলো না। সেই সময়ের দিনগুলোতে সোহেলের কথা জানতে চাইলে পুলিশ সদস্যরা নানা দুর্ব্যবহার করতেন।

টাকার অভাবে বাচ্চাকে দুধ কিনে খাওয়াতে পারেননি সোহেলের স্ত্রী

নিপা বলেন, তার স্বামী পরিবারের সবার বড়। তাই তার ও ছেলের যাবতীয় খরচ তার কাছ থেকেই আসতো। সোহেল যখন গুম হয়ে গেল তখন তার ছেলের বয়স মাত্র পাঁচ বছর। তিনি বলেন, যখন একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হঠাৎ করে হারিয়ে যায় তখন তো আমার ও ছেলের ওপর পড়ে চাপটা। কারণ আমি তো কাউকে বলতে পারছি না, আমার বাচ্চার দুধ লাগবে। আমার ছেলের পড়ার খরচ লাগবে। তখন তো একরকম দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম। এদিকে স্বামীকে খুঁজে বেড়াচ্ছি রাস্তায় রাস্তায়, ওকে কোথায় আমি পাব! আমার অনেক কষ্ট হয়েছে, টাকার অভাবে বাচ্চাকে দুধ কিনেও খাওয়াতে পারিনি। ওকে বাবা ছাড়াও বড় করতে হয়েছে। আর ও (সোহেল) কিছু রেখেও যেতে পারেনি। তখন আমার মাথায় টেনশন ভর করলো— আমি কিভাবে সংসারটা চালাবো? ভাবলাম, আমাকে এখন বাচ্চার জন্য কিছু করতে হবে।

Missing---01--Inner--04

এখনও স্বামীকে খুঁজছেন স্ত্রী নিপা

স্বামী খালেদ হাসান সোহেল ১১ বছর আগে গুম হয়েছেন সরকারের কোনো এক বাহিনীর হাতে। কিন্তু কারা তাকে তুলে নিয়েছিল এবং কোথায় রাখা হয়েছে, এখনও জানে না সোহেলের পরিবার ও তার স্ত্রী নিপা। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরদিন গুমের শিকার পরিবারগুলো তাদের স্বজনদের খুঁজতে গিয়েছিলেন ক্যান্টনমেন্ট এলাকার কচুক্ষেতে। কিন্তু তাদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তারা শুধু জানিয়েছে, সেখানে আর কেউ নেই।

নিপা বলেন, যখন যেখানে যেতে বলেছে ছুটে গেছি। এখনও যাচ্ছি। আমি আমার স্বামীকে ফেরত চাই।

গত ১১ বছর একা একা চলছেন নিপা ও তার একমাত্র ছেলে আরিয়ান। জীবনের বাকি পথটুকু ভালোভাবে চলতে স্বামীকে ফেরত চান তিনি। তার একটাই কথা, যেকোনো শর্তে আমি আমার স্বামীকে ফেরত চাই।

এমআইকে/জেএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর